মওলানা রুমির মসনবি শরিফ (কিস্তি- ৬/২৬)
মানিক হারানো জলগরুর করুণ দশা
ড. মওলানা মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী
প্রকাশ : ০৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

রূপকথার জলগরু। গভীর সমুদ্রে বসবাস। তবে আহার করে রাতের বেলা ডাঙায় উঠে। বাগানের সুগন্ধ ফুল, গোলাপ চামেলি, জবা ও পারুলের ঘাস তার প্রিয় খাবার। ফলে তার চর্বি থেকে তৈরি হয় মহামূল্যবান মেশক আম্বর। হ্যাঁ, যার আহার হয় আল্লাহর তাজাল্লির নুর- তার মুখ থেকে কেন নির্গত হবে না প্রাণস্পর্শী ভাব ও কথার তরঙ্গমালা। তার কাছে আসমান থেকে অনুপ্রেরণা আসে, যেভাবে অনুপ্রেরণা, নির্দেশনা আসে মৌমাছির কাছে। মৌমাছি মৌচাকে মধু আহরণ করে তার পেছনে উদ্দীপক থাকে আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরণা, কোরআনে যার নাম দেয়া হয়েছে ওহি বা প্রত্যাদেশ। এরশাদ হয়েছে, ‘তোমার প্রতিপালক মৌমাছিকে তার অহি দ্বারা নির্দেশ দিয়েছেন, গৃহ নির্মাণ কর পাহাড়ে, বৃক্ষে ও মানুষ যে গৃহ নির্মাণ করে তাতে। এরপর প্রত্যেক ফল থেকে কিছু কিছু আহার কর, অতঃপর তোমার প্রতিপালকের সহজ পথ অনুসরণ কর। এর উদর থেকে নির্গত হয় বিবিধ বর্ণের পানীয়; যাতে মানুষের জন্য রয়েছে আরোগ্য। অবশ্যই তাতে চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্য নিদর্শন রয়েছে।’ (সুরা নাহল : ৬৮-৬৯)।
এই আয়াতে মৌমাছির অন্তরে মৌচাক নির্মাণ ও মধু আহরণের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরণাকে বলা হয়েছে অহি। ইসলামিক ফাউন্ডেশন অনুবাদ করেছে ‘অন্তরে ইঙ্গিত দ্বারা নির্দেশ’। এই নির্দেশ যদি মৌমাছির কাছে আসতে পারে নবী রাসুল না হয়েও এমন আধ্যাত্মিক প্রেরণা পবিত্র অন্তরের লোকদের কাছে আসা সম্ভবপর। মওলানার স্পষ্ট কথা, মধুমক্ষীকা যেই প্রেরণায় মৌচাকে মধুভান্ডার জমা করে যদি আল্লাহর পক্ষ থেকে কারও অন্তরে তেমন প্রেরণা ও প্রজ্ঞার প্রস্রবণ জারি হয় তাহলে অবশ্যই হাকিকতের রহস্যকথা তিনি ব্যক্ত করতে পারবেন। তার কাছেও উর্ধ্বজগতের মধুভান্ডার পাওয়া যাবে।
ফিরে আসি জলগরুর কাহিনিতে। গভীর জলের এই প্রাণী রাতের আঁধারে আহার করতে বাতি নিয়ে আসে সাগর হতে। সাগরতলের একটি মণিরত্ন মুখে নিয়ে ডাঙ্গায় আসে। রত্নমানিকটি চারণভূমিতে এক জায়গায় রাখে। তারপর মানিকের আলো যতদূর ছড়িয়ে পড়ে তার আওতাকে বেছে নেয় চারণভূমিরূপে। মানিকের জ্যোতির জোসানায় চারণভূমির যতখানি আলোকিত হয়, সে আলোর বলয়ে চরতে থাকে সাগরগাভী।
মণিরত্নের শিকারি ব্যবসায়ী ওঁতপেতে থাকে এক ফাঁকে মানিকটি চুরি করার জন্য। গরু যখন চরতে চরতে দূরে চলে যায়, তখনি রত্নশিকারি ব্যবসায়ী ছুটে এসে কাদামাটি ঢেকে দেয় মানিকের ওপর। তখনই চারিদিক আঁধারে ছেয়ে যায়। গরু দেখে, হায়! তার রত্নের জ্যোতি জোসনা হারিয়ে গেল কোথায়। বুঝতে পারে, কোনো শত্রু শিকারি জহুরি ছিনতাই করে নিয়েছে তার প্রাণতুল্য রত্ন। তখন মাঠের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে ছুটতে থাকে পাগলা ঘোড়ার মতো। উদ্ধত ফনা তোলা সাপের মতো মাঠ তোলপাড় করে রত্নব্যবসায়ীকে আঘাত করার জন্য। কিন্তু ততক্ষণে ব্যবসায়ী গাছে উঠে লুকিয়ে থাকে ডালপালার ঝোপে। শত্রু খুঁজে যখন নিরাশ হয়ে যায় জলগর, ক্লান্ত দেহে তখন ফিরে এসে খোঁজে রত্নামানিক কোথায় রেখেছিল। কাছে এসে দেখে কাদামাটিতে ঢাকা তার অমূল্য রতন। সেই রত্নকে ছেড়ে তখন পালিয়ে যায় ইবলিসের মতন।
বর্ণিত আছে, আদমের কায়া যখন সৃষ্টি করা হয়, ইবলিস কয়েকবার ভেতরে প্রবেশ করে এফোড়-ওফোড় করল। বলল, আদম কাদামাটি আর অস্থির কায়া ছাড়া আর কিছু নয়। তখন আদমকে ঘৃণাভরে বর্জন করে চলে গেল। ফেরেশতাদের সামনে যখন আল্লাহ পাক আদম (আ.)-এর শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের আনুষ্ঠান করেন তখনও ইবলিস আদমকে চিনতে একই ভুল করে। বলে আদম মাটির তৈরি, তার গতি নিম্নমুখী আর আমি আগুনের তৈরি। আগুনের স্বভাব উর্ধ্বমুখী। কাজেই আগুন মাটির চেয়ে শ্রেষ্ঠ। এই যুক্তিতে আমার মর্যাদা আদমের ওপর প্রমাণিত। কাজেই আমি আদমকে সিজদা করতে পারি না কোনো অবস্থাতে। এর মূল কারণ ছিল, ইবলিসের অন্তর ছিল বস্তুবাদী, মোহমায়া, অহংকারের আঁধিয়ারায় আচ্ছন্ন, দেহের বাইরে তার দৃষ্টিশক্তি ছিল অগম্য। ফলে আদমের অন্তরে গচ্ছিত রূহের মানিক সে চিনতে পারেনি।
কান বিলিস আজ মতনে তিন কুর ও কর আস্ত
গাও কেই দানদ কে দর গেল গওহার আস্ত
ইবলিস ছিল মাটির ভেতরে গচ্ছিত রত্ন সম্বন্ধে অন্ধ
গরু কী বুঝবে কাদার ভেতরে কোন রত্ন লুকানো।
শয়তানের দৃষ্টিশক্তি বস্তুতান্ত্রিকতায় অহমিকায় অন্ধ। সে দেখতে পায়নি আদামের অন্তরে গচ্ছিত রুহের রত্ন। শয়তানের মতো নফসের দাস শয়তানি চরিত্রের লোকেরাও মানুষের অভ্যন্তরে লুকানো রুহের মনিরত্নের মাহাত্ম্য বুঝতে অক্ষম। যেমন জলগরুও বুঝতে পারল না কাদামাটির ভেতরে চাপা পড়া তার প্রাণতুল্য মানিকের অস্তিত্ব। হ্যাঁ, কাদামাটির নিচে যেভাবে জলগরুর মণিরত্ন চাপা পড়েছিল, সেভাবে মানব দেহের কায়ায় গচ্ছিত রয়েছে আল্লাহর তরফে জ্যোতির্ময় রুহ। রুহের আদিবাস ছিল পবিত্র জগতের আত্মার জলসায়, কিন্তু এখানে দুনিয়ার মাটিতে রজতরক্তে মিশ্রিত। নফসের কামনা বাসনা, ক্ষমতাণ্ডপ্রতিপত্তির লোভ, অর্থের লিপ্সা, যৌন উন্মাদনা, বুজুর্গি বিক্রির অহমিকা, অন্যের অধিকার লঙ্ঘনের প্রতিযোগিতা নারীদেরর রক্তস্রাবের সঙ্গে তুলনীয়। এ সময় নামাজ জায়েজ নয়।
বেহেশতে আল্লাহর নিষিদ্ধ বৃক্ষের ফল ভক্ষণ করলে যখন আল্লাহ আদমণ্ডহাওয়াকে পৃথিবীতে নেমে আসার নির্দেশ দেন তখন বলেন, ‘তোমরা নেমে যাও’। তখন পবিত্র জগতের রুহ নেমে আসে কামনা-বাসনা, লোভ-অহংকার মিশ্রিত দেহের কায়ায়। রুহের সেই রত্ন এখন মাটিতে চাপ পড়েছে স্বার্থ শিকারি ইবলিসের কারসাজিতে। যারা গরু স্বভাবের, দুনিয়াতে শুধু খাওয়া-নাওয়ার পেছনে ভোগের রাজ্যে হাবুডুবু খায়, তারা খুঁজে পায় না রুহের রত্ন কোথায়। দিব্যদৃষ্টির অভাবে দেখে না কোথায় মহামূল্যবান মানিক লুকিয়ে গেল মাটির নিচে। তবে,
তাজেরাশ দানদ ওয়ালেকিন গাও নাই
আহলে দিল দানদ ও হার গেলকাও নাই
মণিরত্নের ব্যবসায়ী জানে রত্নের মূল্য, গরু নয়
জানে অন্তরওয়ালা, কাদাদুর্গন্ধের মাটিয়াল নয়।
হীরা জহরত, মনিরত্নের ব্যবসায়ী জহুরি রত্নের মূল্য ঠিকই চেনে। রাজা-বাদশাহরাও বুঝে সামান্য রত্নে লুকিয়ে আছে কত রাজা বাদশাহর ধন। এ জন্যই বলা হয়েছে, ‘ওয়ালিরাই জানে কার হৃদয়ে আল্লাহ প্রেমের বাতি জ্বলে।’ মোবাইলের সিম নষ্ট হলে সবকিছু অচল হওয়ার কথা আমরা এখন বুঝি। কিন্তু মোবাইল কম্পিউটারের অভিজ্ঞতা যাদের নেই তাদের পক্ষে কি বুঝা সম্ভব সিমের মূল্য কিসে।
যারা আধ্যাত্নিক পথের অভিসারী, রুহানি উন্নতির চিন্তায় বিভোর, তাদের কাছে রুহই জীবনের মহামূল্যবান রত্নমানিক। সে মানিকের আলোক জ্বেলে তারা বিচরণ করেন রুহানিয়তের চারণভূমিতে। কিন্তু গরু- যারা গরু স্বভাবের, যাদের চিন্তা ও জীবন সংগ্রামের একমাত্র লক্ষ্য গরু বা পশুর মতো, যাদের চিন্তা উদরপূর্তি আর যৌনতার উর্ধ্বে যায় না, যারা কাদাদুর্গন্ধ হাতড়ানো মাটিয়াল, তারা দুনিয়ার কাদা নর্দমায় হাবুডুবু খাওয়া কীট। তারা শুধু দেহ চেনে। দৈহিক, জাগতিক উন্নতির মাপকাঠিতে সবকিছু বিচার করে, তারা মানুষের অভ্যন্তরে কী রত্নমানিক লুকিয়ে রাখা হয়েছে, রূহের শক্তি বলতে কী, তার গুরুত্ব বুঝতে অপারগ।
হে ভাই, তোমার গুরুত্ব, তোমার অস্তিত্বের মূল রহস্য তোমার মধ্যে গচ্ছিত রুহের মানিক। কাদামাটির এই দেহ ও ভোগের আয়োজন তোমার মূল্যমানের মাপকাঠি নয়।
কাজেই সাধনা কর, যাতে তোমার রুহের মানিককে পূর্ণমাত্রায় জ্বালাতে পার। খবরদার! তোমার অবস্থা যেন জলগরুর মতো না হয়, যে তার প্রাণতুল্য মানিক হারিয়ে প্রথমে উন্মাদ হয়ে শত্রুকে খুঁজছিল; কিন্তু পরক্ষণে তার সামনে দুনিয়া অন্ধকার হয়ে গেল। মানিক খোঁজতে এসে দেখল কাদামাটিতে চাপা পড়ে আছে। কাদামাটি সরিয়ে রুহকে মুক্ত করার চিন্তা তার মাথায় আসেনি। কাদামাটির সঙ্গে মাখামাখি, দেহের চর্চা যেন তোমাকে তোমার রূহের মানিক সম্পর্কে বেভুল, গাফিল না করে, সাবধান! (মওলানা রুমির মসনবি শরিফ, খণ্ড : ৬, বয়েত : ২৯২২-২৯৪০)
(ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী রচিত মসনবি শরিফের গল্প ১-৬ খণ্ড প্রকাশ করেছে ছায়াপথ প্রকাশনী, মসজিদ বায়তুশ শরফ কমপ্লেক্স, ১৪৯/এ, এয়ারপোর্ট রোড, ফার্মগেট, ঢাকা। ফোন ০১৭১১১১৫৮২৯। মসনবির গল্পভিত্তিক আলোচনা শুনতে ইউটিউবে ভিজিট করুন- CHAYAPATH PROKASHONI)
