ঢাকা মঙ্গলবার, ২৪ জুন ২০২৫, ১০ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

ধৈর্যের গুরুত্ব ও ফজিলত

আবু সালমান ওমর ফারুক
ধৈর্যের গুরুত্ব ও ফজিলত

সবর শব্দের অভিধানিক অর্থ ধৈর্য। আর ধৈর্য মানে গুনাহের কাজ হতে নফসকে আটকে রাখা। পবিত্র কোরআনে ‘সবর’ এ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। (সুরা কাহফ : ২৮) ইসলামি পরিভাষায় সবর বলা হয়, আল্লাহর সন্তুষ্টির কাজে প্রবৃত্তিকে মশগুল রাখা এবং তার অসন্তুষ্টির কাজ হতে বিরত রাখা। আল্লাহর নাফরমানি না করা এবং বিপদের সময় নিজেকে সংযত রাখাকেও সবর বলা হয়।

ধৈর্য তিন প্রকার : এক. আল্লাহর ইবাদত পালনের সময় সবর করা। ধৈর্য ছাড়া কোনো আমল করা কিংবা পাপ থেকে বিরত থাকা সম্ভব নয়। মানুষের মন অলস ও আরামণ্ডপ্রিয়। কাজেই মনের বিরুদ্ধে কোনো কিছু করতে গেলে মনকে সে কাজে আটকে রাখতে হয়। প্রচণ্ড শীতকে উপেক্ষা করে ফজরের নামাজে যেতে মন চায় না। আর এ জন্যই নেক আমল করতে ধৈর্যের প্রয়োজন হয়। প্রবৃত্তিকে দমন করার মাধ্যমেই ইবাদতে স্বাদ অনুভব হয়। মনচাহি জিন্দেগি যাপন করে ইবাদতগার হওয়া যায় না।

দুই. গুনাহ থেকে নিজেকে বিরত রাখতে ধৈর্য ধারণ। কারণ, গুনাহ থেকে বাঁচার জন্যও ধৈর্যের প্রয়োজন হয়। তিন. বিপদ ও মুসিবতের সময় ধৈর্য ধারণ করা। মুসিবতের সময় ধৈর্যের বিকল্প আর কিছু নেই। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি ধৈর্যশীল হতে চায়, আল্লাহ তাকে ধৈর্যশীল হওয়ার তাওফিক দেন। (সহি বোখারি : ৬৪৭০)। সবরের ব্যাপারে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘ধিক তোমাদের! যারা ঈমান এনেছে এবং নেক আমল করেছে, তাদের জন্য আল্লাহর পুরস্কারই শ্রেষ্ঠ। আর ধৈর্যশীল ব্যতীত এটা কেউ লাভ করতে পারবে না।’ (সুরা কসাস : ৮০)। অন্য আয়াতে বলেন : ‘আর এইসব গুণ শুধু তারাই লাভ করতে পারে যারা ধৈর্যশীল। আর এই গুণ কেবল তাদের দান করা হয়, যারা মহা ভাগ্যবান। (সুরা ফুসসিলাত : ৩৫)। আল্লাহতায়ালা সফলতা লাভের জন্য ধৈর্য অবলম্বনের শর্ত করেছেন। তিনি সুরা আলে ইমরানের শেষ আয়াতে বলেছেন, হে বিশ্বাসীগণ! বিপদ মুসিবতে তোমরা সবর কর এবং কাফেরদের মুকাবেলায় অবিচল থাক এবং ইবাদতে মনোযোগী হও। আর আল্লাহকে ভয় করো যেন তোমরা সফল হতে পার। আসল সবর হলো প্রথম শোকাঘাতের সময়। কেননা, যেকোনো বিপদ ও মুসিবতে প্রথম দিকে সবর করা বড়ই কষ্টকর। তাই নবী (সা.) একজন সন্তানহারা মহিলাকে ধৈর্যহারা দেখে ধৈর্যের নির্দেশ দিয়ে বলেছেন, প্রথম শোকাঘাতের সময়েই তো সবর করার উত্তম সময়। (সহি বোখারি : ১২৮৩)। অর্থাৎ পরবর্তীতে স্বাভাবিকভাবেই সান্ত¡না লাভ হয়ে যায়। ফলে প্রথম মুহূর্তে আল্লাহর ভয় এবং সাওয়াবের আশায় সবর করাই হলো প্রশংসার যোগ্য।

সবরের ফজিলত : আল্লাহ সুরা যুমারের ১০ নং আয়াতে বলেছেন, তিনি ধৈর্যশীলদের বেহিসাব প্রতিদান দিবেন। অন্য আয়াতে বলেন, “(ফেরেশতাগণ ধৈর্যশীলদের বলবে), তোমাদের প্রতি শান্তি তোমাদের ধৈর্যধারণের জন্য! আর এই পরিণাম কতইনা উত্তম। (সুরা আর রাদ : ২৪)। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, সবর হলো নূর (আলোকবর্তিকা)। ( সহি মুসলিম : ২২৩)। যেহেতু সবর দ্বারা মানুষের ভেতরের পাশবিকতা অবদমিত হয়ে রুহ শক্তিশালী হয় এবং মানুষের হৃদয়ে ফেরেশতার স্বভাব জাগ্রত হয়, সেহেতু সবরকে নূর বা আলোকবর্তিকা বলা হয়েছে।

বাধ্যতামূলক সবর এবং স্বেচ্ছায় সবর : বাধ্যতামূলক সবর প্রতিটি প্রাণীর মধ্যেই থাকে। কিন্তু স্বেচ্ছায় সবর অবলম্বন শুধু মানুষেরাই করে থাকে। তাই মানুষ এবং পশুর মধ্যে এদিক থেকে এক বড় ব্যবধান রয়েছে। জনৈক বিজ্ঞ ব্যক্তি বলেছেন, আমাকে কোনো ব্যক্তি পরাজিত করতে পারেনি একজন যুবক ছাড়া। সেই যুবক আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, সবর কী? আমি বলেছিলাম, যখন পাই তখন খাই, আর যখন না পাই তখন সবর করি। যুবক বলল, এই প্রকার সবর তো কুকুরেও করে থাকে, পেলে খায় আর না পেলে সবর ছাড়া উপায় কী? সুতরাং এখানে বাধ্যতামূলক সবর করতেই হবে। আমি যুবককে বললাম, তাহলে তোমার কাছে সবরের পরিচয় কী? যুবক বলল, আমরা যখন না পাই তখন সবর করি ,আর যখন পাই তখন নিজেরা সবর অবলম্বন করে অন্যদের দিয়ে দিই। (তাফসিরে কুরতুবি)।

উম্মে সুলাইম (রা.)-এর ধৈর্য : সাহাবী আবু তালহা (রা.)-এর সন্তান ওমাইর (রা.) যখন মৃত্যুবরণ করল, তখন তার স্ত্রী উম্মে সুলাইম ঘরের সবাইকে বলে দিলেন, আমার আগে তোমরা এ ব্যাপারে কাউকে জানাবে না। পরে আবু তালহা (রা.) বাড়িতে এলে একদিকে তিনি তার সামনে রাতের খাবার পেশ করলেন। অন্য দিকে তিনি স্বামীর জন্য অন্য সময়ের চেয়ে একটু বেশি সাজসজ্জা করে নিজেকে তার সামনে পেশ করলেন। যখন দেখলেন আবু তালহা পরিতৃপ্ত হয়েছেন, ঠিক তখনই উম্মে সুলাইম বললেন, হে আবু তালহা! বলুন তো, কেউ কোনো পরিবারের কাছে কিছু আমানত রাখার পর তা আবার ফেরত চাইলে, সেই পরিবারের তা ফেরত না দেয়ার কোনো অধিকার আছে কী? তিনি বললেন, না। এ সুযোগে উম্মে সুলাইম (রা.) বলে উঠলেন, আল্লাহতায়ালা আমাদের যেই সন্তান আমানত হিসেবে দিয়েছিলেন তার আমানত তিনি ফিরিয়ে নিয়েছেন। আপনার সন্তান ওমাইর তো মারা গেছে। আল্লাহর আমানত আল্লাহ নিয়ে গেছেন। এখন আপনার সন্তানের ব্যাপারে ধৈর্য ধারণ করুন এবং এর বিনিময়ে আল্লাহর কাছে সাওয়াবের আশা করুন। অর্থাৎ সন্তানের মৃত্যু শোকে এমন কিছু করবেন না বা এমন কথা বলবেন না যাতে সাওয়াব নষ্ট হয়ে যায়। (সহি বোখারি : ৫৪৭০ মুসলিম : ২১৪৪)।

ধৈর্যের উপকারিতা : এক জায়গায় নবী (সা.) ও আবু বকর (রা.) বসা ছিলেন। কিছুক্ষণ পর এক ব্যক্তি এলো। কোনো কারণে সে আবু বকর (রা.) এর ওপর অসন্তুষ্ট ছিল। সে কঠোর ভাষায় তার সাথে কথা বলতে লাগল। সে একাধারে বলেই যাচ্ছে। আর নবী (সা.) ও আবু বকর (রা.) তার কথা শুধু শুনেই যাচ্ছিলেন। যখন সে অতিরঞ্জন করে ফেলেছে, তখন আবু বকর (রা.) তার প্রতিউত্তরে নিজের নির্দোষ প্রমাণ করলেন। তখন নবী (সা.) সেখান থেকে চলে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ালেন। আবু বকর (রা.) জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর নবী! আপনি কি চলে যাচ্ছেন? তিনি বললেন, আবু বকর! এই ব্যক্তি যখন তোমার সম্পর্কে এ ধরনের কথাবার্তা বলছিল, তখন এক ফেরেশতা তোমার পক্ষ থেকে তার কথাবার্তার উত্তর দিচ্ছিল। যখন তুমি নিজের পক্ষ থেকে উত্তর দিতে শুরু করেছ, তখন সেই ফেরেশতা চলে গেছে, এখন আমিও চলে যাচ্ছি।

যা অন্তরে সবর তৈরি করে : অন্তরে এই দৃঢ় বিশ্বাস থাকা, দুনিয়ার সবকিছুর মালিক একমাত্র আল্লাহতায়ালা। আর আমরা হলাম আল্লাহর জন্য এবং তার কাছেই ফিরে যাব। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, মুসলমান অসুখ-বিসুখ, দুঃখ-কষ্ট, চিন্তা পেরেশানি ইত্যাদি যেকোনো মসিবতে আক্রান্ত হোক, এমন কি যদি তার পায়ে একটি কাটাও বিঁধে, তবে এর বিনিময়ে আল্লাহ তার গুনাহ ক্ষমা করে দিবেন। (বোখারি : ৫৬৪২, মুসলিম : ২৫৭৩)। সবরের যেমন ইহকালীন কল্যাণ রয়েছে, তেমনি পরকালীন কল্যাণও রয়েছে। ইহকালীন কল্যাণ হলো, মানুষ বিপদের সময় বাধ্য হয়ে আল্লাহর আশ্রয় গ্রহণ করে। ফলে আল্লাহর সাহায্য তার সাথে শামিল হয়। আর পরকালীন কল্যাণ হলো, এতে তার গুনাহ মাফ হয়। সুতরাং ধৈর্য ধরলে আল্লাহতায়ালা তার সাহায্যকারী ও কার্যনির্বাহী হয়ে যান এবং তার বদলা স্বয়ং আল্লাহতায়ালা দেন। আল্লাহতায়ালা আমাদের ধৈর্যশীল হওয়ার তৌফিক দান করুন, আমিন।

লেখক : শিক্ষক ও অনুবাদক

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত