মওলানা রুমির মসনবি শরিফ (কিস্তি- ৬/২২)
ইঁদুর ও ব্যাঙের বন্ধুতে আধ্যাত্মিক সংলাপ
ড. মওলানা মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী
প্রকাশ : ০৮ নভেম্বর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

একদিন এক ইঁদুর বেড়াতে গেল একটি জলাশয়ের ধারে। দেখে একটি ব্যাঙ মনের আনন্দে সাঁতার কাটছে জলাশয়ে। শুভ সাক্ষাতে উভয়ের মাঝে মন দেওয়া-নেওয়ার একটি ব্যাপার ঘটে যায়। কথা হলো উভয়ে জলাশয়ের ধারে এসে মনের কথা খুলে বলবে পরস্পরের সঙ্গে। উভয়ের ভাষা এক না হলেও মনের মিল হওয়াতে ভাষা তাদের বন্ধুত্বে বাধা হলো না। দেখা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের মনের দুয়ার খুলে যায়, শুরু হয় বহুদিনের না বলা কথার সাতকাহন।
হ্যাঁ, যেখানে মনের মিল সেখানে ভাষা আদৌ সমস্যা নয়। মনের মানুষ পেয়ে গেলে মনের দুয়ার খুলে যায়। কিন্তু মনের মানুষ না হলে যত পরিচয়, ভাষার মিল থাকুক, মনের দুয়ার খুলে না। কথা বলে গোমরা মুখে হিসেব-নিকেশ করে। আচ্ছা বলুন, বুলবুল যখন ফুলের দর্শন পেয়ে যায় তখন কী তার পক্ষে খামুশ থাকা সম্ভব হয়?
মুসা (আ.) ভুনামাছ নিয়ে রওনা হয়েছিলেন খিজির (আ.)-এর সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে। দীর্ঘ পথ চলে ক্লান্ত মুসা ও তার সাথি যাত্রাবিরতি করেন সাগরসঙ্গম স্থলে সটান পাথরের ধারে। পরক্ষণে রওনা হয়ে যখন ক্ষুধার্ত মুসা নবী (আ.) বালকের কাছে ভুনা মাছের খাবার চান, বালক ইউশা জবাব দেন, যেখানে আমরা যাত্রাবিরতি করেছিলাম সেখানেই ভুনা মাছটি জ্যান্ত হয়ে সাগরে নেমে যায়। কিন্তু এ ঘটনার কথা আপনাকে তখন বলতে শয়তান আমাকে ভুলিয়ে দিয়েছিল। কোরআন মাজিদের সুরা কাহাফের ৬১-৬৩ নম্বর আয়াতে দীর্ঘ ঘটনার বর্ণনায় মওলানা রুমি ভুনামাছ জ্যান্ত হওয়ার রহস্য উদ্ঘাটন করে বলেন, যাত্রাবিরতির স্থানেই ছিল কাঙ্ক্ষিত খিজির (আ.)-এর অবস্থান। খিজির যেহেতু চিরসবুজের প্রতীক, প্রাণসঞ্জীবনী শক্তি ছিল তার কাছে সেহেতু ভুনামাছ তার সাহচর্যে আসার সঙ্গে সঙ্গে প্রাণ ফিরে পেয়েছিল, জ্যান্ত হয়ে সাগরে পাড়ি দিয়েছিল।
হ্যাঁ, বন্ধু যখন বন্ধুর সনে একান্তে সন্নিধানে মিলিত হয়, তখন মৃতপ্রাণ জীবনপ্রাপ্ত হয়। হাজারো না বলা কথা সামনে উদ্ভাসিত হয়। বন্ধুর কপাল যেন সাধকের সামনে লওহে মাহফুজ। কারণ, আল্লাহর অলির চিন্তা ও মনের গহিনে থাকে সত্যের সন্ধানীদের জন্য অজানা রহস্য। তাই সত্যিকার আল্লাহর পথের বন্ধু সাধকের জন্য পথের দিশারী। তাকে দেখে দেখে পথ খুঁজে পায় সত্যের অনুসারী। এ জন্য নবীজি (সা) বলেছেন, আসহাবি কান্নুজুম ( আমার সাহাবিরা নক্ষত্রের মতো)।
নাজম আন্দর রিগ ও দরয়া রাহনোমাস্ত
চশম আন্দর নজম নেহ কু মুকতদাস্ত
আকাশের নক্ষত্র মরুভূমে ও সাগরে দিশারী
নক্ষত্র পানে দৃষ্টি রেখে চলো, তা যে কাণ্ডারি।
চশম রা বা রুয়ে উ মি দার জোফত
গার্দ মাঙ্গিজান জে রাহে বাহস ও গোফত
স্থির রাখ দুনয়ন নক্ষত্রের যেথা গতিপথ
তর্ক বহাসের কুণ্ডলীতে হারিয়ো না পথ।
নবী রাসুল (আ.), সাহাবায়ে কেরাম, আউলিয়াগণ আকাশের নক্ষত্রের সঙ্গে তুল্য। তুমি মরুভূমির পথ পাড়ি দিতে চাও অথবা অনন্ত সাগরের বুক চিরে দূরদেশে সফরে যেতে চাও, আকাশের নক্ষত্রের দিকে চেয়ে চেয়ে পথ চল। তাহলে পথ হারাবে না। আর যদি নক্ষত্রকে বিবেচনায় না নিয়ে তর্ক বাহাসে জড়িয়ে দিক নির্ণয় করতে চাও আর জ্ঞানের গরিমায় সে পথ ধরে চলতে চাও তাহলে তুমি পথ হারাবে। সত্য-মিথ্যার ফারাক তুমি করতে পারবে না। কাজেই জীবনের দুর্গম পথ পাড়ি দিতে তোমার জন্য আধ্যাত্মিক দিশারী, দূর সফরের কাণ্ডারি নকিব থাকা চাই। এই নকিব হবেন ওহীর আলোতে উদ্ভাসিত। ওহীর উৎসের সঙ্গে তার জীবন হবে সম্পৃক্ত। তার ধ্যানে-জ্ঞানে শুধু তিনিই বিরাজ করবেন। তখনই তার কাছে উদ্ভাসিত হবে অনন্ত জ্ঞান।
আদম (আ.)-এর উদাহরণ তোমার সামনে আন। তার জীবন ছিল আল্লাহর সঙ্গে বন্ধুত্বের রশীতে বাঁধা। এ কারণে তার হৃদয়ে উদ্ভাসিত হয়েছিল অহির অনন্ত জ্ঞানভাণ্ডার। সুরা বাকারার ৩১ নং আয়াতের ভাষ্য অনুসারে আদম (আ.) সমস্ত কিছুর নামণ্ডপরিচয় জ্ঞাত হন আল্লাহর দেওয়া জ্ঞানের গুণে।
নামে হার চিজি চুনানকে হাস্ত আন
আজ সহিফায় দিল রওয়ি গাশতাশ জবান
সবকিছুর নাম যেভাবে আছে হাকিকতে
উদ্ভাসিত হয়ে যায় তার দিলের আরশিতে।
এর মূলে ছিল মহান প্রভুর সঙ্গে সম্পর্কের ফয়েজধারা। নুহ (আ.)-এর জীবনেও দেখা যায়, তিনি দীর্ঘ ৯০০ বছর আল্লাহর পথে মানুষকে আহ্বান করেন জ্ঞান, প্রজ্ঞা, হিকমত ও সদুপদেশ দিয়ে। অথচ তিনি কোনো মক্তবে লেখাপড়া করেননি; তার লেখাপড়া ছিল আল্লাহর সন্নিধানে। তাই তার জ্ঞানে কোনো ত্রুটি ছিল না। জ্ঞান ও প্রজ্ঞায় উদ্ভাসিত ছিল তার প্রতিটি উচ্চারণ। আদম (আ.) ও নুহ (আ.)-এর উদাহরণ তো পরিণত বয়সের নবী-রাসুলগণের জীবনের বাস্তবতা। মায়ের কোলের শিশুও যে আল্লাহর সান্নিধ্যের ছোঁয়া পেলে দুনিয়ার জ্ঞানী মনীষীদের হার মানাতে পারে তার উদাহরণ ইসা (আ.)-এর জীবন। তিনি মায়ের কোলে দোলনায় জ্ঞানীর মতো মায়ের সতিত্ব আর নিজের নবুওতের সাক্ষ্য দিয়েছিলেন অকপটে। (সুরা মরিয়ম : ২৯-৩৩)।
মহান আল্লাহর সঙ্গে সংযোগ হলে এভাবে অসাধ্য সাধন করার ভুরিভুরি উদাহরণ আছে নবী-রাসুল, পুণ্যবানদের জীবনে। তাই তুমি সেই সংযোগের তার তোমার দিলের সঙ্গে স্থাপন করার সাধনা কর। তুমি মানুষ তাই তোমার জন্য এ কাজ অনেক সহজ। সটান পর্বতও যখন সেই সংযোগ পেয়েছিল দাউদ (আ.)-এর কণ্ঠে তাল-লয়ের লহরি সৃষ্টি হয়েছিল সুরের মূর্ছনায়। পর্বতকে সম্বোধন করে আল্লাহ বলেছিলেন, হে পাহাড়, তুমি দাউদের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলাও। ‘নিশ্চয়ই আমি দাউদের প্রতি অনুগ্রহ করেছিলাম এবং আদেশ করেছিলাম, হে পর্বতমালা! তোমরা দাউদের সঙ্গে আমার পবিত্রতা ঘোষণা কর এবং পক্ষীকুলকেও; তার জন্য নমনীয় করেছিলাম লোহা।’ (সুরা সাবা : ১০)। তখন শুধু পর্বত কেন বনের পাখিরা দলে দলে দাউদ (আ.)-এর কণ্ঠস্বর শুনতে আকুল হয়ে থাকত। কঠিন লোহাও তার হাতের নির্দেশ পালন করতে মোমের মতো নরম হয়ে যেত। দেখ, যে বাতাস আদ জাতিকে নাস্তনাবুদ করেছিল সে বাতাস সুলায়মান (আ.)-এর অনুগত হয়ে সকাল-সন্ধ্যা তার বিশাল সিংহাসন পৃথিবীর এ প্রান্ত হতে ওপ্রান্তে বয়ে বেড়াত। এসব রহস্যের অন্ত নেই, এসো তাই গল্পের ধারায় ফিরে যাই।
ইঁদুর প্রস্তাব দিল, দেখ বন্ধু! আমার মনের কথা খুলে বলতে যখন তোমার কাছে আসি, দেখি জলকেলিতে তুমি ব্যস্ত মস্ত, আমি কী তখন তোমার কাছে যেতে পারি। কারণ, আমার বিচরণ ডাঙায়। পানিতে সাঁতরানোর অধিকার আমার নেই। জলাশয়ের পাড়ে এসে যতই ডাকাডাকি করি, আমার প্রেমের আহ্বান তোমার কানে পশে না, কি করি। কাজেই তোমার সঙ্গে সাক্ষাতের সময় নির্দিষ্ট করতে চাই।
মওলানার চিন্তা এখানে আবারো চলে গেল গল্পের ধারাভাষ্য ছেড়ে মহান মওলার দরবারে।
পাঞ্জওয়াক্ত আমদ নামাজ ও রাহনমুন
আশেকান রা ফি সালাতিন দায়েমুন
পাঁচওয়াক্ত নামাজ এসেছে পথ দেখাতে তাঁর
তবে সারাক্ষণ নামাজে প্রেমিকদের অভিসার।
আল্লাহর দিকে পথ দেখাতে, আল্লাহর সন্নিধানে নিয়ে যেতে দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের বিধান দেওয়া হয়েছে। কিন্তু যারা প্রেমিক তারা এই পাঁচ ওয়াক্তে আল্লাহর সান্নিধ্যে হাজিরা দিয়ে সন্তুষ্ট হতে পারে না। তাদের নামাজ হয় সার্বক্ষণিক, দায়েমি। আল্লাহ বলেন, ‘তবে নামাজ আদায়কারী ছাড়া, যারা তাদের নামাজে সদা প্রতিষ্ঠিত।’ (সুরা মাআরিজ : ২৩)। দায়েমি বা স্থায়ী নামাজ বিষয়ে মুফাসসিরগণের অভিমত, যারা নামাজ আদায়ের ব্যাপারে সদা যত্নবান থাকেন। যারা নামাজের কথা ভুলে নফসানি বিষয়াদি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন না। হাদিস শরিফেও বর্ণিত, ‘সবচে উত্তম আমল হচ্ছে যা স্থায়ীভাবে করা হয়, পরিমাণগত দিক দিয়ে তা ক্ষুদ্র হলেও।’ তবে এখানে মওলানা রুমি (রহ.) দায়েমি নামাজ বলতে ধ্যানে-জ্ঞানে সর্বক্ষণ আল্লাহকে স্মরণ করার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। আল্লাহর সঙ্গে সার্বক্ষণিক সংযোগের মর্মবাণীও তাই। মওলানা ব্যাখ্যা করে বলেন, হাদিস শরিফে বিরতি দিয়ে বন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাতের উপদেশ দিয়ে বলা হয়েছে, তাতে বন্ধুত্ব গভীর হবে। কিন্তু এ নিয়ম সাধারণ লোকদের জন্য। যারা আশেক তাদের কাছে তো সকাল-সন্ধ্যা নেই। এখানে সম্পর্ক আশেক মাশুকের। রাত ও দিন যেমন একটিকে অপরটি খুঁজে বেড়ায়, আশেক মাশুকও পরস্পরকে সর্বক্ষণ কাছে পেতে চায়। ইঁদুর এই রহস্যটি বেঙের কাছে ব্যক্ত করল মনের আবেগ জড়িয়ে। বলল, যেভাবেই হোক আমরা দুজন দুজনার সঙ্গে সাক্ষাতের দিনক্ষণ চাই। (মওলানা রুমির মসনবি শরিফ, খণ্ড : ৬, বয়েত : ২৬৩২-২৬৮৭)
(ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী রচিত মসনবি শরিফের গল্প ১-৬ খণ্ড প্রকাশ করেছে ছায়াপথ প্রকাশনী, মসজিদ বায়তুশ শরফ কমপ্লেক্স, ১৪৯/এ, এয়ারপোর্ট রোড, ফার্মগেট, ঢাকা। ফোন ০১৭১১১১৫৮২৯। মসনবির গল্পভিত্তিক আলোচনা শুনতে ইউটিউবে ভিজিট করুন- CHAYAPATH PROKASHONI)
