মওলানা রুমির মসনবি শরিফ (কিস্তি- ৬/২০)

বাঘের পিঠে আবুল হাসান খারাকানি (রহ.)

ড. মওলানা মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী

প্রকাশ : ২৫ অক্টোবর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

সুদূর তালেকান থেকে প্রাণভরা ভক্তি মহব্বত নিয়ে দরবেশ এসেছেন খারাকানে। বিখ্যাত সুফি ও বুজুর্গ শেখ আবুল হাসান খারাকানির সঙ্গে সাক্ষাৎ করাই উদ্দেশ্য। শেখের বাসায় খোঁজ নিতে গেলে এক ডাইনি বুড়ি অশ্রাব্য ভাষায় আবুল হাসান খারাকানি ও সুফিসাধনার চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করে। স্ত্রী কীভাবে শায়খের বিরুদ্ধে এভাবে বিষোদগার করতে পারে তা চিন্তা করে দরবেশ হতভম্ব হয়ে পড়ে। পরক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়ে তিনি অন্যায় রুখে দাঁড়ান। অনেক হয়েছে থামেন বলে চিৎকার দিয়ে দরবেশ বলল, রাতের দারোগা কোত্থেকে দিনে হাজির হলো। এসব হাঁকাবকা কার বিরুদ্ধে করছেন জানেন? পূর্র্বপশ্চিম যে বুজুর্গের সুনাম সুখ্যাতিতে মুখরিত তার বিরুদ্ধে যা তা বকছেন। আপনি কি মনে করেছেন, আপনার কথায় আমি তার প্রতি বিরোপ হয়ে চলে যাব। মেঘের ভেলায় ভেসে আসিনি যে, নফসের বাতাস তাড়া করলে আকাশ ছেড়ে হাওয়া হয়ে যাব। আল্লাহর এমন একজন প্রিয় বান্দার নির্দয় তিরস্কার করছেন, আধ্যত্মিক মর্যাদায় যিনি ফেরেশতাদেরও ছাড়িয়ে গেছেন। আল্লাহর প্রদীপ নিভানোর জন্যে যে ফুঁ দেয় প্রদীপ তো নিভে না, তার নিজের মুখই পুড়ে যায়। তোমার অবস্থা বাদুরের মতো। দিনের বেলা দেখে না, তাই কামনা করে, এই জগতে সূর্যের অস্তিত্ব না থাকলেই ভালো হতো।

নুহের তুফানে রুহানি শক্তির যে স্ফূরণ হয়েছিল তার শক্তি নুহ (আ.)-এর মহাপ্রলয়ের চেয়ে শতগুণ বেশি ছিল। কিন্তু নুহ (আ.)-এর ছেলে কেনানের চোখে চুল গজানোতে রুহানি শক্তি দেখার সৌভাগ্য তার হয়নি। বাবার আহ্বানের জবাবে বলেছিল, তুফানে আমি তোড়াই পরওয়া করি। আমি ওই উঁচু পাহাড়ে আশ্রয় নেব। পানি আমার কিছুই করতে পারবে না। অথচ চোখের পলকে প্রলয়ের একটি ঢেউ এসে কেনান ও পর্বত উভয়কে তলিয়ে নিল। পূর্ণিমা তিথিতে আকাশে যখন চাঁদের হাট বসে, কুকুর ঘেউ ঘেউ করে, তাতে কি চাঁদের আলো মুখ লুকায়? তুমিও আবুল হাসান খারাকানি, বায়েজিদ বোস্তামি ও মনসুর হাল্লাজের অবস্থা দেখে ঘেউ ঘেউ করছ। তাদের আহ্বানের সারকথা বলছি, মনের কানে শ্রবণ কর।

চোন আনায়ে বান্দা লা শুদ আজ ওয়াজুদ

পস ছে মানদ তো বেয়ান্দিশ আই জাহুদ

বন্দার আমিত্ব যখন লা হয়ে যায় অস্তিত্ব হারিয়ে

তারপর কী থাকে? চিন্তা করে দেখ ভালোভাবে।

ওহে যে হাকিকতকে অস্বীকার কর, জীবন ও জগতের সারসত্যকে মানতে চাও না, তুমি এ কথাটি চিন্তা করে দেখ যে, যখন বান্দার আনানিয়্যত আমিত্ব লা (না) হয়ে যায়, তাহলে অবশিষ্ট কী থাকে? নিশ্চয়ই অপকৃত অস্তিত্ব বিলুপ্ত হলে প্রকৃত অস্তিত্বই বিরাজমান থাকে। কোরআনে যেমন বলা হয়েছে, ‘তোমার প্রতিপালকের সত্তাই অবিনশ্বর থাকবে, যিনি মহিমাময়, মহানুভব।’ (সুরা রহমান : ২৭)।

লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ এর গূঢ়তত্ত্ব খুঁজে নাও এখান থেকে। তুমি যদি জীবনভর চাঁদ বা সূর্যের দিকে থুথু ছিঁটাও তা কি চাঁদ বা সূর্যের গায়ে লাগবে? নাকি তোমার মুখের ওপরই পতিত হবে? নিশ্চিত আল্লাহর পক্ষে সেই থুথু কেয়ামত অবধি তোমার ওপর পতিত হতে থাকবে। সুরা লাহাবে দেখ, নবীজিকে অভিশাপ দেয়ার জবাবে আল্লাহ পাক আবু লাহাবের প্রতি অভিশাপ বর্ষণ করেছেন। কেয়ামত পর্যন্ত যা চলতে থাকবে। আবু লাহাব এমন ইনসানে কামিলের সঙ্গে শত্রুতা দেখাল, যাকে সৃষ্টি করা উদ্দেশ্য না হলে আসমান-জমিন, গ্রহ-তারকা, চাঁদণ্ডসূর্য কিছুই সৃষ্টি হতো না; অথচ আবু লাহাব তার অস্তিত্ব স্বীকার করতে রাজি ছিল না। তোমার অবস্থাও তার চেয়ে ভিন্ন নয়। তুমি আল্লাহর একজন প্রিয় বান্দার সহধর্মিণী হয়েছ, তোমার উদাহরণ ইতিহাস থেকে জানতে পার।

চোন তো নাঙ্গি জুফতে অন মকবুলে রুহ

চোন এয়ালে কাফের আন্দর আকদে নুহ

তুমি কলঙ্ক জুটি হয়েছ পবিত্র রুহের সঙ্গে

কাফের রমণী যেমন ছিলেন নুহের আকদে।

আল্লাহর নবী নুহ (আ.) ও লুত (আ.)-এর সহধর্মিণীরা ছিল তারা দুজনের বিরুদ্ধে, তাদের শত্রুদের দলে। আল্লাহর এ দুজন মহিমান্বিত নবী কেন স্ত্রীদের জ্বালাতন সহ্য করেছিলেন তার রহস্য উন্মোচন করেছেন মওলানা রুমি এখানে। সত্যিই এই প্রশ্ন আমাদেরও অনেকের মনে। আলহামদুলিল্লাহ, মওলানার বর্ণনায় সেই জটিল প্রশ্নের উত্তরটি পাওয়া গেল সহজে। কোরআনে এ দুই নারীর পরিচয় ব্যক্ত হয়েছে এভাবে, ‘আল্লাহ কাফেরদের জন্য নুহের স্ত্রী ও লুতের স্ত্রীর উদাহরণ পেশ করছেন। তারা ছিল আমার বান্দাদের মধ্যে দুই সৎকর্মপরায়ণ বান্দার অধীন। কিন্তু তারা তাদের প্রতি বিশ্বাসঘাতকাতা করেছিল। ফলে তারা (নুহ ও লুত) তাদের আল্লাহর শাস্তি থেকে রক্ষা করতে পারল না এবং তাদের বলা হলো, তোমরা উভয়ে প্রবেশকারীদের সঙ্গে জাহান্নামে প্রবেশ কর।’ (সুরা তাহরিম : ১০)।

শায়খ আবুল হাসান খারাকানির স্ত্রীকে এসব কথা শুনিয়ে আগন্তুক দরবেশ হুমকির সুরে বলল, আজ যদি আপনি মহান অলির ঘরে তার সহধর্মিণী না হতেন, তাহলে আপনাকে হত্যা করে কিসাসের শাস্তি মাথায় নিতাম। আরও কটি কড়া কথা শুনিয়ে দিয়ে দরবেশ চলে গেল শেখ আবুল হাসান খারাকানির ঘর ছেড়ে। যাবার পথে মানুষের কাছে জিজ্ঞাস করে, এ মুহূর্তে শেখ কোথায় থাকতে পারেন? একজন বলল, আমি হজরতকে দেখেছি লাকড়ি আনার জন্য ওই জঙ্গলে গেছেন। দরবেশ সে তো ভক্তি-মহব্বত নিয়ে শেখের সন্ধান করছিল; এ সময় শয়তানও বেকার বসে থাকেনি মনে সন্দেহ প্রক্ষেপণের চিরাচরিত অভ্যাস ছেড়ে। দরবেশের মনে প্রশ্ন জাগে, শেখ এমন একজন নারীকে বাড়িতে রেখেছেন স্ত্রীরূপে। দৈত্য আর জিবরাইল একসঙ্গে চলবে, তা কী করে হতে পারে? হঠাৎ লক্ষ্য করে, দূর থেকে একটি হিংস্র বাঘ আসছে হেলেদুলে। বিরাট লাকড়ির বোঝা বাঘের পিঠে। বোঝার ওপর বসে আছেন শেখ আবুল হাসান খারাকানি নিজে। তার হাতে চাবুক ছিল বিষধর সাপ, সেটি ঘুরাচ্ছিলেন গাধা হাকানোর চাবুকের মতো।

 

শিরে গোররান হিজুমাশ রা মি কশিদ

বর সরে হিজুম নাশিস্তে অন সয়িদ

হুংকাররত ব্যঘ্র পিঠে নিয়ে লাকড়ির বোঝা

চলে হেলেদুলে, বোঝার ওপরে শেখ বসা।

তাজিয়ানাশ মারে নর বুদ আজ শরফ

মার রা বেগরেফতে চোন খরজন বেকফ

চাবুক ছিল তার নর সর্প বিষধর ভয়ঙ্কর

সাপ তার মুঠোয় যেভাবে গাধা হাঁকায়।

মওলানা বলছেন, একমাত্র শেখ আবুল হাসান খারাকানিই কি বাঘের পিঠে সওয়ার হয়েছিলেন। তরিকতের সাধনার যারা প্রকৃত পির তারা প্রত্যেকে ভয়ংকর বাঘের পিঠে সওয়ার হয়েই জীবন চালায়। সেই বাঘ হলো নফসে আম্মারা, যা বনের বাঘের ছেয়েও ভয়ঙ্কর।

তো ইয়াকিন মি দান কে হার শেখি কে হাস্ত

হাম সওয়ারি মি কুনাদ বর শিরে মস্ত

তুমি নিশ্চিত জান, যত শেখ আছেন প্রত্যেকে

হাঁকায় তারা উন্মাতাল বাঘ সওয়ার তার পিঠে।

সাপের চাবুক হাতে বাঘের পিঠে সওয়ার হয়ে শেখ লাকড়ির বোঝা নিয়ে আসছেন, এমন দৃশ্য দেখে মুরিদ আবার ভড়কে গেল। শেখ দূর থেকেই মুরিদের মনের বইটি পড়ে নিল।

বাড়িতে শেখের স্ত্রী কী আচরণে করেছে তা শেখের অন্তরে উদ্ভাসিত হলো। তিনি মুরিদকে লক্ষ্য করে বললেন, ‘ঘরের বাঘিনী আমার পিঠে এ কারণে বনের বাঘ আমাকে পিঠে নিয়ে ঘুরে।’ এই নারীর অত্যাচার নিপীড়ন আমি সহ্য করি, তা নারীর প্রতি জৈবিক আকর্ষণের কারণে নয়। বরং ধৈর্য সহ্যের পরীক্ষা দিয়ে যাই আল্লাহর কথা স্মরণে রেখে।

গর ন সবরম মি কশিদি বারে জন

কেই কেশিদি শিরে নর বিগার মন

আমার ধৈর্য যদি বহন না করত মহিলার বোঝা

ব্যঘ্র কি বেগার খাটত পিঠে নিয়ে আমায় বোঝা।

মজবুত উটের মতো আল্লাহর হুকুম পালনের আমি বোঝা বয়ে যাই। আমার ধ্যানজ্ঞান একমাত্র তিনিই। তার আদেশ পালনে মানুষ কী বলল না বলল তার তোয়াক্কা করি না। আমার স্ত্রীর বোঝা টানি, তার অত্যচার সহ্য করি আমার কামনার কারণে নয়। আমি সমর্পিত আল্লাহর ইচ্ছার কাছে। এই আহম্মক নারী এবং এ ধরনের আরও মানুষের বোঝা বহন করে যাই ধৈর্যের পরীক্ষা দিয়ে। তোমার জন্যও আমার উপদেশ হলো-

তা কশি খন্দান ও খোশ বারে হারাজ

আজ পেয়ে আসসাবরু মিফতাহুল ফারাজ

তুমিও বহন করবে দুঃখের বোঝা হাসিমুখে

সবর সাফল্যের চাবি, এ কথায় বিশ্বাস রেখে।

চোন বেসাজি বা খসিইয়ে ইন খাসান

গরদি আন্দর নুরে সুন্নাতহা রসান

যদি সয়ে যাও মন্দ লোকদের মন্দ আচরণ

নবীগণের সুন্নতের নুরের জগতে পাবে আমন্ত্রণ।

কাম্বিয়া রঞ্জে খসান বস দিদে আন্দ

আয চুনিন মারান বসি পিচিদে আন্দ

কারণ মন্দদের বহু যন্ত্রণা সয়েছেন নবী রাসুলরা

এসব সাপের ছোবল সয়েও হননি তারা ধৈর্যহারা।

(মওলানা রুমির মসনবি শরিফ, খণ্ড : ৬, বয়েত : ২০৬৮-২১৫২)।

(ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী রচিত মসনবি শরিফের গল্প ১-৬ খণ্ড প্রকাশ করেছে ছায়াপথ প্রকাশনী, মসজিদ বায়তুশ শরফ কমপ্লেক্স, ১৪৯/এ, এয়ারপোর্ট রোড, ফার্মগেট, ঢাকা। ফোন ০১৭১১১১৫৮২৯। মসনবির গল্পভিত্তিক আলোচনা শুনতে ইউটিউবে ভিজিট করুন- CHAYAPATH PROKASHONI)