নবজাতকের প্রতি মা-বাবার দায়িত্ব

বিনতে সফীউল্লাহ

প্রকাশ : ২৬ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

প্রতিটি দম্পতির জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ হলো তাদের সন্তান-সন্ততি। সন্তান হলো সংসারের সৌন্দর্য। যে সংসার কাননে ফোটেনি সন্তান নামক পুষ্প, সে সংসার যেন অথৈ সাগরের বুকে জেগে উঠা একখণ্ড মরুদ্বীপ। যাদের কানে পৌঁছেনি ‘আব্বু-আম্মু’ ডাকের সুমধুর ধ্বনি তাদের অন্তর যেন শুকনো মরুভূমি। সন্তান হলো আল্লাহতায়ালার পক্ষ হতে নেয়ামত স্বরূপ ও পার্থিব জীবনের শোভা। আল্লাহপাক কোরআন মাজিদে এ বিষয়ে বলেন, ‘ধনৈশ্বর্য ও সন্তান-সন্ততি পার্থিব জীবনের সৌন্দর্য, ওটা তোমার পালনকর্তার পক্ষ থেকে পুরস্কার প্রাপ্তির জন্য শ্রেষ্ঠ এবং আশাপ্রাপ্তির জন্য উৎকৃষ্ট।’ (সুরা কাহাফ : ৫৬)। সন্তান প্রসবের পর পিতা-মাতার ওপর কয়েকটি বিষয় আবশ্যক। সন্তান কে সুপথে গড়ে তুলতে, জীবনে সৎ, চরিত্রবান, প্রতিভাবান ও সুপ্রতিষ্ঠিত করে তুলতে সেই বিষয়গুলোর ইতিবাচক প্রভাব অনস্বীকার্য।

ভূমিষ্ট হওয়ার পর আজান দেয়া : ইবলিস মানব জাতির চির শত্রু। যখন কোনো মানব সন্তান ভূমিষ্ট হয়, তাকে প্রকৃতি স্বাগত জানায়। ঠিক এই সময় আক্রমণ করে বসে তার চিরশত্রু ইবলিস। হাদিস শরিফে আছে, হজরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘ সন্তান ভূমিষ্ট হওয়ার পর যে চিৎকার করে, তা মূলত শয়তানের খোঁচার কারণেই করে থাকে। (মুসলিম : ৪৪৯৯)। এজন্য রাসুল (সা.) জন্মের সাথে সাথেই শিশুর ডান কানে আজান ও বাম কানে ইকামত দিতে নির্দেশ দিয়েছেন। হজরত রাফে’ (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, ‘আমি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেখেছি, তিনি হাসান ইবনে আলি (রা.)-এর কানে আজান দিয়েছেন, যখন হজরত ফাতেমা (রা.) তাকে প্রসব করেছিলেন।

তাহনিক করানো : তাহনিক বলা হয় কোনো আল্লাহওয়ালা ব্যক্তির মুখে খেজুর চিবিয়ে নরম করে তা এমনভাবে শিশুর মুখে রাখা, যাতে সে রস চুষে নিতে পারে। তাহনিক একটি সুন্নাত আমল। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, ‘হজরত ‘আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে নবজাতক শিশুকে আনা হতো, তিনি তাদের কল্যাণের জন্য দোয়া করতেন এবং তাদের তাহনিক করতেন। (মুসলিম : ২৮৬, আবু দাউদ : ৫১০৬)।

উত্তম নাম রাখা : নাম হলো প্রতিটি মানবসত্তার পরিচায়ক। ইসলাম ধর্মে সুন্দর নাম রাখার ব্যাপারে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘নিশ্চয় কেয়ামতের দিন তোমাদের নিজেদের এবং তোমাদের পিতাদের নাম ধরে ডাকা হবে। তাই তোমরা নিজেদের সুন্দর নাম রাখ। (আবু দাউদ : ৪৯৪৮)।

আকিকা করা : শিশু জন্মের পর বিভিন্ন আপদণ্ডআপদ থেকে সুরক্ষিত থাকার জন্য পশুজবাই করাকে আকিকা বলা হয়। আকিকা একটি সুন্নত আমল। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘সন্তানের পক্ষ থেকে (পশু জবাই করে) রক্ত প্রবাহিত কর এবং তার অশুচি দূর করে দাও। (বোখারি : ৫০৭৬)।

উত্তম শিক্ষাদান : পিতা-মাতার ওপর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হচ্ছে সন্তানকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলা। এ ব্যাপারে হাদিসে এসেছে, পিতার ওপর সন্তানের অধিকার হলো তার সুন্দর নাম রাখা এবং তাকে সুন্দরভাবে আদব শিক্ষা দেয়া (আল-বাহরুজজাখখার : ৮৫৪০)।

নেককার সন্তানের উপকারিতা : সন্তান পিতা-মাতার মুহাফিজ। আল্লাহ সন্তানাদির দ্বারা পিতা-মাতা কে সাহায্য করে থাকেন। এ ব্যাপারে আল্লাহ পাক কোরআন মাজিদে বলেন, ‘অতঃপর আমি তাদের বিরুদ্ধে তোমাদের জন্য যুদ্ধের পাল্লা ঘুরিয়ে দিলাম। ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি দ্বারা তোমাদের সাহায্য করলাম এবং তোমাদের করলাম সংখ্যাগরিষ্ঠ। (সুরা বনী ইসরায়েল : ৬)। নেককার সন্তান শুধু ইহকালীন সম্পদই নয় বরং পরকালের মহাসম্পদ, পিতা-মাতার নাজাতের ওসিলা, মর্তবা বুলন্দির সোপান। এ ব্যাপারে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘যখন কোনো মানুষ মারা যায়, তখন তার আমল বন্ধ হয়ে যায়, তবে তিনটি বিষয় চালু থাকে আর তা হলো, এক. সদকায়ে জারিয়া দুই. উপকারী ইলম তিন. এমন নেককার সন্তান, যে তার বাবা-মায়ের জন্যে দোয়া করে।

(মুসলিম : ১৬৬১, তিরমিজি : ১৩৭৫)। এছাড়া ছেলেমেয়েকে কোরআনের শিক্ষায় শিক্ষিত করা হলে আর সন্তান অর্জিত ইলম অনুযায়ী আমল করলে, এমন সন্তানের বাবা-মা কেয়ামতের ময়দানে অধিক সম্মানের অধিকারী হবেন। হজরত মুয়ায বিন আনাস জুহানি থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি কোরআন পড়ে সে অনুযায়ী আমল করে তার পিতা-মাতাকে কেয়ামতের দিন এমন তাজ পরানো হবে, যার আলো সূর্যের আলোর চেয়ে উজ্জ্বল হবে। তা যদি দুনিয়াতে তোমাদের মাঝে হতো তাহলে কেমন হতো! যে নিজে আমল করেছে তার সম্পর্কে তোমাদের কী ধারণা। (আবু দাউদ : ১২৪১)। তাই প্রতিটি মোমেনের দায়িত্ব হলো, নিজের সন্তানকে উত্তম শিক্ষা ও শিষ্টাচার শিখিয়ে নেক সন্তান হিসেবে গড়ে তোলা। তাহলে ইহকাল ও পরকালের জীবন সুখময় হবে।

লেখিকা : শিক্ষিকা, জামিয়া হোসাইনিয়া আরাবিয়া, মেলান্দহ, জামালপুর।