সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইউরোপীয় নানা দেশসহ বিশ্বের অন্যতম ধর্মনিরপেক্ষ দেশ খ্যাত ভারতে ইসলামবিদ্বেষী তৎপরতা ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে সহিংসতা ক্রমেই বাড়ছে। বিভিন্ন দেশের উগ্র ডানপন্থি দলসহ নানা আন্দোলন ও দল এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
সম্প্রতি সুইডেনে রাসমুস পালুদান নামের এক উগ্র ডানপন্থি নেতা পবিত্র কোরআনের কপি পোড়ানোর পদক্ষেপ নিলে সেখানে সংঘাত সৃষ্টি হয়। ডেনমার্কের ‘হার্ড লাইন’ নামক দলের এই নেতা তার সমর্থকদের নিয়ে সুইডেনের লিংকোপিং নামের এক শহরে পবিত্র কোরআন পোড়ানোর পরিকল্পনা করে। যথারীতি সুইডেনের এই কট্টর দক্ষিণপন্থি গোষ্ঠী গত বৃহস্পতিবার কোরআনের একটি কপি পোড়ায় এবং সামনের দিনে তাদের সমাবেশ থেকে আবারও এই কাজ করার পরিকল্পনা করে। এর বিরুদ্ধে সুইডেনে তীব্র ধিক্কার উঠেছে।
পরপর তৃতীয় রাত সহিংস বিক্ষোভ হয়েছে সুইডেনের অনেক শহরে। সুইডেনের পুলিশ প্রধান অ্যান্ডার্স থর্নবার্গ বলেছেন, বিক্ষোভকারীরা পুলিশের জীবনকে হুমকির মুখে ফেলতে পর্যন্ত পরোয়া করছে না। তিনি বলেন, ‘আমরা আগেও সহিংস দাঙ্গা দেখেছি; কিন্তু এটা মনে হচ্ছে একেবারেই ভিন্ন কিছু।’ ২০২০ সালের আগস্ট মাসেও সুইডেনের একটি শহরে অনুরূপ পদক্ষেপ বাস্তবায়নের প্রচেষ্টা সড়কে দাঙ্গা সৃষ্টি করে।
সুইডেনের বাইরেও এই ঘটনার প্রতিবাদ শুরু হয়েছে। ইরাকি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বাগদাদে সুইডেনের দূতকে ডেকে এ ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছে, এ ঘটনায় সুইডেনের সঙ্গে মুসলিম জনগোষ্ঠীর সম্পর্কের মারাত্মক প্রভাব পড়তে পারে। ইরানও সুইডিশ রাষ্ট্রদূতকে তলব করে কঠোর ভাষায় এই ঘটনার নিন্দা করেছে।
মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও বাক-স্বাধীনতার নামে ইউরোপীয় সরকারগুলো ইসলামবিদ্বেষী এসব তৎপরতা চালানোর অনুমতি দিচ্ছে। অথচ দেখা গেছে ইউরোপের সরকারগুলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে কথিত ইহুদি-নিধন বা হলোকাস্টসহ কোনো কোনো বিষয়ে মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও বাকস্বাধীনতাকে সহ্য করছে না। কেবল ইসলাম ও এ ধর্মের পবিত্র বিষয়গুলোর প্রতি বিদ্বেষ প্রকাশের বেলায় তারা মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও বাকস্বাধীনতার অজুহাত ব্যবহার করছেন। দেখা গেছে, চলমান ইউক্রেন যুদ্ধের ক্ষেত্রেও অনেক ইউরোপীয় সরকার ভিন্নমতকে সহ্য করছে না।
ফ্রান্সের শার্লি এবদো নামক ম্যাগাজিন মহানবীর প্রতি অবমাননাকর কার্টুন প্রকাশ করলে মুসলমানদের প্রতিবাদকে ফরাসি প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রন এই বলে উপেক্ষা করেন যে, ফ্রান্স সরকার মত প্রকাশের স্বাধীনতায় ও বাকস্বাধীনতায় বিশ্বাসী। অথচ ম্যাক্রনকে হিটলারের সঙ্গে তুলনা করে ছবি প্রকাশের দায়ে ওই ছবি প্রকাশকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছেন ম্যাক্রন। ফ্রান্সে হলোকাস্টের সত্যতার বিষয়ে বা এ সম্পর্কিত অতিরঞ্জিত তথ্যের বিষয়ে প্রশ্ন তোলাও আইনত নিষিদ্ধ।
ম্যাক্রন ও ফ্রান্সের আরেক উগ্র নেতা ম্যারি লোপেন মুসলিম নারীদের হিজাবের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে মুসলমানদের ধর্মীয় স্বাধীনতাকে ক্ষুণœ করছেন। ম্যারি লো পেন প্রকাশ্য স্থানে হিজাব পরিধানের জন্য জরিমানা করার পক্ষে মত দিয়েছেন। ফ্রান্সের স্কুলগুলোতে মুসলিম মেয়েদের হিজাব পরাকে আইন পাস করে নিষিদ্ধ করে রেখেছে সেখানকার সরকার।
এভাবে ইউরোপের সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলো ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে ক্রমেই নানা ধরনের সীমাবদ্ধতা আরোপ ও জোরদার করছে স্বাধীনতার বিষয়ে দ্বিমুখী বা কপটতার নীতি প্রয়োগ করে।
একইভাবে ভারতে ১০ এপ্রিল যে রাম নবমী পার্বণ হয়ে গেল, তার আগে বেশ কয়েকদিন ধরে একের পর এক নেতাদের মুখে চরম ঘৃণাসূচক বিবৃতি শোনা গেছে। সংবাদে প্রকাশ, কয়েকটি রাজ্যে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা পর্যন্ত হয়েছে। মানুষ মারা গেছে।
দক্ষিণের হায়দরাবাদ শহরে কট্টর হিন্দু দল বিজেপির একজন এমপি- যাকে ২০২০ সালে ঘৃণা ছড়ানোর দায়ে ফেসবুকে নিষিদ্ধ করা হয়, তিনি নিজের গলায় একটি গান গেয়েছেন। সেই গানের কথা ছিল- ‘যে মানুষ হিন্দু দেবতা রামের নাম করবে না, তাকে ভারত থেকে বের করে দেওয়া হবে।’
তার কয়েকদিন আগে, অনলাইনে ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিওতে দেখা যায়, উত্তর প্রদেশ রাজ্যের একজন হিন্দু ধর্মগুরু প্রকাশ্যে মুসলিম নারীদের অপহরণ এবং ধর্ষণের হুমকি দিচ্ছেন। ওই ভিডিও নিয়ে হৈচৈ শুরু হলে এক সপ্তাহ পর পুলিশ একটি মামলা দায়ের করে এবং বুধবার ওই গুরুকে আটক করে।
প্রায় একই সময়ে ইয়াতি নরসিংঘানান্দ সরস্বতী নামে আরেক বহুল পরিচিত একজন হিন্দু ধর্মগুরু রাজধানী দিল্লিতে এক অনুষ্ঠানে দেওয়া ভাষণে অস্তিত্ব রক্ষার জন্য হিন্দুদের হাতে অস্ত্র তুলে নেওয়ার ডাক দেন। এই গুরুর বিরুদ্ধে আগেও এমন ঘৃণা ছড়ানোর অভিযোগে মামলা হয়েছে এবং তিনি সেই মামলায় এখন জামিনে রয়েছেন। পুলিশ বলেছে, যে অনুষ্ঠানে মি. সরস্বতী ভাষণ দিয়েছে, তার কোনো অনুমতি ছিল না এবং তিনি তার জামিনের শর্ত ভেঙেছেন। কিন্তু তারপরও ওই গুরুর বিরুদ্ধে এখনও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
১৯৯০ সালে ভারত শাসিত কাশ্মীরের কিছু মসজিদে হিন্দুবিরোধী ঘৃণাসূচক বক্তব্য দেওয়ার পর সেখানে সহিংসতা শুরু হয়, যার পরিণতিতে দলে দলে হিন্দুরা কাশ্মীর ছাড়ে। ওই একই বছর বিজেপি নেতা লালকৃষ্ণ আদভানি অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ চত্বরে রাম মন্দির নির্মাণের আন্দোলন শুরুর ঘোষণা দেওয়ার পর দলবদ্ধ হিন্দুরা কয়েকশ’ বছরের পুরোনো মসজিদটি গুঁড়িয়ে দেয়, যার পরিণতিতে ব্যাপক হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা শুরু হয়ে যায়। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সাম্প্রদায়িক ঘৃণা ছড়ানো ও বক্তব্য-বিবৃতি দেয়ার প্রবণতা অনেক বেড়ে গেছে। সোশ্যাল মিডিয়ার কারণে ঘৃণা ছড়ানো অনেক সুবিধা হয়ে গেছে। এমনকি ছোটখাটো রাজনীতিকদের কথাবার্তাও সোশ্যাল মিডিয়া এবং টিভি চ্যানেলগুলোর সুবাদে ব্যাপক প্রচার পাচ্ছে এবং এসব অখ্যাত লোকও সহজে নিজেদের পরিচিত করে তুলতে তার সুযোগ নিচ্ছে- এমনটি বলছিলেন বিবিসির এক স্বাক্ষাৎকারে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী নীলাঞ্জন সরকার। ফলে, তিনি বলছেন, ঘৃণাসূচক বক্তব্য-বিবৃতির ‘বিরতিহীন বিস্তার ঘটছে।’
‘আগে সাধারণত নির্বাচনের আগে এসব ঘৃণাসূচক কথাবার্তা শোনা যেত। কিন্তু এখন মিডিয়া জগতের নতুন যে চালচিত্র, তাতে রাজনীতিকরা বুঝতে পেরেছেন যে, একটি রাজ্যে এ ধরনের বক্তব্য দিলে অন্য রাজ্যেও নিজের দলের লোকজনের সুবিধা হবে’, বলছেন মি. সিরকার।
টিভি নিউজ চ্যানেল এনডিটিভি ২০০৯ সালে ‘ভিআইপি হেট স্পিচ’ নামে একটি কর্মসূচি নেয়, যেখানে তারা বড় বড় রাজনীতিকদের- মন্ত্রী, এমপির ঘৃণাসূচক বক্তব্য-বিবৃতির ওপর নজর রাখে। জানুয়ারি মাসে এনডিটিভি জানায়, ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদির সরকার ক্ষমতায় আসার পর এই প্রবণতা কয়েক গুণ বেড়ে গেছে। বেশ ক’জন শীর্ষ বিজেপি নেতা- যাদের মধ্যে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীরাও রয়েছেন- এসব সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষমূলক বিবৃতি দিয়েও সহজে পার পেয়ে গেছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, সাম্প্রদায়িক ঘৃণা ছড়ানোর বিরুদ্ধে ভারতে যথেষ্ট আইন রয়েছে। ‘কিন্তু সেই আইন প্রয়োগের জন্য প্রতিষ্ঠান দরকার এবং অধিকাংশ সময় এসব প্রতিষ্ঠান এ নিয়ে মাথা ঘামাতে চায় না’, বলেন সিনিয়র আইনজীবী অঞ্জনা প্রকাশ; যিনি গত ডিসেম্বরে উত্তরাখণ্ড রাজ্যে মুসলিমদের বিরুদ্ধে সহিংসতায় উসকানি দেওয়ার জন্য কয়েকজন হিন্দু ধর্মীয় নেতার বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে পিটিশন করেছেন।
কোন কথা ঘৃণাসূচক আর কোনটি নয়, সে ব্যাপারে ভারতে আইনি ব্যাখ্যা খুব স্পষ্ট নয়। তবে মত প্রকাশের স্বাধীনতায় কিছু ব্যতিক্রমের কথা আইনে বিচ্ছিন্নভাবে রয়েছে। যাতে বলা আছে, কোন কথা বলা যাবে না বা লেখা যাবে না। আইনে এমন কথা বা কাজকে অপরাধ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে যেগুলো ‘বিভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠীর মধ্যে শত্রুতা বাড়িয়ে তুলতে পারে।’ ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো কথা বা কাজের মাধ্যমে ‘কোনো গোষ্ঠীর ধর্মীয় অনুভূতি এবং বিশ্বাসে আঘাত করা’ ভারতে দণ্ডনীয় অপরাধ। ঘৃণা ছড়ানোর বিভিন্ন মামলা মাঝেমধ্যেই আদালতে আসে। কিন্তু মত প্রকাশের স্বাধীনতার প্রশ্নে আদালতের মধ্যে একটি দ্বিধা কাজ করে।
ভারতের সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আদিত্য ভর্মার মতে, সবচেয়ে বড় উদ্বেগ যেটি, তা হলো প্রতিষ্ঠানের স্বাধীনতা। তিনি ব্রিটেনের উদাহরণ টানেন, যেখানে কোভিড বিধিনিষেধ ভেঙে পার্টি করার জন্য পুলিশ প্রধানমন্ত্রী জনসনকেও জরিমানা করেছে। কিন্তু ভারতে রাজনৈতিক চাপে পুলিশ তাদের দায়িত্ব পালনে অনীহা দেখাচ্ছে- এমন ঘটনা খুবই স্বাভাবিক।
অনেক সিনিয়র বিজেপি নেতা এমনকি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বিরুদ্ধেও মুসলিমদের বিরুদ্ধে ধর্মীয় বিদ্বেষমূলক বক্তব্য দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। ‘হয়তো আইনে কিছু অস্পষ্টতা রয়েছে; কিন্তু তার চেয়েও যেটা বড় সমস্যা তা হলো যেটি কালো অক্ষরে আইনে এরই মধ্যে লেখা আছে সেটাও তো প্রয়োগ হচ্ছে না’, বলেন মি ভর্মা।
আইনজীবী অঞ্জনা প্রকাশ বলেন, প্রতিষ্ঠানের এই ‘বিধান পালন না করার’ যে প্রবণতা তার ভয়াবহ পরিণতি রয়েছে। ‘যিনি হিংসা ছড়াচ্ছেন, তাকে যদি আপনি শাস্তি না দেন, তাহলে আইন কীভাবে অপরাধ ঠেকাবে?’
বিশেষজ্ঞরা বলেন, ঘৃণা ছড়ানোর প্রবণতা সমাজে যখন স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়, তার পরিণতি ভয়াবহ। ‘যখন পরিবেশ পরিস্থিতি অসহনীয় হয়ে ওঠে, মানুষ যখন চরম ভীতি-উসকানির মধ্যে জীবনযাপন করতে থাকে, তখন সে তার স্বাভাবিক জীবনযাপন, জীবিকা থেকেও নিজেকে গুটিয়ে নিতে শুরু করে’, বলেন মি. সিরকার। সেটাই, তার মতে, কোনো সমাজ এবং রাষ্ট্রের ‘সবচেয়ে বড় ক্ষতি।’
লেখক : সহসম্পাদক, আলোকিত বাংলাদেশ; পিএইচডি গবেষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়