মওলানা রুমির মসনবি শরিফ (কিস্তি- ৬/১৫)
ফকিরি জীবন সৌভাগ্যের সিংহাসন
ড. মওলানা মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী
প্রকাশ : ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

যারা অমনোযোগী আত্মবিস্মৃত, দুনিয়া কামাই করা ছাড়া যাদের ধ্যানে-জ্ঞানে আর কিছু নেই, দুনিয়ার পচা ডোবায় পড়ে তারা সুখের স্বপ্ন রচে, জৈবিক কামনা বাসনা, ভোগবিলাসিতাকে মনে করে জীবনের সবচে বড় পাওনা, চরম সাফল্য- এটিই ছিল আগের বয়েতগুলোতে মওলানার যুক্তিতর্কের মূল ব্যঞ্জন।
এখন তিনি বিষয়টি আরও ব্যাখ্যা করছেন একটি কাহিনিকে আশ্রয় করে। বলেছেন, আমি এই কাহিনি নিয়েছি মহান বুজুর্গ শেখ ফরিদ উদ্দীন আত্তার (রহ.)-এর ‘মুসিবতনামা’ কিতাব থেকে। তিনি বলেন, বাদশাহ গাজি সুলতান মাহমুদ গজনবি ভারত অভিযানে গিয়ে গণিমতের অনেক সম্পদ নিয়ে আসেন। তাতে যুদ্ধবন্দি হিসেবে সুলতানের অধিকারে আসে এক সুদর্শন বালক। সুলতান বললেন, এমন বালক বন্দি গোলাম হিসেবে বিবেচিত পারে না। বিশাল উদারতায় তিনি বালকটিকে পালক পুত্রের মর্যাদা দিয়ে ঘোষণা করলেন, এ হবে আমার ভবিষ্যত উত্তরাধিকারী। একদিন বাদশাহর বালককে রাজ সিংহাসনে বসালেন নিজের পাশে। এ কাহিনির বিশদ বিবরণ ‘মুসিবতনামা’য় আছে।
সিংহাসনে বসে বালক হঠাৎ কেঁদে ফেলল। কান্না তার থামে না। বুক ভাসিয়ে কাঁদছে দেখে সুলতান বিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করেন, কী ব্যাপার, কী হলো তোমার! বাবা তুমি কাঁদছ কেন, কিসের শোক তোমার। তুমি আজ কত বড় ভাগ্যবান। অনেক রাজ বাদশাহর চেয়ে উচ্চে আজ তোমার সম্মান। তোমার পাশে বসে আছে একজন শাহানশাহ। এমন তখতে বসে কি তুমি ভাবছ নিজেকে অভাগা। দেখ, কত মন্ত্রী সভাসদ চাঁদ সূর্য তারকার মতো তোমার সামনে খাড়া।
বালক বলল, আমি কাঁদছি কারণ, যে শহরে আমি ছিলাম আমাদের দেশে। আমার মা। সবসময় আমার মা ভয় দেখাতেন আপনার কথা বলে। আমার ওপর কখনো রাগ করলে বলতেন, আল্লাহ না করুন, একদিন তুমি সুলতান মাহমুদের হাতে পাকড়াও হবে। মায়ের মুখ এমন অভিশাপ শুনে বাবা-মাকে তিরস্কার করতেন, তুমি কেমন মহিলা, আমার ছেলেটাকে গালি দেওয়ার জন্য এর চেয়ে খারাপ কথা আর পেলে না। অন্য কোনো গালি কী তোমার মনে আসে না, যা এর চেয়ে নিকৃষ্ট গালি কী তুমি খুঁজে পাও না। তুমি বড় নিষ্ঠুর কঠিন হৃদয়, তুমি চাচ্ছ শত তরবারির সামনে আমার ছেলেটাকে ঠেলে দিতে। মাহমুদের হাতে যদি পড়ে তাহলে তো নিকৃষ্টতম পন্থায় সে আমার ছেলেটার গর্দান নেবে।
যখন আমার মায়ের মুখের গালি আর বাবার ভর্ৎসনা শুনতাম তখন আমার পিলে চমকে যেত। ভয়ে জড়োসড়ো হতাম। দুশ্চিন্তা আমাকে ঘিরে ধরত। ভাবতাম, নিশ্চয়ই দোজখি স্বভাবের কোনো জল্লাদ হবে সুলতান মাহমুদ। যে কারণে হত্যা নির্যাতন নিপীড়নে তার নামে লোকমুখে প্রবাদ চালু হয়েছে। আমি আপনার ভয়ে ভয়ে থাকতাম, জানতাম না আপনার এমন উদারতা মহানুভবতার কথা। আজ কোথায় আমার মা। কোথায় আমার বাবা? তারা থাকলে আমাকে আপনার পাশে মসনদে আসীন অবস্থায় দেখত।
হে সাধক! তোমাকে ভয় দেখানো হয় অন্যায় পথে না গেলে তুমি অর্থ সম্পদ করতে পারবে না। অভাবের ঘানি টানতে হবে। না খেয়ে মরতে হবে। তোমার সম্পদ আছে তারপরও তা ভোগ না করা, কৃচ্ছ্রতার জীবন নিয়ে সাধনার পথ ধরে চলা তোমার চিন্তার বিড়ম্বনা। কিন্তু এই অভাব, সত্য ন্যায়ের ওপর অবিচল থাকার জন্য দরিদ্র্যবরণ, সুযোগ থাকা সত্ত্বেও ভোগ বিলাসিতায় মত্ত না হওয়ার সংযমী জীবন প্রণালী তোমার জন্য সুলতান মাহদুম তুল্য।
সুলতান মাহমুদ সম্পর্কে হিন্দি বালকের মা-বাবা যেভাবে ভয় দেখাত, সেভাবে তোমার নফস, মনের কামনা-বাসনা তোমাকে ভয় দেখাচ্ছে অভাবের। মায়ের মতো মায়ার জাল বুনে তোমাকে বলছে, তোমার সামনে যে অবারিত সুযোগ আছে, ন্যায়-অন্যায় বাচবিছার করতে গিয়ে তা হাতছাড়া করা মানে অজানা মাহমুদের হাতে পড়ে জীবনটা ধ্বংস করা। সুযোগ তো সবসময় আসে না।
শুনো, তুমি যদি জীবনকে স্বার্থক করতে চাও, সত্য ও ন্যায়ের ওপর অবিচল থেকে উভয় জগতের প্রকৃত সাফল্য ও কল্যাণ চাও, তাহলে মাহমুদরূপী ফকিরি জীবনকে আলিঙ্গন করো। কোনো অবস্থাতেই সত্য ও ন্যায়ের পথ থেকে বিচ্যুত হইও না।
গর বেদানি রাহমে ইন মাহমুদে রাদ
খোশ বগুয়ি আকেবাত মাহমুদ বাদ
যদি জান মহান মাহমুদরূপী অভাবের আশীর্বাদ
সানন্দে বলবে, ফকিরির পরিণাম কত চমৎকার।
ওহে ভীতু অভাব হলো তোমার জন্য সুলতান মাহমুদের মতো। তুমি যদি অভাবের শিকার হও, ভোগ করার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও অন্যায় দুর্নীতিকে দূরে ঠেলে দাও, তাহলে ধৈর্য ও সাধনার বলে তোমার কপাল খুলে যাবে। তখন কেয়ামতের দিন তোমার অবস্থা হবে হিন্দি শিশুর মতো যে আনন্দের আতিশয্যে কেঁদে ফেলেছিল। তখন তুমি বলবে, যদি আমি অভাবের শিকার না হতাম, যদি লোভের ফাঁদে পা দিতাম তাহলে জীবনকে সুন্দর করার জন্য চেষ্টা ও সাধনায় নিয়োজিত হতাম না আর জীবনের এত সৌন্দর্য ও সৌভাগ্যের সাক্ষাৎ পেতাম না।
তুমি কি এই সৌভাগ্য ও সৌন্দর্য বলতে দেহচর্চা বা পার্থিব ভোগ বিলাসিতাকে বুঝছ? তোমার এই ধারণা সঠিক নয়। কেননা, তুমি বলতে সেই সত্তা যা তোমার ভেতরে অবস্থান করছে। সেই সত্তা বা তোমার মধ্যকার তোমাকে প্রতিপালন করে দেহ। অনেক সময় মনে হয় দেহের চাহিদাগুলোয় মায়ের মতো আদর মাখানো। কিন্তু গভীরে চিন্তা করলে দেখবে, এই আদর যত্নের মধ্যে থাকে বিষ মেশানো। কারণ, দেহ তোমাকে হরহামেশা ব্যতিব্যস্ত রাখে। দেহ যদি রোগে আক্রান্ত হয় বলে যে, আমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাও, ওষুধ দাও, যত্ন নাও। আর যদি কিছুটা সুস্থ হয় তোমার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। তোমার আত্মিক উন্নতির পথে যেসব কাজ ও বিষয় অন্তরায় হবে সেগুলোর প্রতি লালায়িত হয়ে পড়ে। তোমার দেহকে মনে করো যুদ্ধের জামা বর্ম। শীতকালে গায়ে দিলে প্রচণ্ড শীতে হিম হয়ে যাবে। যদি গ্রীষ্মকালে গায়ে দাও গরমে সিদ্ধ হবে।
দেহের এহেন আপদ থেকে বাঁচার জন্য তোমার সামনে পথ হলো, ধৈর্য ও সাধনা। সৎকাজ করার শক্তি ও সাহসের জন্য যেমন তোমার ধৈর্যের সাধনা থাকতে হবে, তেমনি অন্যায়, দুর্নীতি ও পাপ থেকে বাঁচার জন্যও ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে হবে। অনেক সময় খারাপ বন্ধুর পক্ষ থেকে তোমার ওপর এমন অবস্থা আপতিত হয় যেখানে তোমাকে ধৈর্যের পরাকাষ্ঠা দেখাতে হয়। এই পরিস্থিতিতে ন্যায় নীতির ওপর অবিচল থাকা চরম ধৈর্য ছাড়া সম্ভবপর নয়। তবে দুষ্ট বন্ধুর ষড়যন্ত্রের মোকাবিলায় তুমি যখন ধৈর্যের পরীক্ষা দাও তখন তোমার অন্তর প্রশস্ত হয়। তোমার সম্মুখে সৌভাগ্যের দুয়ার খুলে যায়।
য়ারে বদ নিকুস্ত বাহরে সবর রা
কে গুশায়দ সবর কর্দন সদর রা
ধৈর্যের অনুশীলনের জন্য দুষ্টবন্ধু বড় উপকারী
কারণ তা ধৈর্যের পরীক্ষায় তোমার বক্ষ প্রসারণকারী।
সবরের উপমা আকাশের চাঁদ। রাতের আঁধারের অত্যাচার সয় বলে চাঁদের জোছনায় জগত প্লাবিত হয়। বাগানে গোলাপের হাসি সুবাসিত বিমোহিত করে তোমার মন প্রাণ, গোটা পরিবেশ। কিন্তু দেখ কত কাঁটার ঘা সয়ে ফুল ভুবন মাতানো এমন রূপ পেয়েছে। সবরের উপমা হলো দুধ। পরখ করে দেখ, চতুষ্পদ জন্তুর ওলানে দুধের নহর প্রবাহিত হয় গোবর আর রক্তের ঠিক মাঝখান দিয়ে। ইতিহাস থেকে উদাহরণ নাও।
সবরে জুমলা আম্বিয়া বা মুনকেরান
কর্দেশান খাসসে হক ও সাহেব কেরান
যত নবী রাসুল তাদের বিরুদ্ধে ছিল যত নাফরমান
ধৈর্যের বলে তারা আল্লাহর খাস বান্দা, পেয়েছেন সন্নিধান।
দুনিয়াতে যত নবী রাসুল (আ.) এসেছেন জগতের সবচেয়ে জঘন্য দুষ্ট লোকেরা তাদের বিরুদ্ধাচরণ করেছে। নানারূপ নির্যাতন চালিয়েছে। আল্লাহর নবী-রাসুলগণ কাফির মুশরিকদের এসব নির্যাতনের মোকাবিলায় পরম ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছেন, সত্য ও ন্যায়ের চর্চা করেছেন। এর বিনিময়ে তারা আল্লাহর খাস বান্দার মর্যাদায় উন্নীত হয়েছেন এবং আল্লাহর একান্ত সান্নিধ্যে বরিত হয়েছেন। কাজেই এই ধৈর্যের চর্চা ও অনুশীলনকে তোমার জীবনের সাধনা হিসেবে গ্রহণ কর। নবী-রাসুল শুধৃু নন, পৃথিবীতে যত সৎলোক দেখবে, যাদের চরিত্র আচরণ সুন্দর, চারিদিকে সুনাম তারাও ধৈর্যের পরীক্ষায় পাস হয়েছেন। পক্ষান্তরে যাদের দেখ যে নৈতিকভাবে ছন্নছাড়া, তারা ছিল লোভ মোহের আকর্ষণ বা বিপদের মুখে ধৈর্যহারা। যদি ধৈর্যের পরিচয় দিত আল্লাহর প্রতি গভীর বিশ্বাস নিয়ে জীবনকে সাজানোর সাধনা করত তাহলে সরাসরি আল্লাহর সাথেই হত তাদের বন্ধুত্ব।
তুমি তার সঙ্গেই বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে তোলো যিনি স্বয়ং বন্ধুত্বকে সৃষ্টি করেছেন। যিনি নবী-রাসুলগণের স্বভাব চরিত্রের পরিচর্যা করেছেন। তিনি তো এমন আমানতদার তার কাছে যদি একটি ভেড়ার বাচ্চা আমানত রাখ বিনিময়ে তোমাকে ভেড়ার একটি পাল দিয়ে দিবেন।
যার বিধান হলো, বান্দা একটি সৎকর্ম করলে তার বদলায় তিনি দশগুণ দেন। সাবধান! কখনও নেকড়ের সামনে ভেড়ার বাচ্চা আমানত রেখো না। ইউসুফ (আ.) আর নেকড়েকে যদি একত্রে রাখ তাহলে আমানতে খেয়ানত ছাড়া আর কিছু পাবে না। হে সাধক, তুমি সেই হিন্দি বালকের মতো হও যে মিথ্যা তথ্য ও প্রচারণার কারণে সুলতান মাহমুদকে জঘন্য শত্রু বলে মনে করেছিল। এ অবস্থায় সত্য ও ন্যায়ের ওপর চলতে গিয়ে যদি তুমি অভাবের সম্মুখীন হও নির্ভয়ে বলো, হে অভাব! হে আমার ফকিরি জীবন তুমি হলে আমার জন্য সুলতান মাহমুদ সাবুকতাগীন। (মওলানা রুমির মসনবি শরিফ, খণ্ড : ৬, বয়েত : ১২৯৩-১৪৪৬)।
(ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী রচিত মসনবি শরিফের গল্প ১-৬ খণ্ড প্রকাশ করেছে ছায়াপথ প্রকাশনী, মসজিদ বায়তুশ শরফ কমপ্লেক্স, ১৪৯/এ, এয়ারপোর্ট রোড, ফার্মগেট, ঢাকা। ফোন ০১৭১১১১৫৮২৯। মসনবির গল্পভিত্তিক আলোচনা শুনতে ইউটিউবে ভিজিট করুন- CHAYAPATH PROKASHONI)
