
জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের সময় গণহত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে করা মামলার রায় আজ সোমবার ঘোষণা করবেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। জনগণের কাছে রায়ের স্বচ্ছতা তুলে ধরতে ট্রাইব্যুনালের অনুমতি সাপেক্ষে রায় সরাসরি সম্প্রচার করবে বাংলাদেশ টেলিভিশন। বাংলাদেশ টেলিভিশনের মাধ্যমে দেশের অন্য গণমাধ্যমগুলো রায়ের কার্যক্রম সরাসরি সম্প্রচার করতে পারবে। ঐতিহাসিক রায়কে কেন্দ্র করে ঢাকার বিভিন্ন স্থানে বড় পর্দার ব্যবস্থা রেখেছে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়।
পলাতক সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান ও সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল-মামুনের বিরুদ্ধে করা মামলার রায়কে ঘিরে কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষিত আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা নাশকতা করতে পারে, এমন আশঙ্কা আমলে নিয়ে সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। একইসঙ্গে নাশকতা প্রতিরোধে মাঠে থাকছে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ বিভিন্ন দলের নেতাকর্মীরা।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়, হাইকোর্ট অঙ্গন, মহাসড়ক, গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা, রাজনৈতিক দলীয় কার্যালয় ও জনবহুল এলাকায় বাড়ানো হয়েছে টহল। পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, সেনাবাহিনীসহ পোশাকধারী ও সাদাপোশাকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা মাঠে রয়েছেন। এ ছাড়া সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে আগাম তথ্যকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলগুলোতে অতিরিক্ত বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে।
শেখ হাসিনার রায়কে ঘিরে বিভিন্ন সময়ে রাজধানীরসহ সারা দেশে বাস আগুন ও ট্রেনের বগিতে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। বাসে আগুন দেওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন স্থানে ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। পেট্রলবোমা উদ্ধার, গ্রামীণ ব্যাংকের শাখায় আগুন দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটেছে। অধিকাংশ নাশকতার ঘটনা রাত ও ভোর বেলায় ঘটনানো হয়। বগুড়ার শেরপুর উপজেলার গাড়িদহ ইউনিয়নে গ্রামীণ ব্যাংকের শাখার প্রধান ফটকের সাইনবোর্ডে আগুন দিয়েছে। গত শনিবার রাতে এ ঘটনা ঘটে। শনিবার দিবাগত রাত তিনটার দিকে ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জে রাজেন্দ্রপুর বাজার এলাকায় ঢাকা-মাওয়া হাইওয়ের সার্ভিস লেনে দাঁড়িয়ে থাকা বলাকা পরিবহন (ঢাকা মেট্রো ব ১৫-৮৮২৮) নামে একটি বাসে আগুন দেওয়া হয়।
ডিএমপির উপপুলিশ কমিশনার (মিডিয়া) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান বলেন, শেখ হাসিনার রায়কে কেন্দ্র করে রাজধানীতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পর্যাপ্ত সদস্য মোতায়েন রয়েছেন। সাইবার ইউনিট সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে নজরদারি করছে। কোনো ধরনের নাশকতামূলক কাজ যেন না ঘটে, তার জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিয়মিত টহল কার্যক্রম চলছে।
শেখ হাসিনার ?রায়কে ঘিরে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা রাজধানীতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির পরিকল্পনা করছে বলে জানিয়েছে নিরাপত্তা সংস্থাগুলো। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন পেজ, গ্রুপ ও ভুয়া অ্যাকাউন্ট থেকে দলটির সমর্থকেরা ছড়াচ্ছে গুজব, উসকানি ও সংঘবদ্ধ হওয়ার বার্তা।
?এর আগে গত ১৩ নভেম্বর রায়ের দিন ঘোষণাকে কেন্দ্র করে ‘ঢাকা লকডাউন’ কর্মসূচি দিয়েছিল আওয়ামী লীগ। কর্মসূচি চলাকালে রাজধানীর হাতিরঝিল, মিরপুর, আগারগাঁও ও বিমানবন্দর রেলস্টেশন এলাকায় দুর্বৃত্তরা ককটেল বিস্ফোরণ ঘটায়। গত ছয় দিনে এই ধরনের ঘটনায় ৩০টির বেশি যানবাহন পুড়ছে।
বিজিবি মোতায়েন : ঢাকা, গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর ও মাদারীপুর জেলার সার্বিক নিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। রোববার বিজিবির জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. শরীফুল ইসলাম এ তথ্য জানান। গত মঙ্গলবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আইনশৃঙ্খলা-সংক্রান্ত কোর কমিটির সভায় বিস্তারিত আলোচনা হয়। বিশৃঙ্খলাকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। নির্দেশনা অনুযায়ী ঢাকার প্রবেশপথ, আবাসিক হোটেল ও মেসে বিশেষ তল্লাশি করা হয়। গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় এরইমধ্যে অতিরিক্ত ফোর্স মোতায়েন করা হয়েছে বলে বিশ্বস্ত সূত্র নিশ্চিত করেছে।
শেখ হাসিনার রায় সরাসরি দেখবে গোটা বিশ্ব : মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার রায় সরাসরি টেলিভিশনে দেখতে পাবে গোটা জাতি। এই রায়কে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের দিকে তাকিয়ে আছে বিশ্বের অনেক দেশ। ঐতিহাসিক বিচারকাজ আগামীর জন্য একটি উদাহরণ হয়ে থাকে। এছাড়া রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন পয়েন্টে বড় পর্দার ব্যবস্থা রেখেছে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়।
পাঁচটি অভিযোগ : তিন আসামির বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের পাঁচ অভিযোগ এনেছে প্রসিকিউশন। এর মধ্যে রয়েছে জুলাই-আগস্টে উসকানি, মারণাস্ত্র ব্যবহার, আবু সাঈদ হত্যা, চানখারপুলে হত্যা ও আশুলিয়ায় লাশ পোড়ানো।
১. উসকানিমূলক বক্তব্য : ২০২৪ সালের ১৪ জুলাই গণভবনে সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনা ছাত্র-জনতাকে ‘রাজাকারের বাচ্চা’ বলে উসকানি দেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সশস্ত্র গোষ্ঠী নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর আক্রমণ চালায়।
২. প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ : তিনি হেলিকপ্টার, ড্রোন ও প্রাণঘাতী অস্ত্র দিয়ে আন্দোলনকারীদের নির্মূল করার নির্দেশ দেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি রাজনৈতিক সংগঠনগুলোকেও ওই নির্দেশনায় অংশগ্রহণ করতে বলেন।
৩. আবু সাঈদ হত্যাকাণ্ড : রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে ছাত্র আবু সাঈদকে গুলি করে হত্যা করার ঘটনায় হাসিনা, আসাদুজ্জামান খান ও চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকে অভিযুক্ত করা হয়। এটি ছিল রাজনৈতিকভাবে পরিচালিত দমনমূলক হামলা।
৪. চানখাঁরপুল হত্যাকাণ্ড : রাজধানীর চানখাঁরপুল এলাকায় ছয় জন নিরস্ত্র আন্দোলনকারীকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এই ঘটনা ছিল পরিকল্পিত রাজনৈতিক দমনমূলক অপারেশন, যেখানে লক্ষ্যবস্তু ছিল সাধারণ জনতা।
৫. আশুলিয়ার লাশ পোড়ানো : দমন অভিযানের অংশ হিসেবে আশুলিয়ায় নিরস্ত্র ছয়জন আন্দোলনকারীকে হত্যা করার জন্য তাদের আগুনে পোড়ানোর নির্দেশ ছিল। আনুষ্ঠানিক অভিযোগ মোট আট হাজার ৭৪৭ পৃষ্ঠার। এর মধ্যে তথ্যসূত্র ২ হাজার ১৮ পৃষ্ঠার, জব্দতালিকা ও দালিলিক প্রমাণাদি চার হাজার পাঁচ পৃষ্ঠার ও শহিদদের তালিকার বিবরণ ২ হাজার ৭২৪ পৃষ্ঠার। সাক্ষী করা হয়েছে ৮৪ জনকে। গত ১২ মে চিফ প্রসিকিউটরের কাছে এ মামলার প্রতিবেদন জমা দেয় ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা।
ট্রাইব্যুনালে যে রায় হোক, কার্যকর হবে- স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা : রোববার বরিশাল পুলিশ লাইন্সে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ মাঠ প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক শেষে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, আজ (সোমবার) ট্রাইব্যুনালে যে রায় হোক, তা কার্যকর হবে।
সাজার ক্ষেত্রে নারী হিসেবে সহানুভূতি পাবেন না শেখ হাসিনা- প্রসিকিউটর তামিম : মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার রায় দেওয়ার ক্ষেত্রে নারী হিসেবে শেখ হাসিনাকে কোনো সহানুভূতি দেখানো হবে না বলে আশা করছেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী প্রসিকিউটর গাজী মোনাওয়ার হুসাইন তামিম। গতকাল রোববার এক ব্রিফিংয়ে এ কথা বলেন তিনি। প্রসিকিউটর তামিম বলেন, সাধারণ আইনে জামিন প্রদানের ক্ষেত্রে নারী, অসুস্থ ও কিশোরদের কিছুটা অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। তবে রায়ের ক্ষেত্রে সাধারণ আইনেও তেমন কিছু নেই, এই আইনেও নেই। অর্থাৎ রায় প্রদানের ক্ষেত্রে তিনি নারী হোক বা পুরুষ, তিনি কী অপরাধ করেছেন তার তীব্রতা বিবেচনা করে রায় দেওয়া হবে।
মামলার ধারাক্রম : চব্বিশের ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার কার্যক্রম শুরু হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। ২০২৪ সালের ১৭ অক্টোবর পুনর্গঠিত ট্রাইব্যুনালের প্রথম বিচার কার্যক্রম শুরু হয়। ২০২৫ সালের ১২ মে চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয়ে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়। ১ জুন শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করে। ১৬ জুন শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালকে হাজির হতে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়।
২৪ জুন পলাতক দুইজনের জন্য আওয়ামী লীগপন্থী আইনজীবী আমির হোসেনকে তাদের পক্ষে মামলা লড়তে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী হিসেবে নিয়োগ করে। ১ জুলাই তিনজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের শুনানি শুরু হয়। ১০ জুলাই পাঁচ অভিযোগে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে বিচার শুরুর নির্দেশ দেওয়া হয়। ১০ জুলাই অপরাধে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন। ১২ অক্টোবর যুক্তি-তর্ক শুরু; শেষ হয় ২৩ অক্টোবর, ১৩ নভেম্বরে রায়ের তারিখ ঘোষণা করেন ট্রাইব্যুনাল-১। ঐতিহাসিক সেই রায়ের দিন আজ।