ঢাকা রোববার, ০৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ২২ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

‘চট্টগ্রামকে ক্লিন, গ্রীন, হেলদি ও সেইফ সিটিতে পরিণত করব’

‘চট্টগ্রামকে ক্লিন, গ্রীন, হেলদি ও সেইফ সিটিতে পরিণত করব’

চট্টগ্রাম নগরীকে ক্লিন, গ্রীন, হেলদি ও সেইফ সিটিতে রূপান্তরের গৃহীত কার্যক্রমের অগ্রগতি তুলে ধরে পরবর্তী পরিকল্পনা উপস্থাপন করেছেন সিটি মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন।

বৃহস্পতিবার (৬ নভেম্বর) দুপুরে কাজীর দেউড়ির ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন সেন্টারে (আইসিসি) মেয়র শাহাদাত হোসেনের দায়িত্ব গ্রহণের এক বছর পূর্তির অনুষ্ঠানে এ পরিকল্পনা তুলে ধরেন তিনি।

এ সময় নগরীর যোগাযোগ ব্যবস্থা নিয়ে মেয়র বলেন, আমি দায়িত্ব গ্রহণের পর ১৭ বছর ধরে বেদখলে থাকা ভূমি উদ্ধার করে আগ্রাবাদের সড়ক করে দিয়েছি। আমি নগরীতে প্রায় ৫০টি বড় বড় রাস্তা নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছি, যে রাস্তাগুলো হলে এই শহরের চেহারা পরিবর্তন হয়ে যাবে ইনশাল্লাহ। এ বছর এই ৫০টি বড় বড় রাস্তা আমি আপনাদের উপহার দেব।

নাগরিক সেবাকে সহজ করতে প্রযুক্তির সাহায্য নেওয়া হচ্ছে জানিয়ে মেয়র বলেন, ১০টি সেবা নিয়ে ‘আমাদের চট্টগ্রাম’ নামের একটি অ্যাপস আগামী ডিসেম্বরে লঞ্চ করা হবে। অ্যাপটিতে ময়লা পরিষ্কার, নালা পরিষ্কার, রাস্তা সংস্কার, আলোকায়ন, মশা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত যেকোনো অভিযোগ ছবি তুলে জমা দিতে পারবেন নাগরিকরা।

নগরীর বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় সাফল্য এসেছে জানিয়ে মেয়র বলেন, চট্টগ্রামে প্রতিদিন ৩,০০০ থেকে ৩,১০০ মেট্রিক টন ময়লা উৎপাদিত হয়। এর মধ্যে ২,২০০ মেট্রিক টন আমরা সংগ্রহ করতে পারছি, বাকি ৮০০ থেকে ৯০০ মেট্রিক টন পারছি না। এই ময়লা কোথা থেকে আসে— কেউ বাসা থেকে জানালা দিয়ে ময়লা ফেলেন, কেউ ডাস্টবিনে না ফেলে চলন্ত গাড়ি থেকে ফেলছেন। এগুলো নালায় গিয়ে, সেখান থেকে খালে, পরে কর্ণফুলি ও হালদা নদীতে দূষণ ঘটাচ্ছে। এ প্রেক্ষাপটে আমি ডোর-টু-ডোর প্রকল্প চালু করেছি।

তবে কিছু জায়গায় অভিযোগ পেয়েছি—সিটি কর্পোরেশনের নির্ধারিত হারের চেয়ে বেশি টাকা নেওয়া হচ্ছে। এমন ঘটনা ঘটলে আপনারা সরাসরি লিখিত অভিযোগ দিন, আমরা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কার্যাদেশ বাতিল করে অন্য প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দেব।

মেয়র বলেন, “সুখবর দিতে চাই—বাংলাদেশে সর্বপ্রথম চট্টগ্রামে আমরা আবর্জনা থেকে বায়োগ্যাস উৎপাদনে কোরিয়ান একটি কোম্পানির সঙ্গে হালিশহরে ফিজিবিলিটি স্টাডি শুরু করেছি। দুই-তিন মাস পর হয়তো বাসা থেকে ময়লা সংগ্রহ কার্যক্রম বিনামূল্যে করা হবে ইনশাল্লাহ। তখন আপনাদের এক টাকাও দিতে হবে না। বরং এক-দেড় বছর পর আমরা যখন আয় করব, তখন উল্টো ময়লা দেওয়ার জন্য প্রতি বাসায় টাকা দেব।”

তিনি আরও বলেন, “একটু ধৈর্য ধরতে হবে শহরটাকে ক্লিন রাখার জন্য এবং আমার প্রতি বিশ্বাস রাখতে হবে। আমি আপনাদেরই মানুষ, আপনাদের কাছ থেকে উঠে এসেছি। আমি জানি আপনাদের কী সমস্যা। কিন্তু শহরটাকে ক্লিন রাখতে হলে ময়লা সম্পূর্ণভাবে আমাদের সংগ্রহ করতে হবে। না হলে এই ময়লাগুলো নালায় জমে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করে এবং কর্ণফুলি ও হালদা নদী দূষিত হয়।”

মেয়র বলেন, বর্জ্য সংগ্রহ না করতে পারলে হাজার হাজার কোটি টাকার জাতীয় সম্পদ নষ্ট হয়ে যাবে। এজন্য ডোর-টু-ডোর প্রকল্প সফল করতে চাই, যাতে শতভাগ ময়লা সংগ্রহ সম্ভব হয়। আগের তুলনায় এই মাসে ৫০০ মেট্রিক টন বেশি বর্জ্য সংগ্রহ করতে পেরেছি। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা উন্নত না হলে জলাবদ্ধতা কখনোই দূর হবে না। আমরা বর্জ্য থেকে গ্রিন এনার্জি উৎপাদন করব।

জলাবদ্ধতা প্রসঙ্গে মেয়র বলেন, “সবাইকে নিয়ে সমন্বিত প্রচেষ্টায় চট্টগ্রামবাসীর গত ৩০ বছরের জলাবদ্ধতার সমস্যা অর্ধেকে নামিয়ে এনেছি। আগে মুরাদপুর, বহদ্দারহাটসহ বিভিন্ন এলাকায় ভয়াবহ জলাবদ্ধতা হতো, এখন তা আর নেই। জলবায়ুগত পরিবর্তনের কারণে এবার প্রায় সাড়ে পাঁচ মাস বর্ষাকাল ছিল, তবুও বড় কোনো জলাবদ্ধতা হয়নি।”

কিশোর গ্যাংয়ের ভয়াবহতা নিয়ে মেয়র বলেন, জনপ্রিয় সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব পলাশের সংগঠনের সঙ্গে যৌথভাবে চসিক নগরীতে ব্রেস্ট ফিডিং কর্নার চালু করবে ও নাগরিক সচেতনতা নিয়ে কাজ করবে। “কিশোর গ্যাং বড় চ্যালেঞ্জ। এটা মোকাবিলা না করলে তরুণ প্রজন্মকে নিয়ে যে নতুন চট্টগ্রাম ও নতুন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন, তা ভেঙে পড়বে।”

তিনি জানান, একটি টিম স্কুল, কলেজ ও প্রতিষ্ঠানগুলোতে গিয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মেন্টাল হেলথ, মাদক ও সংঘর্ষ থেকে দূরে থাকার বিষয়ে কাউন্সেলিং করবে।

হেলদি সিটি পরিকল্পনা বিষয়ে মেয়র বলেন, ব্রেস্ট ক্যান্সার ও লিভার ক্যান্সার বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করা হচ্ছে। শিশুদের টাইফয়েড ভ্যাকসিন দেওয়া হচ্ছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো উন্নয়ন ও প্রাইমারি হেলথ কেয়ার সেন্টারে আধুনিক মেডিকেল সরঞ্জাম সরবরাহ করা হচ্ছে। মেমন-২ হাসপাতালে স্বল্পমূল্যে কিডনি ডায়ালাইসিস সেবা চালু করা হবে। বাংলাদেশে সর্বপ্রথম স্কুল হেলথ কার্ড কার্যক্রম চট্টগ্রামে চালু হয়েছে।

রাজস্ব আহরণ প্রসঙ্গে মেয়র বলেন, অতীতে নাগরিকদের ওপর নির্ধারিত অতিরিক্ত রাজস্ব আমি রিভিউ বোর্ডের মাধ্যমে যাচাই করে সঠিক পরিমাণে নির্ধারণ করছি। তবে বাণিজ্যিক হোল্ডিং ট্যাক্স ফাঁকি রোধে কঠোর অবস্থান নেওয়া হয়েছে এবং ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম চালু হচ্ছে। “চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনকে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী করে হতদরিদ্র পরিবারের সন্তানদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্য অধিকার নিশ্চিত করব।”

অনুষ্ঠানে মেয়র “এআই হেলথ কেয়ার সিস্টেম” উদ্বোধন করেন, যার মাধ্যমে নাগরিকদের স্বাস্থ্যগত তথ্য সংরক্ষণ ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সহায়তায় বিশ্লেষণ করা হবে। মেয়র নাগরিকদের সরাসরি অভিযোগ ও পরামর্শ গ্রহণ করেন। অনুষ্ঠানে মেয়রের এক বছরের কার্যক্রম নিয়ে তথ্যচিত্র প্রদর্শন ও উন্নয়ন প্রতিবেদন মোড়ক উন্মোচন করা হয়।

বিশেষ অতিথি ডিআইজি মো. আহসান হাবীব পলাশ বলেন, “সারাদেশের মানুষ নিশ্বাস নিতে চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামে বেড়াতে আসেন। তাই পুরো চট্টগ্রামকে নিশ্বাসের জায়গায় পরিণত করতে হবে। চট্টগ্রাম শহরে ভালো কোনো পার্ক নেই। ঢাকার রমনা পার্কের মতো পার্ক, বোটানিক্যাল গার্ডেন ও অ্যাকুয়ারিয়াম দেখতে চাই।”

সিএমপি কমিশনার হাসিব আজিজ বলেন, “আগে জেলা পুলিশ লাইনে কোমর পানি হয়ে যেত, প্যারেড করা যেত না। জলাবদ্ধতার স্থায়ী সমাধান হয়েছে। এখন যেভাবে কাজ হচ্ছে, তাতে আগামী দিনে চট্টগ্রামকে বাসযোগ্য শহর হিসেবে দেশবাসীর কাছে উপস্থাপন করা সম্ভব হবে।”

সিডিএ চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো. নুরুল করিম বলেন, “মেয়র ডা. শাহাদাত বিনয়ী ও সৎ মানুষ, আপসহীন রাজনীতিক। জলাবদ্ধতা নিরসনে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি এসেছে। চসিক ও সিডিএ একসঙ্গে কাজ করছে। মেয়রের নেতৃত্বে নতুন চট্টগ্রাম গড়ে তুলব আমরা।”

অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (সার্বিক) মোহাম্মদ নূরুল্লাহ নূরী নগরে প্লাস্টিক ও পচনশীল বর্জ্যের জন্য লাল ও সবুজ রঙের বিন স্থাপনের প্রস্তাব দেন এবং নাগরিকদের প্লাস্টিক-পলিথিন ব্যবহার কমানোর আহ্বান জানান।

চসিক সচিব মো. আশরাফুল আমিনের সভাপতিত্বে আয়োজনে অংশ নেন চট্টগ্রাম পুলিশ কমিশনার হাসিব আজিজ, ডিআইজি আহসান হাবীব পলাশ, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো. নুরুল করিম, অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা পরিষদের প্রশাসক মোহাম্মদ নূরুল্লাহ নূরী, চট্টগ্রাম ওয়াসার এমডি মনোয়ারা বেগম, সিভিল সার্জন ডা. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, জামায়াতে ইসলামীর চট্টগ্রাম মহানগরের সাবেক আমীর আলহাজ শাহজাহান চৌধুরী, চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশেম বক্কর, দক্ষিণ জেলা বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক আবু সুফিয়ান, মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব নাজিমুর রহমান, মহানগর জামায়াতে ইসলামীর আমীর নজরুল ইসলাম, মহানগর যুবদলের সাবেক সভাপতি মোশাররফ হোসেন দিপ্তী, চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের সদস্য সচিব জাহিদুল করিম কচি, চট্টগ্রাম জেলা অ্যাবের সভাপতি প্রকৌশলী সেলিম মো. জানে আলম, মহানগর জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সম্পাদক মোহাম্মদ উল্লাহ, সাংগঠনিক সম্পাদক শামসুজ্জামান হেলালী, মেট্রোপলিটন সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি শামসুল হক হায়দারী, সাধারণ সম্পাদক সালেহ নোমান প্রমুখ।

চট্টগ্রাম,সেইফ সিটি,মেয়র শাহাদাত
আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত