একদা এক লোক দাবি করে, আমি পয়গাম্বর; এমনকি সব পয়গাম্বরের সেরা। গলায় গামছা বেঁধে লোকেরা তাকে নিয়ে গেল বাদশাহর কাছে। লোকেরা বলল, তুমি ছন্নছাড়া যদি পয়গাম্বর হতে পার, তবে আমরা প্রত্যেকে তো আরো ভালো পয়গাম্বর হব। এসব গালভরা বুলি কোথায় শিখেছ তার মজা দেখাব। ভণ্ড ভাব দেখিয়ে বলল, তোমরা তো শিশুর মতো ঘুমের ঘোরে দুনিয়ায় এসেছ। ঊর্ধ্বলোকের কোনো খবর কি তোমাদের আছে? পয়গাম্বররা তোমাদের মতো ঘুমের ঘোরে দুনিয়াতে আসেননি। এই যে পঞ্চেন্দ্রিয়ের দৃশ্যমান দশ দিকের চৌহদ্দির ঘেরা জগৎ, তার বাইরে আছে অন্য জগৎ, সেখানকার খবরাখবর নিয়েই পয়গাম্বররা আসেন মাটির পৃথিবীতে।
লোকেরা বাদশাহকে বলল, এই লোক কথায় পণ্ডিত। সহজে জব্দ করা যাবে না। বন্দি রেখে শাস্তি না দিলে মাথা থেকে পাগলামি নামবে না। বাদশাহ দেখলেন, ক্ষীণকায় লোকটির মাথায় একটি ঘুষি বসালেই সে মারা যাবে, তাতে তার স্বীকারুক্তি আদায় কী করে সম্ভব হবে? মনে মনে বললেন, গর্ত থেকে সাপ বের করতে হলে নরম সুরের মূর্ছনা তুলতে হবে। লোকজন সরিয়ে দিয়ে কাছে ডেকে জানতে চাইলেন, তোমার বাড়ি কই? তোমার জীবন জীবিকা কীভাবে চলে? লোকটি জানাল, আমার আবার বাড়ির প্রয়োজন কীসে? আকাশের বুকে চাঁদ ভেসে বেড়ায়, মাটির পৃথিবীতে কি তার কোনো বাড়িঘর আছে? বাদশাহ ধৈর্যের পাথর চেপে বললেন, ওসব ঠিক আছে। তবে বল, গত রাতের খাবার কী ছিল, কেমন আছ? আজ সকালে নাস্তা কী করেছ? বললে তোমার পাগলামির হেতুটা জানতে পারব। তার সাফ জবাব, যদি শুকনো বা ভেজা রুটির চিন্তায় মজে থাকতাম, তাহলে কী পয়গাম্বরির দাবি করতাম?
আমার কথা বাদ দিন। দেশের মানুষের যে অবস্থা দেখছেন, তাদের সাথে পয়গাম্বরদের অবস্থা পর্বতের কাছে অন্তর দাবি করার সমান। পাহাড়ের সটান পাথরের যেমন অন্তর নেই, এ যুগের লোকরাও তেমনি হৃদয়শূন্য, প্রাণহীন। এরা পয়গাম্বরের কথা মানে বটে, স্বার্থের প্রশ্ন আসলে সেদিকে চম্পট দেয়। যদি শুনে কোনো সুন্দরী মহিলার সাথে অভিসারের সুযোগ আছে বা স্বর্ণপ্রাপ্তির সংবাদ পায়, তখনই তাদের মন উচাটন হয়ে উঠে। আর যদি সত্য সুন্দরের অনুসরণে মধুময় জীবনের কথা বলেন, আল্লাহর পথে ডাকেন, পাপের পথ ছেড়ে দ্বীনের ছায়াতলে জীবন যাপনের উপদেশ দেন, তখন আপনাকে বধ করার জন্য খড়গহস্ত হবে।
আল্লাহর অলিরা, যারা মানুষকে সত্য ও সুন্দরের পথে ডাকেন, দ্বীনের পথে চলার জন্য বলেন, তাদের সাথে এরা চরম শত্রুতা করে। অবশ্য আল্লাহর পথের আহ্বানকে সহ্য করতে না পারার কারণ আছে। প্যাঁচার প্রিয় জায়গা ভূতুড়ে বিরানভূমি। বাগদাদ শহর বা তাবাস নগরী প্যাঁচাদের পছন্দের বসতি নয়। শাহী বাজপাখি যদি রাজবাড়ির জান্নাত কানন, প্রবহমান ঝর্ণা আর বালাখানার সংবাদ নিয়ে আসে, প্যাঁচারা বলে তোমার এসব কথা রূপকথার ছলনা।
এসব মূল্যবান কথা কার কাছে বলব? দুনিয়ার গ্রামে তো দিলওয়ালা একটি প্রাণীও খুঁজে পাই না। অনেকে বলে, নিজে প্রেমিক। আল্লাহর প্রেমে আত্মহারা। কিন্তু প্রেমের পরীক্ষা দিতে রাজি নয় তারা। শত মান-অভিমান প্রেমের কারিশমায় লুক্কায়িত। কষ্ট-পরীক্ষার দুর্গম পথ পাড়ি দিলেই প্রেমে সিদ্ধি আসে। একটি আপ্ত বাক্য আছে, ‘অসাধ্য সাধন করিলে প্রেমের কিছু গন্ধ মিলে, ফেরেশতা পারে না যেতে প্রেম গিয়াছে যেখানে।’ প্রেমের পরীক্ষার একটি সিলেবাস আছে। তা হলো, ধৈর্য, সহ্য ও সাধনায় আল্লাহর সাথে কৃত অঙ্গীকার রক্ষা করা। একটি উপমা দিলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে। মানুষের উপমা গাছ আর অঙ্গীকার হলো সেই গাছের শিকড়। গাছ যত জমকালো হোক শিকড় মরে গেলে গাছের অকাল মরণ হবে। যদি শিকড় তাজা থাকে, গাছে পত্রপল্লব না থাকলেও একদিন অবশ্যই ফলফুলের বিস্তার হবে।
কারো জ্ঞান বুজুর্গীর বাহার দেখে প্রতারিত হয়ো না। দেখতে হবে আল্লাহর সাথে কৃত ওয়াদা পূরণে সুন্দর চরিত্রের মহিমা তার ব্যক্তিত্বে ফোটে উঠেছে কি না। তার কর্মজীবনই প্রমাণ করবে তিনি আল্লাহর সাথে কৃত ওয়াদার ওপর কতখানি অবিচল। যাদের চরিত্রে মন্দ স্বভাব, নেককার লোকদের প্রতি হিংসা বিদ্বেষ মজ্জাগত হয়ে গেছে, তারা মানুষ নামের শয়তান। এদের স্বভাব বদলে মানুষ হবার সম্ভাবনা ক্ষীণ। এদেরকে বর্জন করে চল। এরা আবু জেহেল চরিত্রের। কারো ভালো চায় না, সহ্য করতে পারে না। এই মারাত্মক রোগ থেকে মুক্তির জন্য তুমিও আল্লাহর সাথে কৃত অঙ্গীকার স্মরণ কর। নিজের অহমিকা প্রকাশ করতে যেয়ো না। অন্যের প্রতি হিংসাবিদ্বেষ থেকে মনকে পবিত্র কর। যদি এই রোগ থেকে মুক্ত হতে না পার, অন্তত নিরবতা পালন কর। নিরবতার মধ্যে অনেক নেয়ামত নিহিত। মানুষ যে কথা বলে তা বের হয় মগজ থেকে। কথা যত বেশি বলবে মগজের তত ক্ষয় হবে। কাজেই তুমি মগজের হেফাজতের জন্য আজেবাজে কথা থেকে মুখ সামলাও। আল্লাহর সাথে কৃত ওয়াদার ওপর অবিচল থাক। তখন তোমার অবস্থা হবে-
চোনকে দর আহদে খোদা কর্দী ওয়াফা
আয করম আহদত নেগাহ দারদ খোদা
যদি রক্ষা করে চল আল্লাহর সাথে কৃত ওয়াদা
আপন দয়ায় তোমার ওয়াদাও রক্ষা করবেন খোদা।
এই ভাবধারা ও জীবন দর্শন কোরআনের। আল্লাহ পাক বলেন, ‘হে বনি ইসরাঈল! আমি তোমাদের প্রতি যে নেয়ামত দান করেছি তার কথা স্মরণ কর। তোমরা আমার সাথে কৃত অঙ্গীকার পালন কর, আমিও তোমাদের অঙ্গীকার পূরণ করব। আর একমাত্র আমাকেই ভয় করে চল।’ (সুরা বাকারা: ৪০)।
আয ওয়াফায়ে হক তো বস্তে দিদেয়ী
উযকুরু আযকুরকুমু নাশনীদেয়ী
আল্লাহর ওয়াাদা পালনে চোখ বুঁজে আছ তুমি যেমন
‘আমাকে স্মরণ কর, আমিও স্মরণ করব’ করনি শ্রবণ।
আল্লাহপাক ইরশাদ করেন, ‘তোমরা আমাকে স্মরণ করো, আমি তোমাদের স্মরণ করব। আর তোমরা আমার শোকর আদায় করো। আমার নাফরমানি করো না।’ (সুরা বাকারা: ১৫২)। কোরআনের এ বাণী তুমি মনের কানে শ্রবণ করনি। বাস্তব জীবনে রূপায়িত করনি। তাই ঊর্ধ্বলোক হতে কোনো হাতছানি আসেনি।
গূশ নেহ আউফু বেআহদী গূশ দার
তা কে উফি আহদাকুম আ’য়দ যে য়্যার
কান পেতে শুনো ‘আমার প্রতিশ্রুতি পূরণ করো’ বাণী
‘তোমাদের ওয়াদা পূরণ করব’ বন্ধুর ঘোষণা আসবে তখনি।
মওলানা রুমি (রহ.) বলেন, আল্লাহর সাথে কৃত ওয়াদা পালন, আল্লাহকে ঋণ দেয়ার যে কথা কোরআন মাজিদে বলা আছে তার হাকিকত কী, তাতে লাভ কার? মাটিতে বীজ বপন করলে লাভ কি জমির? নাকি জমির আসল মালিক আল্লাহর। নিশ্চয়ই এর শতভাগ মুনাফা তোমারই। কাজেই তুমি আল্লাহর কাছে চাও, প্রার্থনা কর, যাতে শস্য দানায় শতগুণ মুনাফা দেয়ার মত অফুরান রহমত দিয়ে তোমার জীবন ভরে দেন। দোয়া মানে শুধু মুখের বুলি নয়। যে লোক বীজ বপন করে বাস্তব কর্মের মাধ্যমে সে দোয়া করে, প্রভুহে এই বীজ মাটি থেকে পেয়েছি, খেয়ে জীবন তরিয়েছি আবারো মাটিতে গচ্ছিত রেখে তোমাকে ঋণ দিচ্ছি আমাকে বহুগুণ মুনাফা দাও। কাজেই দোয়ার জন্য বাস্তব আমল চাই। বীজ বপন করেই ফসলের জন্য দোয়া করা চাই।
দোয়ার বীজ বপনের জন্য মনের জমিনকে আগাছামুক্ত করতে হবে। প্রথম কাজ হিংসা থেকে মুক্ত হতে হবে। কারণ দুনিয়াতে যত অনর্থ তার মূলে রয়েছে হিংসা। রাজা বাদশাহদের যুদ্ধবিগ্রহ থেকে নিয়ে নারীর প্রেমে জয়লাভের প্রতিযোগিতার মূলেও রয়েছে হিংসা। হিংসা মানুষকে জ্বালিয়ে শেষ করে যেভাবে আগুন লাকড়িকে জ্বালিয়ে দেয়। দেখ না, মহিলারা কত কোমল মায়াবী স্বভাবের হয়। কিন্তু হিংসার আক্রমণে সতিনের বেলায় কেমন রুক্ষ মারমুখো হয়ে যায়। কাজেই হিংসা থেকে নিজে বাঁচতে হবে। হিংসুক থেকে রক্ষা পাওয়ার চেষ্টা করতে হবে। আসল হিংসুক তো শয়তান। আল্লাহর দরবার থেকে বিতাড়িত হওয়ার পর সে কসম খেয়েছে আদম সন্তান নিয়ে দোযখ ভর্তি করার। তুমি মনে করো না যে, শয়তান শুধু জিন জাতির। মানুষ শয়তান এত মারাত্মক যে, স্বয়ং জিনেরা সাহায্য নেয় মানুষ শয়তানের।
বাদশাহ বললেন, তুমি যে পয়গাম্বরী দাবি করেছ, তার রহস্যটা ব্যক্ত করনি আমার কাছে। দাবিদার বলল, আমার দাবি মিথ্যা হলেও একেবারে ফেলে দেয়ার মতো নয়। কোরআন মাজিদে আল্লাহ বলেছেন ‘ওয়া আউহা রাব্বুকা ইলান্নাহলি’ ‘মৌমাছিকে তোমার প্রভু (মধু আহরণের জন্য) অহি যোগে নির্দেশ দিয়েছেন।’ (দ্র. সুরা নাহাল: ৬৮) আল্লাহর অহি লাভ করেই মৌমাছি দুনিয়াজুড়ে মধুর হাঁট বসিয়েছে। আমি মানুষ হয়ে মৌমাছির চেয়ে কম কিসে। সুরা কাউসারে বলেছেন, ‘আমি আপনাকে কাউসার (প্রাচুর্য) দান করেছি।’ এই প্রাচুর্য নিশ্চিতই আধ্যাত্মিক সম্পদ।
তুমি মুহাম্মদি চরিত্র ধারণ করো তাহলে সেই প্রাচুর্য তুমিও পাবে। এই জগৎ তোমার কাছে মধুভাণ্ডারে পরিণত হবে। তোমার অন্তরে ঊর্ধ্বজগতের অনুপ্রেরণা সঞ্চারিত হবে। শরিয়তের ভাষায় এর নাম ইলহাম। বিজ্ঞান বলে, ইনটিউশন। যদি ফেরাউনি চরিত্রের হও, তাহলে নীল-নদের পানি তোমার জন্য রক্তে পরিণত হবে। কাজেই যার মধ্যে ফেরাউনি স্বভাব দেখ, তাকে ত্যাগ কর। যার চরিত্রে ইবরাহিম খলিল (আ.)-এর স্বভাব পাও তার সাহচর্যকে সৌভাগ্য মনে কর। এটিই ‘যে আল্লাহর জন্য ভালোবাসে এবং আল্লাহর জন্য শত্রুতা পোষণ করে তার ঈমান কামিল হয়েছে’- হাদীসের প্রতিপাদ্য। এখানেই ঈমানের হাকিকত। তোমার গোটা অস্তিত্ব দিয়ে-
তা নখানী লা ও ইল্লাল্লাহ রা’
দর নয়াবী মানহাজে ইন রাহ রা’
যতক্ষণ ‘নাই একমাত্র আল্লাহ ছাড়া’ না পড়বে
ততক্ষণ এই পথচলা রপ্ত হবে না, পাবে না খুঁজে।
(মওলানা রুমির মসনবি শরিফ, ৫খ. বয়েত-১১১৯-১২৪১)
(ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী রচিত মসনবি শরিফের গল্প ১-৬ খণ্ড প্রকাশ করেছে ছায়াপথ প্রকাশনী, মসজিদ বায়তুশ শরফ কমপ্লেক্স, ১৪৯/এ, এয়াপোর্ট রোড, ফার্মগেট, ঢাকা। ফোন ০১৭১১১১৫৮২৯। মসনবির গল্পভিত্তিক আলোচনা শুনতে ইউটিউবে ভিজিট করুন- CHAYAPATH PROKASHONI)