ঢাকা বুধবার, ২১ মে ২০২৫, ৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

আফগানিস্তানে তালেবান সরকারের এক বছর

অধ্যাপক শাব্বির আহমদ
আফগানিস্তানে তালেবান সরকারের এক বছর

গেল ১৫ আগস্ট দেশ শাসনের এক বছর পূর্ণ করল আফগানিস্তানের তালেবান সরকার। গত এক বছরে তালেবান সরকারের হাতে আফগানিস্তান কেমন ছিল- এ নিয়ে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যম ও রাজনীতি বিশ্লেষক মহলে দেখা গেছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। বিবিসি, সিএনএনসহ পশ্চিমা মিডিয়া ও বিশ্লেষকদের বর্ণনায় দেখা গেছে রাষ্ট্র পরিচালনায় তালেবান সরকারের ব্যর্থতা ফুটিয়ে তোলার নিরন্তর প্রচেষ্টা। তাদের মতে, ক্ষমতা দখলের মুহূর্তে তালেবান যে কথা দিয়েছিল, সেটি তারা রাখেনি। বরং তালেবান শাসনের এক বছরে আফগানিস্তানের জনগণের ভাগ্যে যুক্ত হয়েছে নতুন দুঃখণ্ডদুর্দশা। তাদের মতে, দেশটিতে নাজুক অর্থনীতির কারণে জীবনযাত্রার মান কোন তলানিতে ঠেকেছে, তার ইয়ত্তা নেই। দেখা দিয়েছে মানবিক সংকট। তালেবানদের নিষেধাজ্ঞার খ—গ নেমে এসেছে নারীদের জীবনে। নারীদের অধিকার কঠোরভাবে সীমিত করেছে তালেবান। নারীদের একাকী বাইরে বের হতে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। সরকারি কাজ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এমনকি মেয়েদের স্কুল-কলেজও বন্ধ করে দিয়েছে তালেবান। তবে, কাতারভিত্তিক গণমাধ্যম আলজাজিরাসহ অনেক বিশ্লেষক আফগানিস্তানের ক্ষমতার দৃশ্যপটে তালেবানের পুনরুত্থানের এক বছরে সংকট আরও গভীর হয়েছে বলে স্বীকার করলেও অর্থনৈতিক দুরবস্থার জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলোতে রক্ষিত অর্থ আটকে দেওয়াকেও দায়ী করা হয়েছে। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রসহ জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞা থাকায় আফগান ব্যাংকগুলোকে আন্তর্জাতিক অর্থব্যবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে হচ্ছে এবং বিশ্বের ব্যাংকিং সিস্টেম আফগানিস্তানে সরাসরি কাজ করতে পারছে না। এ সত্ত্বেও ৪০ বছরের মধ্যে এই প্রথম একটি কেন্দ্রীয় সরকার গোটা দেশের নিয়ন্ত্রণ নিতে পেরেছে- তার জন্য তালেবান সরকারের প্রশংসা করা হয়েছে আলজাজিরাসহ বিভিন্ন গণমাধ্যম ও একশ্রেণির আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষক।

২০২১ সালের ১৫ আগস্ট ক্ষমতায় এসেই বড় ধরনের অর্থনৈতিক সংকটে পড়তে হয় তালেবান সরকারকে। খাদ্যদ্রব্যসহ বিভিন্ন নিত্যপণ্যের দাম এত বেশি বেড়ে যায় যে, আফগানদের পক্ষে তা কেনা কঠিন হয়ে পড়ে। অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় দেশটির প্রয়োজন ছিল রিজার্ভের অর্থে খাদ্য কিনে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া। কিন্তু তালেবান সরকার তা করতে পারেনি। কারণ, অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপের ফলে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন পশ্চিমা দেশের ব্যাংকে থাকা আফগান সরকারের সাড়ে ৯ বিলিয়ন ডলার আটকে যায়। তালেবান সরকারের অভিযোগ, যুক্তরাষ্ট্রের কারণেই অন্য দেশের কূটনৈতিক স্বীকৃতি পাচ্ছে না তারা। শুধু তাই নয়, সাহায্য পাঠালেও নিকট প্রতিবেশী রাষ্ট্র পাকিস্তান, মুসলিম বিশ্বের প্রভাবশালী দেশ সৌদি আরব, তুরস্ক, চীন কেউ তাদের স্বীকৃতি দেয়নি। ফলে তালেবান প্রশাসন বহির্বিশ্বে দূতাবাস স্থাপন, কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা, ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করতে পারছে না। আগেরবার তালেবান সরকার পাকিস্তান, সৌদি আরব আর সংযুক্ত আরব আমিরাতের স্বীকৃতি পেয়েছিল। তবে এবার চিত্র অন্যরকম। কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বর্তমান তালেবান সরকারের বিষয়ে স্বীকৃতি প্রদানে ইচ্ছুক দেশগুলো সবার সঙ্গে বসে সিদ্ধান্ত নিতে চায়। ফলে কোনো কোনো দেশ সম্পর্ক রাখছে ঠিকই; কিন্তু নতুন সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার আগে সতর্ক থাকছে। এ ক্ষেত্রে কেউই প্রথম হতে চায় না।

তালেবান ক্ষমতায় আসার পর থেকে দেশটিতে বিক্ষিপ্ত কিছু বিক্ষোভ দেখা গেছে। তবে ভিন্নমতাবলম্বীদের এসব বিক্ষোভ শক্ত হাতে দমন করেছে তালেবান। এর আগে ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত তালেবানের প্রথম শাসনামলে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা সর্বত্র আলোচিত ছিল। ওই সময় নিষিদ্ধ করা হয়েছিল মেয়েদের শিক্ষা। যদিও এবার ক্ষমতায় এসে ভিন্নভাবে দেশ পরিচালনার ঘোষণা দিয়েছিল তালেবান। পশ্চিমাদের অভিযোগ, তালেবান কথা দিয়ে কথা রাখেনি। তাদের সরকারে কোনো নারী সদস্য নেই। এমনকি, এক বছরের শাসনকালে তারা সরকারি চাকরি থেকে যেসব নারীকে প্রত্যাহার করেছিল, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাদের পুনর্বহাল করেনি। মাঝে ছেলেদের স্কুল খুলে দেওয়া হলেও মেয়েদের মাধ্যমিক স্কুল বন্ধ করে রাখা হয়। সম্প্রতি সেভ দ্য চিলড্রেনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তালেবানের এক বছরের শাসনামলে দেশটির নারীরা আরও বেশি সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছে। ক্ষুধার পাশাপাশি হতাশায় তারা জর্জরিত। বিশেষ করে আগের দুই দশকে নারী শিক্ষা ও অধিকারের ক্ষেত্রে আফগানিস্তানের যে অগ্রগতি অর্জিত হয়েছিল, তা এক বছরে ধূলিসাৎ হয়ে গেছে।

তবে তালেবান সরকার বলছে, তারা ইসলামি আইন ও আফগান সংস্কৃতির সীমানার মধ্যে থেকে নারীসহ সব নাগরিকের অধিকার নিশ্চিত করছেন। আর তাদের প্রতি যেহেতু জনগণের সমর্থন আছে, তাই তাদের সরকার জনগণের সরকার। সুতরাং তাদের সরকারের বৈশ্বিক স্বীকৃতি পাওয়া উচিত। গত ১২ ডিসেম্বর এক বছরে আফগানিস্তানের বাস্তব চিত্র এবং তাদের দায়বদ্ধতা নিয়ে আলজাজিরার সঙ্গে কথা বলেছেন তালেবানের শীর্ষ নেতা আনাস হাক্কানি। তার কাছে প্রশ্ন ছিল, আপনার সরকার ১ বছর ধরে দায়িত্ব পালন করছে, আপনাদের অর্জন আর ব্যর্থতাগুলো কী কী? আনাস হাক্কানি বলেছেন, গত ১ বছরে, আমরা অনেক ক্ষেত্রে উন্নয়নের জন্য কাজ করেছি। বিদেশিদের হাত থেকে দেশের স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনার পাশাপাশি, বিদেশিদের হস্তক্ষেপ, অন্যায় ও নিপীড়ন থেকে দেশকে মুক্ত করেছি। দখলের অধীনে থাকা যেকোনো মানুষ বা দেশ এটাই চায়। এটা আমাদের জন্য গর্বের উৎস, আশীর্বাদও বটে। আনাস হাক্কানি বলেন, আমাদের দেশ বিশাল পরিবর্তনের দিকে এগোচ্ছে। ৪০ বছরের মধ্যে এই প্রথম একটি কেন্দ্রীয় সরকার গোটা দেশের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। দেশের প্রতিটি কোনায়, ইঞ্চি, ইঞ্চি তালিকা করার জন্য আরও অনেক কিছু করার বাকি আছে। তবে এটি উল্লেখ করা গুরুত্বপূর্ণ যে, বাধ্যতামূলক শুল্ক যেগুলো আগে মানুষের ওপর আরোপ করা হতো তা এখন আর নেই। দেশে আর কোনো বিশেষ জঙ্গিগোষ্ঠী কাজ করছে না। কেন্দ্রীয় সরকার, কোনো শুল্ক বা বিদেশি সাহায্য ছাড়াই সব প্রতিষ্ঠানের সরকারি কর্মচারীদের বেতন দিতে সক্ষমতা অর্জন করেছে। হাক্কানি বলেন, গত ২০ বছর ধরে আফগানিস্তানকে নিয়ন্ত্রণ করছে বিদেশি শক্তি, তাদের উন্নত প্রযুক্তি, সামর্থ্য এবং সম্পদ দীর্ঘ সময়ের মধ্যেও ব্যর্থ হয়েছে। তারা নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে ব্যর্থ হয়েছে, যা আমাদের জনগণ এখন উপভোগ করছে। আমরা কেবল ১ বছর পার করছি। রাতারাতি সব লক্ষ্য পূরণ বা অর্জন করা যায় না। এটা প্রায় অসম্ভবের কাছাকাছি, বিশেষ করে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আমাদের শাসনের স্বীকৃতি এবং বিদেশি সাহায্যসহ তাদের প্রতিশ্রুতি পূরণ করেনি। তাদের পক্ষে থেকে অসহযোগিতা সত্ত্বেও আমরা আল্লাহর রহমতে অনেক অগ্রগতি লাভ করেছি। এখন আপনি দেখতে পাচ্ছেন যে, মেয়েরা বিশ্ববিদ্যালয় এবং স্কুলগুলোয় যোগদান করছে (প্রদেশগুলোর বেশিরভাগ এখনও উচ্চ বিদ্যালয়ের মেয়েদের শিক্ষার অনুমতি দেয় না)।

আলকায়দা নেতা আয়মান আল জাওয়াহিরি নিহত হওয়ার একদিন পর মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন কর্তৃক ‘কাবুলে আলকায়দার নেতাকে হোস্টিং ও আশ্রয় দিয়ে তালেবান দোহা চুক্তির চরম লঙ্ঘন করেছে’- এই অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে আনাস হাক্কানি সরাসরি কোনো উত্তর না দিয়ে আফগানিস্তানের আকাশে ড্রোন পাঠিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের সার্বভৌমত্ব লংঘন করেছে বলে পাল্টা অভিযোগ করেন।

২০২১ সালে আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ তালেবানের হাতে গেলে দেশটির বিদেশি সাহায্য রাতারাতি বন্ধ হয়ে যায়। আফগানিস্তানের জিডিপির ৪৫ শতাংশ বিদেশি সাহায্যনির্ভর হওয়ায় দেশটি চরম সংকটে পড়ে। একটি বিপ্লবী সরকারকে সবদিক দিয়ে অবরোধ আরোপ করে এক বছরের মাথায় ভালো কিছু আশা করা এক বাতুলতা, যা পশ্চিমারা করছে। এ সত্ত্বেও তালেবান সরকার টিকে থাকায় অনেকের কাছে বিস্ময়ের জন্ম দিয়েছে। বলার অপেক্ষা রাখেনা, চীন, পাকিস্তান, ইরানসহ আফগানিস্তানের কিছু প্রতিবেশী দেশ তালেবানের কূটনীতিকদের মেনে নিয়েছে। এ তালিকায় আরও আছে মালয়েশিয়া, কাতার, সৌদি আরব, রাশিয়া ও তুর্কমেনিস্তান। প্রকৃতপক্ষে আশগাবাট, বেইজিং, ইসলামাবাদ এবং মস্কো আনুষ্ঠানিকভাবে তালেবানদের নিয়োগ করা কূটনীতিকদের স্বীকৃতি দিয়েছে। তেহরানের সঙ্গে সতর্ক যোগাযোগ আছে কাবুলের। সরকারে হাজারা শিয়া সম্প্রদায়কে বাদ রাখায় তেহরান খুশি হতে না পারলেও তালেবানদের সঙ্গে সীমিত অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক চালু রেখেছে। ক্ষমতায় আসার পর পাকিস্তানের সঙ্গে আন্তঃসীমান্ত হামলায় জড়িয়ে পড়লেও তা দ্রুত মিটিয়ে ফেলতে সক্ষম হয় তালেবান সরকার। অনেক বিশ্লেষকের মতে, আফগানিস্তানের ক্ষমতার দৃশ্যপটে তালেবানের পুনরুত্থানের এক বছরে সংকট গভীর হলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে তালেবানরা আশার আলো দেখাচ্ছে। নারীদের বিচরণের ক্ষেত্র ও শিক্ষার সুযোগ সংকুচিত হলেও এবং দরিদ্রতা বাড়লেও এর বিপরীতে দেশটিতে সংঘাত-সহিংসতা কমেছে। বিশেষ করে তালেবান যোদ্ধাদের শক্ত চেইন অব কমান্ড, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ, একশ্রেণির বুদ্ধিজীবীর সোচ্চার অবস্থান এ মুহূর্তে আফগানদের কিছুটা হলেও আশার আলো দেখাচ্ছে। তবে, পশ্চিমা বিশ্ব অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা পুরোপুরি তুলে না নিলে, পর্যাপ্ত বিদেশি সহায়তা না পেলে আফগানিস্তানে দেখা দিতে পারে চরম বিপর্যয়। সুতরাং চলমান সংকট এড়াতে তালেবান সরকারকে নারী শিক্ষা, নারীর ক্ষমতায়ন, অংশগ্রহণ মূলক ও প্রতিনিধিত্বশীল সরকার প্রতিষ্ঠার বিষয়ে উদার মানসিকতা নিয়ে আরও অনেক বিশাল পথ পাড়ি দিতে হবে।

লেখক : অধ্যাপক শাব্বির আহমদ, শিক্ষক, কলামিস্ট ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষক

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত