মওলানা রুমির মসনবি শরিফ (কিস্তি- ৬/১৭)

অন্তরকে মেলে ধরো আকাশের পানে

ড. মওলানা মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী

প্রকাশ : ০৪ অক্টোবর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

এক তত্ত্বজ্ঞানী আরেফ কোথাও যাচ্ছিলেন। পথে দেখা হলো এক পাদ্রীর সঙ্গে। পাদ্রীর মুখের দাড়ি তখন ফুলে ফুলে কাশবন। আরেফ পাদ্রীকে জিজ্ঞেস করলেন, বল তো তোমার বয়স বেশি, নাকি তোমার দাড়ির? জীবনীকাররা লিখেছেন, এই কাহিনি কল্পিত নয়; বরং মওলানার জীবনের বাস্তব ঘটনা। পাদ্রী জবাব দিল-

 

গোফত না মন পিশ আজু জায়িদে আম

বি যে রিশি বস জাহান রা দিদে আম

বলল, না আমার জন্ম ওর অনেক আগে

দাড়িহীন বহুকাল গুজরান করেছি জগতে।

আমি বয়সে আমার দাড়ির চেয়ে বড়। শৈশব-কৈশোর পার হলে যৌবনে আমার মুখে দাড়ির সমারোহ এসেছে। দাড়ির জন্মের আগেই জগতের অনেক অভিজ্ঞতা আমার সঞ্চয়ে এসেছে। মওলানা এখানে মানুষের জন্মরহস্যের ব্যবচ্ছেদ করতে চান। মানুষ একবার জন্মায় না। জন্মায় কমপক্ষে চারবার। এক জন্মের পর আরেক জন্মে অতিক্রান্ত হয় জীবনের পূর্ণতার একেকটি ধাপ। ধাপে ধাপে আসে নানা অভিজ্ঞতা, জীবনের সার্থকতা।

প্রথম জন্ম মাতৃগর্ভ থেকে পৃথিবীতে আসার সময়ে। তখন থেকে শুরু হয় জীবন জাগার আবেগের জোয়ার। দ্বিতীয় জন্ম চোখে দেখা যায় না। তবে আবেগের পরিপক্বতায় দ্বিতীয় জন্মের পর তৃতীয় দফা জন্ম শুরু হয়। তখন তার জীবনে আসে যুক্তি ও জ্ঞানের পশরা। যুক্তিবুদ্ধি যখন পরিপক্ব হয় জীবনপ্রবাহে শুরু হয় চতুর্থ জন্মের সমারোহ। সেই জন্ম আধ্যাত্মিকতা, নৈতিক উৎকর্ষতার। কিন্তু অধিকাংশ মানুষের অবস্থা হলো তাদের শৈশবকাল যেন শেষ হয় না। কথা ছিল দৈহিক পূর্ণতার সঙ্গে আবেগি জীবনের অবসান হয়ে একটি ধাপ পার হবে। কিন্তু কিছুতেই তাদের ছেলেমানুষি যায় না। আবেগে তারা পূর্ণ, মন খেলতামাশায় আসক্ত। যুক্তিবুদ্ধির বিচারে দুর্বল আর আত্মিক দিক থেকে দেউলিয়া। বয়স হলেও এসব মানুষের পরিচয় হওয়া উচিত দাড়িওয়ালা শিশু। তাদের দাড়ি পরিপক্ক হয়েছে; অথচ নিজেরা এখনও ছেলেমানুষি গড়াগড়ি দিচ্ছে।

গোফত রিশাত শুদ সপিদ আজ হাল গশ্ত

খুয়ে জেশতে তু নগরদীদাস্ত ওয়াশ্ত

বললেন, তোমার দাড়ি যে সাদা বেহাল অবস্থা

চরিত্রের কদর্যতা বদলে সুন্দর হলো না কেন তা।

তোমার দাড়ি ছিল না, যৌবনে দাড়ি গজিয়ে বার্ধক্যে এখন তুমি বদলে গেছ। তোমার মুখের দিকে তাকালে মনে হবে সাদা কাশবন। কিন্তু আশ্চর্য হলো তুমি নিজে বদলাওনি। জন্মের পর হাঁটিহাঁটি পা পা করে তুমি জীবন পথে এগিয়ে গেছ। এই যাত্রায় মানবিক গুণাবলিতে সজ্জিত হওয়ার কথা ছিল; কিন্তু সেই হিসেবে দাড়ি তোমাকে পেছনে ফেলেছে। তুমি এখনও শৈশবের মতো আবেগ তাড়িত। ভোগ আর আনন্দের নেশায় নিমজ্জিত। শারীরিক জন্মের পর কথা ছিল তোমার আবেগি জন্মের পূর্ণতা হবে। এর দাবিতে অন্য মানুষের প্রতি, সকল সৃষ্টির প্রতি তোমার ভালোবাসা মায়া-মমতা প্রসারিত হবে। উচিত ছিল যুক্তিবুদ্ধির জন্মের পর তুমি ভালো মন্দ পরখ করে চলবে, তোমার চিন্তা ও যুক্তিকে কাজে লাগাবে। কিন্তু তা করনি। তার পরের ধাপে তোমার উচিত ছিল আত্মিক উন্নতির জন্য সাধনা করা। অথচ তুমি এখনও দেহের সেবায় ব্যস্ত। আত্মার উন্নতি সাধনের চিন্তা তোমার সুদূর পরাহত।

তুমি জন্মের সময় যেমন ছিলে তার চেয়ে এক কদমও আগাওনি। তোমার অবস্থা মূসা (আ.)-এর জাতির মতো। দুনিয়ার লোভে আক্রান্ত বনি ইসরায়েলের শাস্তি হয়েছিল তীহ প্রান্তরে উদ্ভান্ত হওয়া। সকালে উঠে পুরো জাতি রওনা দিত তীহ প্রান্তর পার হওয়ার জন্য। সন্ধ্যা হলে দেখত যেখান থেকে যাত্রা করেছিল সেখানেই এসে গেছে। তুমিও যতক্ষণ নিজেকে নিয়ে আত্মভোলা অবস্থা ছেড়ে না দেবে, আমি আমির মত্ততায় বেঁহুশ থাকবে, ততদিন তোমার অবস্থা হবে গো-বাছুর পূজারীর মতো। তোমার আমিত্বই গো-বাছুরের সঙ্গে তুলনীয়। বনি ইসরায়েল ভণ্ড সামেরির প্রতারণার শিকার হয়ে গরুর বাছুরকে খোদায়ি শক্তিতে পূজা করেছিল। ভেবে দেখ, তুমিও তোমার নিজের পূজায় নিশিদিন পার করছ। যতক্ষণ আমিত্বের মূর্তি ছেড়ে এগিয়ে না যাবে ততক্ষণ গোলক ধাঁধাঁয় ঘূরপাক খেতে থাকবে। তীহ প্রান্তর পার হওয়া তোমার নসিব হবে না।

তুমি তো গরুর স্বভাবের। কেবল খাওয়া পরা ভোগ সুখের বাইরে কোনো চিন্তা তোমার নেই। গরুরও সকাল-সন্ধ্যার ভাবনা এই একটাই। তুমি কামনা-বাসনার চারনভূমিতে বিচরণ করছ, নফসের গরুর পেছনে ছুটতে গিয়ে আল্লাহর দেওয়া অসংখ্য অগণিত নেয়ামতের কথা ভুলে গেছ। তোমার শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের কাছে জিজ্ঞাসা কর, ওরা আল্লাহর এসব নেয়ামতের কথা বলে দেবে। কারণ, আল্লাহর নেয়ামত ভোগ করা ছাড়া কোনো অঙ্গ বর্ধিত হয়নি। বিষয়টি তুমি এভাবে বুঝবার চেষ্টা কর। গ্রীষ্মকাল আসে। তখন তুলা উৎপন্ন হয়। গ্রীষ্মকাল চলে যায়, তুলা তোমার সংগ্রহে থেকে যায়। এই তুলা তখন সাক্ষ্য দেয়, গ্রীষ্মকাল এসেছিল। প্রকৃতিকে উত্তাপে ভরে দিয়েছিল। অনুরূপ তোমার দেহের অঙ্গের দিকে তাকাও তোমাকে বলে দেবে আল্লাহর রহমতের ছোঁয়া গায়ে লেগেছিল। শীতকালে চারদিকে সবজির সমারোহ হয়। সেই ফল ফসল আমরা ঘরে তুলি। শীতকাল চলে যাওয়ার পর উৎপন্ন ফসল সাক্ষ্য দেয়, শীতকাল এসে প্রকৃতিকে শীতের চাদরে আবৃত করেছিল। তুমিও শরীরের দিকে তাকাও তোমাকে বলবে, বাইরের চোখে দেখা না গেলেও আমার ওপর রহমত নেয়ামত পরশ বুলিয়েছিল।

আল্লাহর যারা প্রেমিক সাধক আরেফ তাদের দৃষ্টি প্রসারিত থাকে দৃশ্যমান জগতের অন্তরালে বিরাজিত রহমত নেয়ামতের অদৃশ্য প্রবাহের দিকে। বসন্তের মহাসমারোহে তাদের মন জুড়ায়। গাছগাছালি, প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য শোভার অন্তরালে, প্রকৃতির শরীরের ভেতরে বসন্তের যে রুহ বিরাজিত, তার প্রতি তারা মুগ্ধ থাকেন। সেখানেই বসন্তের আসল সৌন্দর্য তারা উপভোগ করেন।

দর জমালে হাল ওয়ামান্দে দাহান

চশম গায়েব গাশতে আজ নকশে জাহান

সে অবস্থার সৌন্দর্য বর্ণনায় তাদের রসনা অক্ষম

ওই জগতের নকশা দেখে চোখে বিস্ময় বিভ্রম।

বিশ্ব প্রকৃতির অন্তরালে যে সৌন্দর্য বিরাজিত, তত্ত্বজ্ঞানীরা প্রতিটি পরতে যেভাবে আল্লাহর তাজাল্লির প্রকাশ অনুভব করেন ভাষায় তার বর্ণনা দিতে তারা অক্ষম। সেই আধ্যাত্মিক আত্মিক অবস্থার মহিমা বর্ণনার ক্ষমতা ভাষার নেই। এই বিশ্ব আর তার বস্তুনিচয়ের অন্তরালে হাকিকতের অবর্ণনীয় রূপের বাহারে তাদের চোখ ভীত বিহ্বল। আধ্যাত্মিকতার যে পাটাতনে হাকিকতের বিচ্ছুরণ হয়, আল্লাহর তাজাল্লির প্রতিফলন যেখানে হয়, সেই পাটাতন দেহের উপাদান চতুষ্টয়ের সমন্বয়ে সৃষ্ট নয়। মাটি পানি আগুন বাতাস নিয়ে মানুষের দেহ গঠিত। এটিই মানব গঠনের প্রাচীন মতবাদ। কিন্তু তোমার ভেতরে যে মানুষটি, যেটি তোমার আসল হাকিকত। সেটি তোমার রুহ। তার সঙ্গে সরাসরি সম্পর্ক আল্লাহর আদেশের।

এখানেই তোমার জীবনের হাকিকত নিহিত। এই হাকিকতের ওপর আধ্যাত্মিক অবস্থা সৃষ্টি হয় আল্লাহর তাজাল্লির বিচ্ছুরণে। মধ্যাহ্ণে সূর্যের দিকে তাকালে সূর্যের শরীর কি তুমি দেখতে পাবে? নিশ্চয়ই না।

আল্লাহর তাজাল্লির বিচ্ছুরণে যে হাকিকতের কথা বলছি, তাও সাধারণ লোকদের দৃষ্টিশক্তির আড়ালে রাখা হয়েছে। এই যে আল্লাহর তাজাল্লির বিচ্ছুরণে আধ্যাত্মিক অবস্থা সৃষ্টির কথা বলছি তাও রূপক হিসেবে। অন্যথায় এই অবস্থার বর্ণনা দেয়া কারও পক্ষে সম্ভব নয়। মওলানা নিজেকে সম্বোধন করে বলছেন, তুমি কথার ফুলঝুরি অনেক করেছ। এখন খামুশ হয়ে যাও। এখানে এসে তুমি তার কাছে নিজেকে মেলে ধর। তাহলে মালিক তোমার সঙ্গে কথা বলবেন। তোমার আমিত্বের প্রতি আসক্তি ছেড়ে তার মধ্যে বিলীন হওয়ার, ধ্যানে জ্ঞানে একমাত্র তাকেই পাওয়ার সাধনায় রত হও। তুমি তখন তার তাজাল্লির ত্যেজে এমনভাবে আলোকিত হবে তোমার চলন-বলন অবস্থাই সাক্ষ্য দেবে তুমি তার প্রেমিক। এ অবস্থায় নিজেকে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করলেও তোমার ভেতরের হাকিকত ফাঁশ হয়ে যাবে।

হার দো গুন হুসনে লতিফে মুরতাজা

শাহেদে আহবাল ও হাশরে মা মজা

উভয় প্রকার সুন্দর কাঙ্ক্ষিত অবয়ব প্রকাশ্যে

সাক্ষী তাদের অবস্থা ও কী ঘটেছে অতীতে।

তত্ত্বজ্ঞানী আরেফদের চলন-বলন উভয় অবস্থায় প্রকাশ হয়ে যায়, তাদের ভেতরে কি আছে আর আল্লাহর তাজাল্লিল প্রতিফলনে তাদের জীবন কীভাবে আলোকিত হয়েছে। তাদের অবস্থা শীতকালের হিমেল প্রবাহের মতো। উতরালি কনকনে হিমেল বায়ু প্রতি মুহূর্তে ঘোষণা করে শীতকাল এসে গেছে। অথবা বসন্তে বা গ্রীষ্মের ফল ফসলের মতো, যা প্রাণ ভরে দেয়, চোখ জুড়ায় আর বলে দেয় সৃষ্টির পরতে পরতে বিরাজিত আল্লাহর দয়ার কথা।

কিসসেয়ে দওরে তাবাস সুমহায়ে শামস

ওয়ান আরুসানে চমন রা লমস ও তামস

সূর্য চুমো এঁকে দেয় বাগানের বধূদের মুখে

প্রেমের পরশে মজে প্রকৃতি মুগ্ধতায় সুখে।

যদি তোমার ওপর আল্লাহর অনুগ্রহ অনুভব করতে না পার, একটি বিষয় চিন্তা কর, দুঃখ-দুশ্চিন্তা যখন তোমাকে ঘিরে ধরে তখন কী তোমার মনে পড়ে না, একটা সময় এমন ছিল যখন এই দুঃখ দুশ্চিন্তা ছিল না। হ্যাঁ, সেটিই তো ছিল আল্লাহর রহমতের প্রকাশ, তোমার জীবনে আল্লাহর তাজাল্লির অতি সূক্ষ্ম সওগাত। কাজেই সর্বাবস্থায় আল্লাহর রহমতের বরিষণে সিক্ত হওয়ার জন্য তোমার অন্তরকে মেলে ধরো আকাশের পানে। (মওলানা রুমির মসনবি শরিফ, খণ্ড : ৬, বয়েত : ১৭৮০-১৮৩৩)।

(ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী রচিত মসনবি শরিফের গল্প ১-৬ খণ্ড প্রকাশ করেছে ছায়াপথ প্রকাশনী, মসজিদ বায়তুশ শরফ কমপ্লেক্স, ১৪৯/এ, এয়ারপোর্ট রোড, ফার্মগেট, ঢাকা। ফোন ০১৭১১১১৫৮২৯। মসনবির গল্পভিত্তিক আলোচনা শুনতে ইউটিউবে ভিজিট করুন- CHAYAPATH PROKASHONI)