মাতৃভাষার লালন ও বিকাশের মাধ্যমেই জীবনের উন্নয়ন সম্ভব
প্রকাশ : ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী

আজ থেকে ১১৫ বছর আগের কথা। মাসিক ‘ইসলাম প্রচারক’ নামের একটি কাগজে মাতৃভাষার গুরুত্ব ও তাৎপর্য সম্পর্কে একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। প্রবন্ধে বলা হয়- ‘হে আমার মুসলমান ভ্রাতা! আমরা যদি মাতৃভাষায় অল্পস্বল্প জ্ঞানও অর্জন করিতাম তাহা হইলে আজ আমাদের অবস্থান অনেক উপরে থাকিত। আমাদের উপর হিন্দু মহাজনরা জমিদারি খাটাইতে পারিত না। মাতৃভাষার জ্ঞান থাকিলে আমরাই জমিদারি করিতাম অথবা কোনো সরকারি চাকুরী করিতাম। আফসোস! মাতৃভাষার গুরুত্ব অনুধাবনে আমরা চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ হইয়াছি।’ প্রবন্ধটি শেষ হয়েছে এভাবে- ‘মাতার অবহেলা কিংবা অসম্মান যেমন পাপ, মাতৃভাষার অবহেলাও তেমনই গুরুতর অপরাধ।’ প্রবন্ধের রচয়িতা সুসাহিত্যিক সৈয়দ ইসমাইল হোসেন শিরাজী। ‘সে সময় মুসলমানদের উন্নতি-অগ্রতির জন্য তিনি কলমসৈনিকের ভূমিকা পালন করেন। পৃথিবীজুড়ে মুসলমানরা যদি মায়ের ভাষায় ‘ইকরা বিসমি রাব্বিকাল্লাজি খালাক’ (তোমার প্রেমময় প্রভুর নামে পড়) চর্চা করতে জানত, তাহলে তারাই হতো আল কোরআনের একেকজন গবেষক। সপ্ত আকাশ, সপ্ত জমিন গবেষণা করে কোরআনের গবেষণামূল আয়াতগুলোর রহস্য উদ্ঘাটন করতে পারত তারা।’
মাতৃভাষার গুরুত্ব সম্পর্কে পবিত্র কোরআনের বক্তব্য আলোচনা করা যাক। সুরা ইবরাহিমের ৪নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালাা বলেন, ‘ওমা আরসালনা মির রসুলিন ইল্লা বিলিসানি কওমিহি লিউ বায়্যিনা লাহুম।’ অর্থাাৎ, ‘প্রত্যেক নবী-রাসুলের কাছেই আমরা যে উপদেশ বাণী পাঠিয়েছি, তা ছিল তাদের মমতাময়ী মায়ের ভাষায়।’ মায়ের ভাষার মাধ্যমেই নবীরা খোদার প্রেরিত হেদায়েত মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন যুগে যুগে। সর্বশেষ আসমানি গ্রন্থও এসেছে মুহাম্মদ (সা.) এর মায়ের ভাষায়। ধর্মের মর্ম বোঝার ক্ষেত্রে মায়ের ভাষার বিকল্প নেই। তাই তো কবি বলেছেন, ‘আমার মায়ের ভাষার মর্ম/আমার নামাজ আমার ধর্ম।’ মাতৃভাষার মর্ম যে কত বড়, তার প্রমাণ রয়েছে পবিত্র কোরআনের এ আয়াতে- ‘ওয়া মিন আয়াতিহি খালকুস সামাওয়াতি ওয়াল আরদি ওয়াখতিলাফু আলসিনাতিকুম ওয়া আল ওয়ানিকুম।’ অর্থাৎ, ‘তাঁর আরেকটি নিদর্শন হলো মহাকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বিভিন্নতা।’ (সুরা রুম : ২২)। সপ্ত আকাশ ও সপ্ত জমিন তথা মহাকাশের চেয়ে বড় রহস্য আধুনিক বিজ্ঞানের কাছে আর কিছু আছে বলে আমার জানা নেই। প্রতিদিনই নিত্যনতুন গ্রহ-নক্ষত্র আবিষ্কার হচ্ছে। আবিষ্কার হচ্ছে গ্যালাক্সি-মিল্কিও। পুরোনো থিওরিকে ভুল প্রমাণ করে আসছে নতুন তথ্য। প্রতি মুহূর্তেই মহাকাশ গবেষকদের সামনে খুলছে নতুন রহস্যের দুয়ার। এক দুয়ার যেন দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে আরেক দরজার সামনে। এক রহস্য নিয়ে যাচ্ছে তার চেয়ে বড় কোনো রহস্যের কাছে। মহাকাশের মতোই রহস্যে ঘেরা আমার আপনার গহিন বুকের ভাষা। মায়ের ভাষা। মাতৃভাষা। তাই তো আল্লাহ পাক পবিত্র কোরআনে মহাকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টি রহস্যের সঙ্গে ভাষা ও বর্ণের বিভিন্নতার উল্লেখ করেছেন। বলেছেন এসবই তার রহস্যময় সৃষ্টির স্পষ্ট নিদর্শন। ‘ইন্নাফি জালিকা লা আয়াতিল লিল আলামিন।’ অর্র্থাৎ, ‘তাঁর এসব সৃষ্টি রহস্যের মধ্যে রয়েছে জ্ঞানীদের জন্য নিদর্শন।’ (সুরা রুম : ২২)।
মাতৃভাষার প্রতি আমাদের প্রিয় নবীর (সা.) এর ভালোবাসা কেমন ছিল? রাসুল (সা.) এর পবিত্র মুখেই শুনি সে কথা। ‘তিনটি কারণে আমি আরবিকে ভালোবাসি। একটি কারণ হলো আরবি আমার মায়ের ভাষা। উম্মতেরা জেনে রাখ! আরবদের মধ্যে আমিই সবচেয়ে বিশুদ্ধভাষী। আমি নিজে যেমন বিশুদ্ধ আরবি বলি, তেমনি অন্যদের বেলায়ও লক্ষ রাখি তারা যেন ভুল বলে মায়ের ভাষার অপমান না করে। একদিনের ঘটনা। আমি আর খাদেম বসে আছি। কে যেন বাইরে থেকে বলছে, ‘আ-আলিজু- আমি কি ভেতরে আসতে পারি?’ শুনেই মনটা খারাপ হয়ে গেল। ভেতরে আসার জন্য বলতে হয় ‘আ-আদখুলু।’ যদিও উলুজু আর দুখুল সামার্থবোধক শব্দ; কিন্তু উলুজের চেয়ে দুখুল সাহিত্যের দৃষ্টিতে উঁচু মাপের শব্দ। খাদেমকে বললাম যাও! তাকে প্রবেশের ভাষা শিখিয়ে দাও। আর তাকে বলবে অনুমতির সঙ্গে যেন সালামও বলে। সালাম দিয়ে প্রবেশের মধ্যে অনেক বরকত আছে।’ (বোখারি ও আবু দাউদ শরিফের হাদিসের ভাব অনুবাদ)। মানুষের হেদায়েতের জন্য যে ১০৪টি আসমানি কিতাব পাঠিয়েছেন আল্লাহ তায়ালা তা প্রত্যেক রাসুলের কওমের ভাষায় করেছেন। ধর্মে মাতৃভাষার প্রতি এত জোর গুরুত্ব থাকা সত্ত্বেও ধার্মিকদের মুখেই মায়ের ভাষার প্রতি অপমান হচ্ছে প্রতিনিয়ত। বিদায়ের আগে কবি শিরাজীর কথাটি আবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি- ‘মাতার অবহেলা কিংবা অসম্মান যেমন পাপ, মাতৃভাষার অবহেলাও তেমনই গুরুতর অপরাধ।’ ভাষার ছন্দ আর মায়ের কথার গন্ধে ফুটে ওঠুক আমাদের বন্দেগির জীবন।
লেখক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ মুফাস্সির সোসাইটি, পীর সাহেব আউলিয়ানগর
