তাওহিদের পরিচয় ও গুরুত্ব

আমিনুল ইসলাম হুসাইনী

প্রকাশ : ২৩ আগস্ট ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

তাওহিদ শব্দটি আরবি। এর শাব্দিক অর্থ একত্ববাদ, একীকরণ অথবা দৃঢ়ভাবে এককত্ব ঘোষণা করা। পারিভাষিক অর্থ হলো, আল্লাহতায়ালাকে সত্তাগত ও গুণগত দিক দিয়ে একক জেনে তাঁরই ইবাদত করা। এছাড়াও আল্লাহতায়ালার লেশমাত্র দোষহীন পরিপূর্ণ গুণরাজিতে আল্লাহর একত্বের হৃদয়গত ইলম ও বিশ্বাস, মৌখিক স্বীকৃতি ও ইবাদতের ক্ষেত্রে তাঁর একত্ব প্রতিষ্ঠা করার নামই তাওহিদ।

জীবনের প্রকৃত সফলতা তাওহিদের বিশ্বাসের ওপরই নির্ভর করে। তাওহিদের বিশ্বাস না থাকলে সফলতার কোনো প্রশ্নই আসে না। তাই তো পবিত্র কোরআনে তাওহিদের গুরুত্ব তুলে ধরা হয়েছে বিভিন্নভাবে। আল্লাহ বলেন, ‘যাবতীয় প্রশংসা আল্লাহতায়ালার জন্য, যিনি সব সৃষ্টি জগতের পালনকর্তা।’ (সুরা ফাতিহা : ২)।

অন্য আয়াতে এরশাদ হয়েছে, ‘তুমি জিজ্ঞেস করো, কে তোমাদের আসমান ও জমিন থেকে রিজিক দান করেন? কিংবা কে তোমাদের কান ও চোখের মালিক? তাছাড়া কে জীবিতকে মৃতের ভেতর থেকে বের করেন এবং কেইবা মৃতকে জীবিতের মধ্য থেকে বের করেন? কে করেন কর্ম সম্পাদনের ব্যবস্থাপনা? তখন তারা বলে উঠবে, আল্লাহ। তখন তুমি বলো তারপরেও ভয় করছ না?’ (সুরা ইউনুস : ৩১)।

পবিত্র এ দুটি আয়াতে সমগ্র বিশ্বের মালিক আল্লাহতায়ালা নিজ কুদরত ও শক্তির প্রমাণ পেশ করেছেন যে, তিনি প্রাণহীন থেকে প্রাণ তৈরি করেন। যেমন- মানুষ প্রাণী জীবিত, আল্লাহ তার থেকে বীর্য বের করেন আর বীর্য প্রাণহীন। এমনিভাবে পাখি প্রাণওয়ালা জীবিত, এর থেকে ডিম বের করেন আর ডিমে কোনো প্রাণ নেই। এই প্রাণহীন বীর্য ও ডিম থেকেই আল্লাহতায়ালা জানদার বা প্রাণওয়ালা বাচ্চা সৃষ্টি করেন।

আল্লাহতায়ালার তাওহিদ সম্পর্কে স্বয়ং আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআানে এত স্পষ্ট আলোচনা করেছেন যে, একজন বিবেকবান মানুষের কাছে আল্লাহতায়ালার অস্তিত্ব ও তাওহিদের প্রমাণের জন্য যথেষ্ট। পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে, আসমান ও জমিনে যদি আল্লাহ ব্যতিত একাধিক উপাসক থাকত, তাহলে উভয়েই ধ্বংস হয়ে যেত।’ (সুরা আম্বিয়া : ২২)।

তাওহিদের প্রকারভেদ

ইসলামি স্কলাররা তাওহিদকে তিনভাগে বিভক্ত করেছেন। যথা-

তাওহিদুর রুবুবিয়্যাহ : আল্লাহকে তাঁর কর্মসমূহে একক হিসেবে মেনে নেওয়া। যেমন সৃষ্টি করা, রিজিক দেওয়া, জীবন-মৃত্যু দান করা ইত্যাদি। নবী (সা.)-এর আগমনের আগে কাফেররাও তাওহিদের এই প্রকারের স্বীকৃতি দিয়েছিল। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আপনি যদি তাদের জিজ্ঞেস করেন, নভোমণ্ডল ও ভূ-মণ্ডল কে সৃষ্টি করেছে? তারা অবশ্যই বলবে, আল্লাহ। বলুন, সকল প্রশংসাই আল্লাহর। বরং তাদের অধিকাংশইই জ্ঞান রাখে না।’ (সুরা লুকমান : ২৫)।

তাওহিদুল উলুহিয়্যাহ : ইবাদতের ক্ষেত্রে আল্লাহকে একক নির্ধারণ করা। যেমন- নামাজ, রোজা, নযর, মানত, দান-সদকা ইত্যাদি। যাবতীয় ইবাদত এককভাবে আল্লাহর উদ্দেশ্যে করার জন্যই সমস্ত নবী-রাসুলকে প্রেরণ করা হয়েছে। আসমানি কিতাবগুলো নাজিল করা হয়েছে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আর ইবাদত করো আল্লাহর, শরিক করো না তাঁর সঙ্গে অপর কাউকে। (সুরা নিসা : ৩৬)।

আসমা ও সিফাত : যে সমস্ত সুন্দর নাম ও গুণাবলি আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সা.) আল্লাহতায়ালার জন্য সাব্যস্ত করেছেন, সেগুলোকে কোনো প্রকার পরিবর্তন, অস্বীকৃতি ও ধরন-গঠন নির্ধারণ ছাড়াই সাব্যস্ত করা ও মেনে নেওয়া। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘আল্লাহর অনেক সুন্দর সুন্দর নাম আছে, তোমরা সেই নামেই তাকে ডাকো।’ (সুরা আরাফ : ১৮০)।

কেউ কেউ বলেন, ‘আল্লাহর নাম এবং গুণাবলির ক্ষেত্রে তাওহিদ বা আল্লাহর একত্ব বজায় রাখা।’ পবিত্র কোরআনের বহু আয়াতে উল্লেখিত তাওহিদের তিনটি শাখা তথা- রুবুবিয়্যাহ, উলুহিয়্যাহ এবং আসমা ও সিফাতের মধ্যে আল্লাহতায়ালার সঙ্গে কাউকে শরিক করতে কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন। এটাকে সবচেয়ে মারাত্মক অন্যায় ও চরম গর্হিত কাজ বলে আখ্যায়িত করেছেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আর তোমাদের উপাসক হচ্ছেন এক উপাসক। তিনি ছাড়া কোনো উপাসক নেই। তিনি অতি দয়াময়, পরম দয়ালু।’ (সুরা বাকারা : ১৬৩)।

তাওহিদের গুরুত্ব বোঝানোর জন্য দারুণ একটি ঘটনা রয়েছে। ঘটনাটি এক মাওলানা সাহেব ও এক বুড়িকে নিয়ে। এক বুড়ি বারান্দায় বসে বসে সারা দিন চড়কা ঘুড়িয়ে সুতো কাটত। মাওলানা সাহেব প্রতিদিনই তাকে এ অবস্থায় দেখতেন। একদিন মাওলানা সাহেব দাওয়াত ও তাবলিগের খাতিরে তাকে দ্বীনের দাওয়াত দেওয়ার জন্য কাছে বললেন, হে বুড়ি! সারা দিন চড়কা ঘুরিয়ে শুধু সুতোই কাটো, আল্লাহতায়ালার কোনো খবর কি রাখো? বুড়ি উত্তর দিলেন, হ্যাঁ, আমার আল্লাহ ওই সত্ত্বা, যিনি সারা বিশ্বের শৃঙ্খলা বজায় রাখছেন। তিনি এক, তাঁর কোনো শরিক নেই। স্বীয় অস্তিত্বে তিনি একক, তাঁর সমকক্ষ কেউ নেই।

এবার মাওলানা সাহেব বললেন, হে বুড়ি তুমি যে দাবি করেছ আল্লাহ আছেন, তোমার কাছে এর কোনো প্রমাণ আছে কি? না কি এমনিতেই শুনে শুনে বলে দিয়েছ? বুড়ি উত্তর দিলেন, বেটা! এমনিতেই বলিনি, আমার কাছেই এর প্রমাণ আছে। এই বলে বুড়ি হাত দিয়ে চড়কা ঘুড়িয়ে হঠাৎ হাত সরিয়ে নিলে চড়কা বন্ধ হয়ে যায়। বুড়ি এ দৃশ্য দেখিয়ে মাওলনা সাহেবকে বললেন, সামান্য একটা চড়কা যদি আমি না চালালে চলা বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে এত বিশাল সৃষ্টি কেউ না কেউ তো অবশ্যই চালাচেচ্ছন। না হলে কি এই সৃষ্টি জগৎ চলত? যে সৃষ্টিজগতে অগণিত নক্ষত্র, চন্দ্র, সূর্য অসংখ্য সৃষ্টি বস্তু যার যার কাজে সদা ব্যস্ত, এতে পরিস্কার প্রমাণ হয় যে, এ জগতের পরিচালনাকরী একজন আছেন। তিনিই আমার খোদা, তিনিই আমার উপাসক।

পবিত্র কোরআনও তাই বলে। আল্লাহতায়ালা এক ও একক। তাঁর কোনো শরিক নেই। তিনিই ইবাদতের উপযুক্ত একমাত্র উপসাক। তিনি সবকিছুর স্রষ্টা, তিনি ছাড়া যা কিছু আছে, সবকিছু তাঁরই সৃষ্টি। তাই সমগ্র সৃষ্টি তাঁরই দাসত্ব করবে। পবিত্র কোরআনের স্পষ্ট ঘোষণা, ‘আর তোমাদের উপাস্য একমাত্র আল্লাহতায়ালাই। তিনি ছাড়া আর কোনো উপাস্য নেই; তিনিই পরম দয়াময়; অনন্ত অসীম করুণাময়।’ (সুরা বাকারা : ১৬৩)।

অতএব, ইবাদত করতে হবে শুধুমাত্র এক আল্লাহর। তবেই পরকালে চিরস্থায়ী জীবনের নাজাত লাভ সম্ভব। আল্লাহতায়ালা মুসলিম উম্মাহকে একত্ববাদের ওপর অটল ও অবিচল থেকে তাঁর পরিচয় ও গুণাবলি মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার তৌফিক দান করুন।

লেখক : খতিব, কসবা জামে মসজিদ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া