বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালানোর ‘প্রকাশ্য নির্দেশনা’ নিয়ে একটি বিস্ফোরক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা। প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, গত বছরের শিক্ষার্থী আন্দোলনের সময় শেখ হাসিনা নিরাপত্তা বাহিনীকে যেখানেই বিক্ষোভকারীদের পাওয়া যাবে, সেখানেই প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করে গুলি চালাতে বলেছিলেন। এ সংক্রান্ত বেশ কয়েকটি গোপন ফোনালাপের কল রেকর্ড আল জাজিরা হাতে পেয়েছে বলে জানিয়েছে।
আল জাজিরার ইনভেস্টিগেটিভ ইউনিট (আই-ইউনিট) এই কল রেকর্ডগুলো ফরেনসিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে যাচাই করেছে এবং নিশ্চিত করেছে, এগুলো এআই বা কৃত্রিমভাবে তৈরি নয়। ভয়েস-ম্যাচিংয়ের মাধ্যমে রেকর্ডকৃত অডিওতে থাকা কণ্ঠগুলো সত্যিকার ব্যক্তিদের সঙ্গে মিলে গেছে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, শেখ হাসিনার নির্দেশের পর নিরাপত্তা বাহিনী দেশজুড়ে বিক্ষোভ দমন শুরু করে, যার ফলে সহিংসতা চরমে পৌঁছায়। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি) জানিয়েছে, শেখ হাসিনার পদত্যাগের আগে কয়েক সপ্তাহের সংঘর্ষে প্রায় ১ হাজার ৪০০ জন নিহত এবং ২০ হাজারের বেশি মানুষ আহত হয়। গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে ভারত পালিয়ে যান।
একটি ফোনালাপে শেখ হাসিনাকে বলতে শোনা যায়, তিনি সম্পূর্ণ প্রকাশ্যে নিরাপত্তা বাহিনীকে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছেন। সেখানে তিনি বলেন, “ইতোমধ্যে আমার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে... যেখানেই পাবে গুলি চালাবে।”
প্রতিবেদনে শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ আত্মীয় এবং তৎকালীন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসের সঙ্গে কথোপকথনের কথাও উঠে আসে, যেখানে শেখ হাসিনা হেলিকপ্টার ব্যবহার করে বিক্ষোভ দমন করার কথাও বলেন।
এদিকে, রাজধানীর একটি হাসপাতালে দায়িত্বরত চিকিৎসক শাবির শরীফ আল জাজিরাকে বলেন, তাদের হাসপাতালের প্রবেশপথ লক্ষ্য করে হেলিকপ্টার থেকে গুলি চালানো হয়। তিনি জানান, আহত শিক্ষার্থীদের শরীরে অস্বাভাবিক গুলির ক্ষত দেখা গেছে এবং এক্স-রে করলে দেখা যায়, অনেক গুলি শরীরের ভেতরেই রয়ে গেছে।
আরও একটি ফোনালাপে শেখ হাসিনার অর্থনৈতিক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানকে শোনা যায়, রংপুরে নিহত ছাত্র আবু সাঈদের ময়নাতদন্ত রিপোর্টের জন্য পুলিশের মহাপরিদর্শককে চাপ দিতে। রংপুর মেডিকেল কলেজের এক চিকিৎসক আল জাজিরাকে বলেন, তাকে পাঁচবার রিপোর্ট পাল্টাতে বাধ্য করা হয় যাতে গুলির ক্ষতের উল্লেখ না থাকে।
আল জাজিরা জানায়, এসব ফোনালাপ শেখ হাসিনার অধীনেই থাকা একটি নজরদারি সংস্থা, জাতীয় টেলিযোগাযোগ নজরদারি কেন্দ্র (এনটিএমসি) রেকর্ড করেছিল। এই সংস্থাটি শুধু বিরোধী নয়, বরং সরকারের ভেতরের লোকদেরও নজরে রাখত বলে প্রতিবেদনে দাবি করা হয়।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রধান প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বলেছেন, শেখ হাসিনা জানতেন যে তার ফোন রেকর্ড হচ্ছে, তবুও তিনি নির্দেশনা দিয়েছেন। তিনি বলেন, “তিনি (হাসিনা) অন্যদের জন্য গভীর গর্ত খুঁড়েছিলেন। এখন সেই গর্তে তিনি নিজেই পড়েছেন।”
আন্দোলনের সময় নিহত আবু সাঈদের পরিবারসহ প্রায় ৪০টি পরিবারকে গণভবনে ডেকে এনে টেলিভিশন অনুষ্ঠানে হাজির করা হয়। সেখানে শেখ হাসিনা তাদের ন্যায়বিচারের আশ্বাস দিলেও, নিহত সাঈদের বোন সুমি খাতুন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘ভিডিওতে দেখা গেছে, পুলিশ গুলি করেছে। এখানে তদন্তের কী আছে? আমাদের এখানে আসাটাই ভুল হয়েছে।’
তবে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে আল জাজিরার এই প্রতিবেদনকে ‘প্রোপাগান্ডা’ বলে উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। দলের একজন মুখপাত্র বলেন, শেখ হাসিনা কখনোই প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ দেননি এবং ফোনালাপগুলো বিকৃত করে উপস্থাপন করা হয়েছে। তারা দাবি করেন, আবু সাঈদের মৃত্যুর বিষয়ে সরকার আন্তরিকভাবে তদন্ত করেছে।