ঢাকা সোমবার, ১৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ৩০ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

আয়া সোফিয়া : ইতিহাস ও ভূরাজনৈতিক তাৎপর্য

ড. মোহাম্মদ ছিদ্দিকুর রহমান খান
আয়া সোফিয়া : ইতিহাস ও ভূরাজনৈতিক তাৎপর্য

ইউরোপ ও এশিয়ার সঙ্গমস্থলে অবস্থিত দেশ তুরস্কের সাবেক রাজধানী ইস্তানবুল (ইস্তাম্বুল)। ইস্তানবুল শহরের ফাতিহ এলাকায় অবস্থিত বিশ্বখ্যাত ‘আয়া সোফিয়া’ যা ‘হাজিয়া সোফিয়া’ নামেও পরিচিত। এক সময় এটি ছিল খ্রিষ্টান বিশ্বের প্রধান ধর্মীয় উপাসনালয়। পঞ্চদশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে বিশ শতকের ত্রিশের দশক পর্যন্ত এটি ছিল তুরস্কের মুসলমানদের অন্যতম প্রধান মসজিদ। ১৯৩৪ সালে তুরস্ক প্রজাতন্ত্রের প্রথম প্রেসিডেন্ট মুস্তফা কামাল আতাতুর্ক (১৮৮১-১৯৩৮) একে মসজিদ থেকে জাদুঘরে রূপান্তরিত করেন। গত ১০ জুলাই ২০২০ শুক্রবার তুরস্কের প্রশাসনিক আদালত এক ঐতিহাসিক রায়ের মাধ্যমে আয়া সোফিয়াকে জাদুঘর থেকে আবার মসজিদে রূপান্তরিত করার নির্দেশ দেন। প্রশাসনিক আদালতের উপর্যুক্ত রায়ের পর দীর্ঘ ৮৬ বছর পর আয়া সোফিয়ার সুউচ্চ মিনার থেকে আজানের ধ্বনি উচ্চারিত হয়। এ সময় আয়া সোফিয়ার উন্মুক্ত চত্বর ও আশপাশের এলাকায় সমবেত তুর্কিরা জাতীয় পতাকা হাতে নিয়ে আল্লাহু আকবর ধ্বনিতে মুখরিত করে তোলে সেখানকার পরিবেশ।

গ্রিক বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল ঐতিহাসিক কনস্টান্টিনোপল নগরী। এ শহরেই সম্রাট প্রথম জাস্টিনিয়ান ৫৩৭ খ্রিষ্টাব্দে ‘আয়া সোফিয়া’ নামে একটি ক্যাথেড্রাল বা অর্থোডক্স গির্জা নির্মাণ করেন। গ্রিক পুরাণ মতে, ‘সোফিয়া’ হচ্ছেন জ্ঞানের দেবী। আর গ্রিক ভাষার ‘আয়া সোফিয়া’কে অনুবাদ করলে এর অর্থ দাঁড়ায় ‘পবিত্র জ্ঞান’। ১২০৪ খ্রিষ্টাব্দে চতুর্থ ক্রুসেডের মাধ্যমে ইউরোপের ক্যাথলিক খ্রিষ্টানরা কনস্টান্টিনোপল দখল করে নিলে ৫৭ বছরের জন্য আয়া সোফিয়া ‘ক্যাথলিক গির্জায়’ রূপান্তরিত হয়েছিল। ১২৬১ খ্রিষ্টাব্দে ক্যাথলিকদের পরাজয়ের ফলে আয়া সোফিয়া আবারও অর্থোডক্স গির্জায় রূপান্তরিত হয়। আয়া সোফিয়া ছিল পূর্বাঞ্চলীয় অর্থোডক্স খ্রিষ্টানদের প্রধান ধর্মীয় কেন্দ্রবিন্দু। এটি বাইজান্টাইনদের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক কেন্দ্রও ছিল। বাইজান্টাইন সম্রাটদের রাজমুকুট সংরক্ষণ ও তাদের রাজ্য অভিষেকসহ বিভিন্ন রাজকীয় অনুষ্ঠানের কাজেও আয়া সোফিয়াকে ব্যবহার করা হতো।

১৪৫৩ সালে উসমানী সুলতান দ্বিতীয় মুহাম্মদ সম্রাট একাদশ কনস্টান্টাইন প্যালিওলোগাসকে পরাজিত ও হত্যা করে মধ্যযুগের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শহর কনস্টান্টিনোপল অধিকার করেন। এই গৌরবময় বিজয়ের ফলে দ্বিতীয় মুহাম্মদকে ‘ফাতিহ’ বিজেতা উপাধি দেওয়া হয়। কনস্টান্টিনোপলের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান ও গুরুত্ব বিবেচনা করে দ্বিতীয় মুহাম্মদ একে উসমানী সালতানাতের রাজধানী করেন। এর নতুন নামকরণ করা হয় ‘ইস্তাম্বুল’ (বর্তমান ইস্তানবুল)।

সুলতান নগরীতে অবস্থিত বিখ্যাত ‘আয়া সোফিয়া গির্জা’টিকে মসজিদে রূপান্তরিত করার জন্য ব্যক্তিগত অর্থে খ্রিষ্টানদের কাছ থেকে এটি ক্রয় করেন। এরপর সুলতান একটি ওয়াকফ অ্যাসোসিয়েশন গঠন করে আয়া সোফিয়াকে এর মালিকানায় হস্তান্তর করেন। সুলতান ও তার সঙ্গীদের নামাজ আদায়ের মধ্য দিয়ে আয়া সোফিয়াকে অর্থোডক্স গির্জা থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে মসজিদে রূপান্তরিত করা হয়। ১৬১৭ সালে Blue Mosque বা ‘সুলতান আহমেদ মসজিদ’ নির্মাণের আগ পর্যন্ত এটি ছিল ইস্তাম্বুলের প্রধান রাজকীয় মসজিদ।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯২৩ সালে তুরস্কে উসমানী সালতানাত এবং ১৯২৪ সালে খেলাফত উচ্ছেদ করা হয়। তুর্কি প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্ট মুস্তফা কামাল পাশা তুরস্ককে একটি আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে পরিণত করেন। অনেক মসজিদের দ্বার তিনি বন্ধ করে দেন। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৩৪ সালে প্রেসিডেন্ট মুস্তফা কামাল পাশা ৪৮২ বছর ধরে মসজিদ হিসেবে ব্যবহৃত আয়া সোফিয়াকে একটি জাদুঘরে রূপান্তর করেন।

আয়া সোফিয়াকে জাদুঘরের রূপান্তরের প্রতিক্রিয়া হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে তুরস্কের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে টানাপড়েন চলছে। আয়া সোফিয়াকে জাদুঘরে রূপান্তর করার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে তুরস্কে ডানপন্থি রাজনৈতিক দল ও ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা শুরু থেকে প্রতিবাদ এবং একে মসজিদে পুনঃরূপান্তরের দাবি অব্যাহত রেখেছে। অন্যদিকে কামালপন্থি সেকুলাররা তুরস্কের ধর্মনিরপেক্ষতার দোহাই দিয়ে আয়া সোফিয়াকে জাদুঘর হিসেবে রাখার পক্ষে জোরালো মত দিয়ে এসেছে। ইসলামপন্থি একে পার্টি ক্ষমতায় আসার পর ২০০৫ সালে সর্বপ্রথম এ আয়া সোফিয়াকে মসজিদে পুনঃরূপান্তরের দাবিতে Permanent Foundation Service to Historical Artifacts and Environment Association নামক একটি সংগঠন আদালতে মামলা করে। মামলার আরজিতে বলা হয়েছিল- আয়া সোফিয়া একটি ওয়াকফ সম্পত্তি। এটি সুলতান মুহাম্মদ ফাতিহর ব্যক্তিগত অর্থে ক্রয় করে মসজিদের জন্য ওয়াকফ করেছিলেন। সুতরাং একে মসজিদের পরিবর্তে জাদুঘরের কাজে ব্যবহার অবৈধ। তিন বছর মামলাটি চলার পর ২০০৮ সালে আদালত এ মামলাটি খারিজ করে দেন। মামলা খারিজ হয়ে গেলেও বাদীপক্ষ আয়া সোফিয়াকে মসজিদে পুনঃরূপান্তরের পক্ষে জনমত তৈরির অব্যাহত চেষ্টা চালিয়ে যায়। প্রেসিডেন্ট এরদোগান বরাবরই একে মসজিদে পুনঃরূপান্তরের পক্ষে ছিলেন।

এরূপ একটি বাস্তবতায় পূর্বোক্ত সংগঠনটি আবারও আদালতের শরণাপন্ন হয়। আদালত শুনানি শেষে ১০ জুলাই ঐতিহাসিক রায়ে বলেন, ‘১৯৩৪ সালে মন্ত্রিসভার যে সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মসজিদ থেকে আয়া সোফিয়াকে জাদুঘরে রূপান্তরিত করেছিল, তা আইন মেনে করা হয়নি।’ অতএব আদালত ওই সিদ্ধান্ত বাতিল করে আয়া সোফিয়াকে আবার মসজিদে রূপান্তর করার আদেশ দেন। ওই দিনই দেশটির প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান আয়া সোফিয়াকে মসজিদে পুনঃরূপান্তরের ডিক্রিতে স্বাক্ষর করেন। অবশ্য প্রেসিডেন্ট এরদোগান স্পষ্ট করেই বলে দিয়েছেন, ভবনটির সাংস্কৃতিক মূল্য বজায় রাখার স্বার্থে আয়া সোফিয়ার দ্বার জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সবার জন্য উন্মুক্ত রাখবে।

আয়া সোফিয়াকে মসজিদে পুনঃরূপান্তর নিয়ে তুরস্কের অভ্যন্তরে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। তুরস্কের সংখ্যাগরিষ্ঠ তুর্কি এবং প্রায় সব রাজনৈতিক দল এ সিদ্ধান্তকে সমর্থন ও স্বাগত জানিয়েছে। বিরোধী রাজনৈতিক দল কামালপন্থি সিএইচপির পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিক কোনো অফিসিয়াল বক্তব্য দেওয়া হয়নি। তবে অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, এ বিষয়ে বিরোধিতা করে সোচ্চার হওয়ার তাদের খুব বেশি অবকাশ নেই। অবশ্য সংখ্যায় কম হলেও তুর্কি জনমতের একটি অংশ মনে করে খ্রিষ্টান ও মুসলিম সংহতির প্রতীক হিসেবে আয়া সোফিয়াকে জাদুঘর হিসেবে রাখাই ভালো ছিল। ইস্তানবুলে অবস্থিত পূর্বাঞ্চলীয় অর্থোডক্স খ্রিষ্টান গির্জার প্রধান প্যাট্রিয়ার্ক প্রথম বার্থোলোমিউ আদালতের রায় ঘোষণার আগে সতর্ক করে দিয়েছিলেন যে, এ ভবনকে মসজিদে পরিণত করা হলে সারা পৃথিবীর লাখ লাখ খ্রিষ্টান মর্মাহত হবে এবং দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভক্তি দেখা দেবে।

গ্রিস, রাশিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রভৃতি দেশ আয়া সোফিয়াকে মসজিদে পুনঃরূপান্তরের তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। একে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট ঘোষণাকারী ইউনেস্কোও এর প্রতিবাদ জানিয়েছে। এ সিদ্ধান্ত সাম্প্রদায়িক বিভক্তি ও তিক্তা বাড়াবে বলে রাশিয়ার অর্থোডক্স খ্রিষ্টানরা দাবি করছে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও আয়া সোফিয়ার এ পরিবর্তন দুই ভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষের বিশ্বাস ও সংস্কৃতির ঐক্য বিনষ্ট করবে বলে উল্লেখ করেছেন। মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মর্গেন ওরতাগাসের এক বিবৃতিতে বলেন, এ সিদ্ধান্তে তার দেশ ‘হতাশ’ হয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রনীতি প্রধান জোসেফ বোররেল একে ‘দুঃখজনক’ বলে অভিহিত করেছেন। গ্রিসের সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রী লিনা মেনদোনি বলেছিলেন, তুরস্ক উগ্র জাতীয়তাবাদী ও ধর্মীয় চেতনা জাগিয়ে তুলতে চাইছে।

আদালতের রায় ঘোষণার পর গ্রিসের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় এ সিদ্ধান্তের তীব্র নিন্দা করে বলেছে, সুসভ্য পৃথিবীর জন্য এটি একটি উসকানি। আয়া সোফিয়ার প্রশ্নে গ্রিসের অবস্থানের কড়া জবাব দিয়েছে তুর্কি সরকারও। তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী চাভুসোগলু এ বিষয়ে ‘ভাষণ’ না দেওয়ার জন্য আগেই গ্রিসকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন। তিনি গ্রিসকে মনে করিয়ে দিয়েছেন ‘এথেন্স’ই ইউরোপের একমাত্র রাজধানী, যেখানে কোনো মসজিদ নেই। এ বিষয়ে তুর্কি প্রেসিডেন্টের মনোভাবও বেশ কড়া। প্রেসিডেন্ট এরদোগান বলেছেন, ‘আয়া সোফিয়া মসজিদের ব্যাপারে তুরস্কের বিরুদ্ধে গ্রিসের কর্মকর্তাদের অভিযোগ তুরস্কের জাতীয় সার্বভৌমত্বের ওপর সরাসরি আঘাত।’

শুধু গ্রিস নয়, আয়া সোফিয়াকে ঘিরে আন্তর্জাতিক সমালোচনাকে পাত্তা দিচ্ছেন না এরদোগান। উল্টো তুরস্কের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে বহির্বিশ্বকে নাক গলাতে নিষেধ করেছেন তিনি। প্রেসিডেন্ট বলেছেন, তুরস্কে মুসলিমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও এখানে বসবাসরত অন্যান্য ধর্মাবলম্বীও সমান স্বাধীনতা ভোগ করে। এরদোগান বলেন, তার দেশে ৪৩৫টি গির্জা ও ইহুদিদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান সিনাগগ রয়েছে। সব ধর্মাবলম্বী এখানে নির্বিঘেœ ও স্বাধীনভাবে তাদের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালন করেন। প্রেসিডেন্ট বলেন, আয়া সোফিয়া তুরস্কের সম্পদ; যার সম্পদ সে কী তাকে জাদুঘর নাকি মসজিদ বানাবে সেটি তারই এখতিয়ার। এ প্রসঙ্গে তিনি স্মরণ করিয়ে দেন যে, স্পেনেও তো অনেক মসজিদকে পরবর্তী সমযে গির্জা বানানো হয়েছে। এরদোগান আরও বলেন, পৃথিবীতে লাখ লাখ মানুষ ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে নিহত এবং অসংখ্য মানুষ নানা ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। আমাদের উচিত সেগুলো বন্ধ করায় মনোযোগী হওয়া।

আয়া সোফিয়াকে মসজিদে পুনঃরূপান্তরের ফলে তুরস্কের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে দেশটির অবস্থান কী হবে? এর অর্থনৈতিক প্রতিক্রিয়াই বা কেমন হবে?- এসব নিয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও পর্যবেক্ষকদের মধ্যে চলছে নানা বিচার-বিশ্লেষণ। কেউ কেউ একে দেখছেন এরদোগানের নেওয়া একটি মারাত্মক ভুল সিদ্ধান্ত হিসেবে। খ্রিষ্টান ও মুসলমান সম্প্রদায়েরই ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক আবেগ অনুভূতির স্থানকে কেন্দ্র করে গৃহীত সিদ্ধান্তে এক পক্ষ খুশি হলেও বিশ্বের একটি বড় জনগোষ্ঠী অখুশি হবে। তুরস্কের ওপর এর দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। কেউ কেউ মনে করছেন, এ ঘটনাটি ভবিষ্যতে একটি বাজে নজির হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে। এর ফলে বাবরি মসজিদ ও আল-আকসা মসজিদ নিয়ে মুসলমানরা কথা বলার নৈতিক অধিকার হারালেন। এমনকি তারা মনে করেন, এর ফলে এরদোগান-মোদি-নেতানিয়াহুর মধ্যে আর কোনো পার্থক্য থাকল না। তুরস্কের চলমান অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ, উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও বেকারত্বের ফলে সৃষ্ট পরিস্থিতে জনমতকে অন্য খাতে প্রবাহিত করার কৌশল হিসেবে প্রেসিডেন্ট এরদোগান এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে কেউ কেউ মনে করছেন।

তুরস্কের ভূ-রাজনীতি বিশেষত সাইপ্রাস ও ভূমধ্যসাগর ইস্যুতে গ্রিস-ইসরাইল জোটের সঙ্গে বিরোধ, লিবিয়া ও সিরিয়া ইস্যুতে আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সর্বশেষ মসজিদে আকসা-ফিলিস্তিন ইস্যুতে তুরস্কের বর্তমান ভূমিকার প্রেক্ষাপটে আয়া সোফিয়াকে নিয়ে এ সময়ে তুরস্কের এমন সিদ্ধান্তকে অন্য ইঙ্গিতবহ বলেও কেউ কেউ মনে করেন। আগামীর তুরস্কের রাজনীতি যে আরও প্রো-ইসলামিক হবে, এটি খুব ভালোভাবেই বোঝা যাচ্ছে বলে তাদের ধারণা। আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক সোনার ক্যাগাপ্তের বক্তব্যেও এ মত প্রতিফলিত হয়েছে। তার মতে, কামাল আতাতুর্কের ধর্মনিরপেক্ষ বিপ্লবের প্রত্যক্ষ বিরোধিতা করে এরদোগান তার ইসলামের ব্র্যান্ড চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টায় এমনটি করেছেন। তিনি বলেন, আতাতুর্ক ৮৬ বছর আগে ধর্মনিরপেক্ষতা প্রতিষ্ঠা করার জন্য এটিকে জাদুঘরের মর্যাদা দিয়েছিলেন, তেমনি এরদোগান ধর্মীয় বিপ্লবকে সামনে আনার জন্য একে আবারও মসজিদ বানিয়েছেন।

কেউ কেউ মনে করেন যে, তুরস্কের একটি জাদুঘরকে মসজিদে পরিণত করার রায়ে পাশ্চাত্য দুনিয়া যে প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে, তা মতলবি চিন্তাপ্রসূত। আয়া সোফিয়া ইস্যুটি সরব হলেও পশ্চিমতীরে ইসরাইলের অবৈধ বসতি স্থাপন ও ফিলিস্তিনি নিধন, কাশ্মীরে দমনপীড়ন কিংবা ভারতের এনআরসির বিরুদ্ধে তাদের কথা বলতে দেখা যায় না। এটি কাম্য নয়। আয়া সোফিয়াকে মসজিদে পুনঃরূপান্তরের ফলে তুরস্কের অর্থনীতিসহ নানা সেক্টরে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। এ সিদ্ধান্ত দেশটির পর্যটন শিল্পে মারাত্মক প্রভাব ফেলবে বলেও আশঙ্কা করা হচ্ছে। তবে এরূপ আশঙ্কা কতটুকু সত্য হবে, তা এখনই নিশ্চিত করে বলা যায় না। তা ছাড়া উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায়, আয়া সোফিয়াকে মসজিদে পুনঃরূপান্তরের ফল ভবিষ্যৎ প্রেসিডেন্ট এরদোগান বা তুরস্কের জন্য কেমন হবে? শুভ নাকি অশুভ? এ প্রশ্নের চূড়ান্ত জবাব দেওয়ার এখনও সময় আসেনি। এ জন্য অপেক্ষা করতে হবে। প্রেসিডেন্ট এরদোগান কতটা বিচক্ষণতার সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে পারবেন, তুর্কি জনমত তাকে কতটা সমর্থন জানাবে এবং সর্বোপরি মুসলিম বিশ্বসহ এরদোগানের বিশ্বমিত্ররা এ প্রশ্নে কীভাবে তার পাশে থাকবে- এর ওপরই নির্ভর করছে এরদোগান ও তুরস্কের ভবিষ্যৎ।

লেখক : অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি

বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত