মওলানা রুমির মসনবি শরিফ (কিস্তি- ৬/১২)

নবীজির (সা.) গোলামিতে আবু বকরের (রা.) জীবন ধন্য

ড. মওলানা মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী

প্রকাশ : ৩০ আগস্ট ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

গোফত আই সিদ্দিক আখের গোফতামাত

কে মোরা আন্বাজ কুন দর মাকরামাত

বললেন, হে সিদ্দিক, আমি কি বলিনি তোমাকে

আমাকেও শরীক করবে তোমার এই মহৎ কাজে।

হে আবু বকর সিদ্দিক, তুমি যখন বেলালকে কেনার কথা বলেছিলে, যাবার সময় বলেছিলাম, এই মহৎ কাজে আমাকেও শরিক কর। কেনা মূল্যের অর্ধেক টাকা তুমি দেবে আর অর্ধেক দেব আমি। কিন্তু তুমি আমাকে বাদ দিয়ে একা কিনে আনলে, তার কারণ কী?

গোফত মা দো বন্দেগানে কুয়ে তু

করদমশ আজাদ মন বর রুয়ে তু

বলল, আমরা উভয়ে তোমার গলির আদনা গোলাম তাই

তাকে মুক্ত করেছি আপনার সন্তুষ্টি পাব এই আশায়।

আপনার পবিত্র চেহারায় হাসি ফুটাতে পারব- এ আশায় আমি তাকে কিনেছি। অন্যথায় আমি আর বেলাল উভয়ে তো আপনারই গোলাম। আপনি আমাকে গোলাম হিসেবে গ্রহণ করুন। আপনার গোলামিতে নাম লেখাতে পারলে আমার মুক্ত জীবনের দরকার নেই। আপনার এই গোলামি হবে আমার জন্য শত সহস্র মুক্ত জীবনের চেয়ে উত্তম। আপনার গোলামির মধ্যেই আমার স্বাধীনতা নিহিত। আপনি এই জগতকে জিন্দা করেছেন আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত হয়ে। সাধারণ মানুষকে আপনি উন্নীত করেছেন আল্লাহর খাস বান্দারূপে। বিশেষত আমার মতো নগণ্য আবু বকর আপনার পরশে খুঁজে পেয়েছে জীবনের প্রকৃত অর্থ।

যৌবনে আমি স্বপ্ন দেখতাম দূর আকাশের সূর্যের থালা আমাকে সালাম জানায় মাটিতে এসে। আমি দেখতাম, সূর্য আমাকে মাটি থেকে তুলে নিয়ে গেছে আকাশের নিলীমায়, একেবারে সূর্যের সমকক্ষ অবস্থানে, সমান্তরালে। ঘুম ভেঙে ভাবতাম, আমি তো মানসিক রোগে আক্রান্ত। অসম্ভব কল্পনা বিলাস আমার মাথায় চেপেছে। মনে মনে বলতাম, এমন স্বপ্ন কোনো দিন বাস্তবে রূপ নিতে পারে না, একেবারে অসম্ভব, অবাস্তব কল্পনা কতক। কিন্তু যখন আপনাকে দেখলাম, মনে হলো স্বয়ং আমার নিজেকেই দেখলাম। আপনি আমার আত্মার রবি, অধ্যাত্মিক জগতের সূর্য। আপনা সাক্ষাতে, আপনার আলোতে আমার অস্তিত্ব আমি আবিষ্কার করেছি। আমি বুঝতে পেরেছি, মানুষ বলতে তার চেহারার জৌলুস, শরীরের গড়ন, দেহের শৌষ্টব, পেশিশক্তির নাম নয়; বরং এর মধ্যে লুকায়িত একটি মানবীয় সত্তার নাম ইনসান, পূর্ণ মানব ইনসানে কামেল, এটিই মানুষের পরিচয়। আপনাকে পেয়ে অসম্ভবকে আমার সম্ভব বলে প্রতীয়মান হয়েছে। আমার প্রাণ ঝাঁপ দিয়েছে রুহের সাগরে। আমি এখন সারাক্ষণ সাতার কাটি রুহের সেই মহাসগরে। তখনই বুঝতে পেরেছি স্বপ্নে দেখা সেই সূর্য আকাশের নয়; আরও ঊর্ধ্বলোকের। সেই সূর্য আপনি, আপনার নুরানি অস্তিত্ব।

 

চোন তোরা দিদম খোদ আই রুহুল ইবাদ

মেহরে ইন খুরশিদ আজ চশমম ফতাদ

আপনাকে যখন দেখেছি হে জগতের প্রাণ

মন থেকে বিদায় দিয়েছে এই সূর্যের আকর্ষণ।

 

আপনি শহরসমূহের প্রাণ, সমগ্র সৃষ্টির প্রাণের স্পন্দন আপনি। আমাদের যে দেহ, তার একটা প্রাণ আছে। যদি এই জগতকে দেহের সঙ্গে তুলনা করি, তার প্রাণ হলেন আপনি। কাজেই আপনাকে যেদিন দেখেছি সেদিন থেকে আকাশের সূর্যের প্রতি মনের আকর্ষণ হারিয়ে ফেলেছি। আপনাকে দেখার ফয়েজে আমার নয়নের জ্যোতি এত উন্নত হয়েছে, ফলে দুনিয়ার চাকচিক্যের প্রতি আমার তাচ্ছিল্য, দুনিয়ার ভোগের প্রতি আমি উদাসীন। আপনার আগমনের আগে দুনিয়ার চাকচিক্যের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করতাম। কিন্তু আপনাকে দেখার পর এসব আকর্ষণ মূল্যহীন আমার চোখে।

হাস্ত ইন নিসবত বে মন মাদহো সানা

হাস্ত ইন নিসবত বে তো কাদহো হেজা

আমার বিবেচনায় এসব আপনার প্রশংসা বন্দনা

আপনার শান-মানের তুলনায় নিন্দা ও সমালোচনা।

যা কিছু বললাম, তাতে আমার দৃষ্টিতে আপনার তারিফ প্রশংসা করেছি। কিন্তু আপনার শানের কথা চিন্তা করলে আমি আপনার কোনো প্রশংসা গুণগান করতে পারিনি; আপনার প্রশংসা করতে গিয়ে নিজের দুর্বলতা অজ্ঞতায় আপনার নিন্দা আর মানহানি করেছি। কারণ, আপনার প্রশংসা, গুণগান ও বৈশিষ্ট্য বর্ণনার সাধ্য আমার নেই। আমি যা কিছু বললাম, মুসা (আ.)-এর সময়ের সরলপ্রাণ রাখালের আল্লাহর প্রশংসা করার মতোই। উদাস রাখাল আপন ভুবনে স্বগতোক্তি করছিল, হে খোদা, তুমি কোথায়? আমি যদি তোমার দেখা পেতাম, প্রাণ দিয়ে তোমার সেবা করতাম। তোমার চুলের কাপড়ের উকুনগুলো বেছে দিতাম। আমার ভেড়ার দুধ দোহন করে তোমাকে খাওয়াতাম। তোমার জুতা জোড়া সিলাই করে দুই পায়ে পরিয়ে দিতাম।

কদহে উ রা হক বে মাদহি বর গেরেফত

গর তো হাম রাহমত কুনি নবুয়াদ শেগেফত

রাখালের তিরষ্কার তিনি নিয়েছিলেন প্রশংসা রূপে

আপন রহমতে আপনি গ্রহণ করলে যাবে না অপাত্রে।

মুসা (আ.)-এর সময় এক ক্লান্ত রাখাল বনের দ্বারে একলা মনে আল্লাহতায়ালাকে উদ্দেশ্য করে বলছিল, হে খোদা, তুমি কোথায়? তোমার জন্য আমার প্রাণ কাঁদে। তোমাকে পেলে আমি খেদমত করতাম। তোমার জামার মাথার উকুন বেছে দিতাম। তোমার ছেড়া জুতায় তালি দিয়ে দুই পাায়ে পরিয়ে দিতাম। আমার ভেড়ার দুধ দোহন করে তোমাকে খাওয়াতাম। সে পথ দিয়ে মুসা (আ.) যাচ্ছিলেন। তিনি আল্লাহর নবী। রাখালের স্বগতোক্তি শুনে বললেন, এসব কী বলছ তুমি। আল্লাহর কি জামা আছে, চুল আছে? পা আছে জুতা পরবে? এসব শিরকি কথা কীভাবে বলছ? মুসা (আ.)-এর মুখে এ কথা শুনে রাখাল হাহুতাশ করতে লাগল, হায় কী বললাম, আমার জীবন তো ধ্বংস হয়ে গেল। রাখাল নিজের বিবেচনায় আল্লাহর প্রশংসা করছিল; কিন্তু অজ্ঞতার কারণে হয়ে গেল আল্লাহর সঙ্গে শিরকের নামান্তর। রাখাল হাহুতাশ করে পালিয়ে গেল নিরুদ্দেশে। মুসা (আ.)-এর কাছে অহি আসল, মুসা আমার রাখাল বান্দাকে কেন আমার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করলে। তার হৃদয় নিংড়ানো কথাগুলোই তো আমার কাছে প্রিয় ছিল।

মুসা (আ.)-এর সময়ের এই রাখালের মতোই আপনার প্রশংসায় আমিও বলেছি অনেক কথা। কাজেই আল্লাহ যেভাবে রাখালের এলোমেলো কথাগুলো গ্রহণ করেছেন, আপনিও আমার অগোছালো উচ্চারণগুলো গ্রহণ করলে ধন্য হব। কারণ, আপনি রাহমতুল্লিল আলামিন, জগতের প্রতি আল্লাহর রহমতের সওগাত।

রহম ফরমা বর কসুরে ফাহমহা

আই ওয়ারায়ে আকলহা ও ওয়াহমহা

দয়া কর আমরা বুঝি না আপনার মর্যাদা রাসুল ওহে

আপনি যে আমাদের চিন্তা ও বোধের অনেক ঊর্ধ্বে।

এসো হে প্রেমিকরা, সুসংবাদ নাও। এসেছেন তিনি এই ধরাধামে ঊর্ধ্বলোক হতে রাসুল হয়ে। এসেছেন সাজাতে এই জ্বরামরা পৃথিবী নতুন সাজে। অসহায় যারা বঞ্চিত মুক্তির সন্ধানী মানুষদের জীবন জাগার গানে জাগ্রত করতে।

 

আবশিরু ইয়া কাওমু ইজ জাআল ফারাজ

ইফরাহু ইয়া কওমু কদ জালাল হারাজ

হে জাতি, জাগো এসেছে দেখ খুশির দিন আজি

দুঃখ যাতনার অবসান হলো, চলো আনন্দে মাতি।

জীবনের গানে চারিদিক মুখরিত। এলো পতিত মানবের মুক্তিদাতা, মানবতার মহান দরদী দিশারী। তার পদার্পণে চারিদিকে মজলুমের ঘরে ঘরে আনন্দের ঈদ। হাবশি বেলালের ঘরেও আজ ঈদের দিন। তার মর্যাদা এখন আকাশকেও হার মানায়। জগতবাসী যে সূর্যের আলো পেতে তৃষিত পাখির মতো আকাশের পানে চেয়ে থাকে, সেই দেদীপ্যমান সূর্য নেমে আলোকিত করে কালো কাফ্রি বেলালের ঘর। সবাই বলে, নবীজি! আপনার একটিবার দয়ার নজরে ধন্য কর আমার জীবন। আর নবীজি বলেন, হে বেলাল এসো স্বস্তি দাও, শান্ত কর আমার তৃষিত অন্তর। আজান দাও, ডাক নামাজের পানে।

জিরে লাব মি গুফতি আজ বিমে আদু

কুরিয়ে উ বর মিনারে রাও বগু

গুনগুন করে বলতে যাহা দুশমনের ভয়ে

শত্রুর মুখে কালি, যাও হাঁক মিনারায় গিয়ে।

হিজরি প্রথম সালে স্বপ্নযোগে আজান বিধিবদ্ধ হওয়ার ইঙ্গিত রয়েছে এই বয়েতে। নবীজি বেলাল (রা.)-কে ডেকে বলেন, তাওহিদ ও রেসালাতের যে ঘোষণা তুমি এতকাল দুশমনের ভয়ে মুখে গুঞ্জরণ করতে, এখন যাও মন খুলে সুউচ্চ কণ্ঠে চারদিক মুখরিত কর সেই আহ্বানে। আজান বিধিবদ্ধ হওয়ার পর নবীজি বেলালকে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজে আজান দেওয়ার দায়িত্ব দেন। তখন মসজিদে নববীতে মিনার ছিল না। বেলাল আজান দিতেন মাটিতে দাঁড়িয়ে অথবা মসজিদের দেয়ালের ওপর উঠে। মসজিদের দেয়ালের উচ্চতা ছিল একজন মানুষের উচ্চতার সমান। মওলানা রুমি সেই উচ্চতাকে মিনারের সঙ্গে তুলনা করেছেন। আজানের সূত্রে মওলানা বলেন, এই আজান দৈনিক পাঁচওয়াক্ত ধ্বনিত হয় মসজিদে। তবে প্রতি মুহূর্তে তা প্রতিধ্বনিত হয় মানুষের হৃদয়ের মিনারে।

মি দামাদ দর গুশে হার গামগিন বশির

খিজ আই মুদবের রহে ইকবাল গির

চিন্তিত মানুষের কানে হরদম হাঁকে সুসংবাদদাতা

উঠো, হে ভাগ্যাহত সৌভাগ্যের পথে করো যাত্রা। (বয়েত : ১১০০)।

অবহেলার ঘুম থেকে জাগ্রত হও। তোমাকে জাগানোর জন্যই যত দুঃখ মুসিবত, পরীক্ষার এত আয়োজন। কাজেই হেদায়ত ও ইবাদতের পথ ধরে আগোয়ান হও। সুসংবাদদাতার কথা শুনো, যারা মনের স্বচ্ছতা নিয়ে মানুষকে আল্লাহর পথে, ন্যায় ও সত্যের পথে আহ্বান করে তাদের ডাকে সাড়া দাও। ওহে যে নফসের জিন্দানে বন্দি, নোংরা আবর্জনা কীটপতঙ্গে ডুবে আছ দিবস রজনি, জেগে ওঠো, তবে নফসের বন্ধন থেকে তোমার মুক্তির সংবাদ যেন কেউ না জানে। তার জন্য নীরবতাই নিরাপদ পথ। সাবধান, গোপন রাখ তোমার আত্মিক রোগমুক্তির সংবাদ। নচেৎ নানা বিপত্তি এসে তোমাকে বিপথগামী করবে। (মওলানা রুমির মসনবি শরিফ, খণ্ড : ৬, বয়েত : ১০৭৫-১১০২)।

(ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী রচিত মসনবি শরিফের গল্প ১-৬ খণ্ড প্রকাশ করেছে ছায়াপথ প্রকাশনী, মসজিদ বায়তুশ শরফ কমপ্লেক্স, ১৪৯/এ, এয়ারপোর্ট রোড, ফার্মগেট, ঢাকা। ফোন ০১৭১১১১৫৮২৯। মসনবির গল্প-ভিত্তিক আলোচনা শুনতে ইউটিউবে ভিজিট করুন- CHAYAPATH PROKASHONI)