চীনের শিনজিয়াং প্রদেশে উইঘুর (Uighurs) মুসলিম জনগোষ্ঠীর ওপর জুলুমণ্ডনির্যাতনের অভিযোগ দীর্ঘদিনের। তবে সম্প্রতি বিবিসির এক প্রতিবেদনে প্রত্যক্ষদর্শী ও ভুক্তভোগীর জবানীতে চীনের উইঘুর মুসলিমদের প্রতি যে লোমহর্ষক বিবরণ ফুটে উঠেছে, তা রীতিমতো গা শিহরিত ওঠার মতো। এই নিয়ে তাবৎ বিশ্ব যখন নতুন করে প্রতিবাদে উত্তাল, তারই মাঝে গত ২২ ফেব্রুয়ারি চীনে উইঘুর মুসলিমদের প্রতি অমানবিক আচরণকে গণহত্যা হিসেবে অভিহিত করে কানাডার হাউস অব কমন্সে ২৬৬-০ ভোটে একটি বিল পাস হয়। যুক্তরাষ্ট্রের পর কানাডা হলো দ্বিতীয় দেশ, যারা উইঘুর মুসলিমদের প্রতি চীনা আচরণকে গণহত্যা বলে স্বীকৃতি দিল। গত ২৫ ফেব্রুয়ারি ব্রিটিশ পার্লামেন্টে চীনের এমন আচরণে উদ্বেগ জানানোর পাশাপাশি দেশটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানান পার্লামেন্ট সদস্যরা। এ ধরনের অত্যাচার, নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে বেইজিংয়ে আয়োজিত ২০২২ সালের শীতকালীন অলিম্পিক গেমস বর্জনের আহ্বান জানিয়েছিল মানবাধিকার সংগঠনগুলো। ফলে অনেক দেশ অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকে।
পূর্ব তুর্কিস্তান থেকে শিনজিয়াং
এক সময়ের স্বাধীন পূর্ব তুর্কিস্তানই আজ চীনের শিনজিয়াং। উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত শিনজিয়াং চীনের সর্ববৃহৎ প্রদেশ। আয়তন ১৬ লাখ ৪৬ হাজার ৪০০ বর্গকিলোমিটার, যা বাংলাদেশের প্রায় ১২ গুণ। আয়তনে চীনের প্রায় এক-ষষ্ঠাংশ। এর পশ্চিম ও উত্তর-পশ্চিম দিকে আছে মুসলিম দেশ তাজিকিস্তান, কিরগিজস্তান ও কাজাখস্তান; আর দক্ষিণ-পশ্চিমে আছে আফগানিস্তান ও জম্মু-কাশ্মীর। শিংনজিয়াং প্রদেশের জনসংখ্যা ২ কোটি ২০ লাখের মতো। এর মধ্যে মুসলমান প্রায় ১ কোটি ২৬ লাখ। প্রায় ৫৮ শতাংশ মুসলিম। পূর্ব তুর্কিস্তান ঐতিহাসিকভাবে কখনও চীনের অংশ ছিল না। মধ্যযুগে তাং সাম্রাজ্য দুর্বল হয়ে পড়ার পর থেকেই সেখানে ইসলাম ও আরবের প্রভাব বাড়তে থাকে। ৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দে কারাহানিদ রাজত্বকালে উইঘুররা দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করে।
উইঘুরের বর্ণমালা আরবি। সাংস্কৃতিক দিক থেকে এরা তুর্কি ও আরবি প্রভাবিত। উরুমকি বর্তমান শিনজিয়াংয়ের রাজধানী। কাশগড় অন্যতম বৃহৎ শহর। কারাহানিদ রাজত্বকালে পূর্ব তুর্কিস্থানের রাজধানী ছিল ঐতিহাসিক নগরী কাশগড়। কাশগড় খুব অল্প সময়ের মধ্যে ইসলামি জ্ঞান-বিজ্ঞানের কেন্দ্রভূমিতে পরিণত হয়। শিল্প, সাহিত্য, সংগীত ও বিজ্ঞান ইত্যাদি চর্চার বিখ্যাত সব কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয় কাশগড়ে। কারাহানিদ শাসনামলেই শতাধিক উইঘুর মুসলিম পণ্ডিতের জন্ম হয়, যারা পরে সারা বিশ্বে খ্যাতি অর্জন করেন। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় হাজারও মূল্যবান গ্রন্থ রচিত হয় তখন। যার মধ্যে ইউসুফ আল হাজিব রচিত ‘দ্য নলেজ অব হ্যাপিনেস’ এবং মাহমুদ কাশগড়ি রচিত ‘অ্যা ডিকশনারি অব তুর্ক ল্যাঙ্গুয়েজ’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ১৯৪৭ সালে ঢাকা মাদ্রাসা-ই-আলিয়া ঢাকার যাত্রাকালীন মুফতি আমিমুল এহসানসহ যে ক’জন প্রথিতযশা শিক্ষাবিদ পূর্ব পাকিস্তানে স্থায়ী হয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে পূর্ব তুর্কিস্তানে জন্মগ্রহণকারী মুফতি আল্লামা আবদুর রহমান কাশগড়ী (রহ.) ছিলেন অন্যতম। তাকে বলা হয় ‘উস্তাজুল আসাতিজা’ অর্থাৎ শিক্ষকম-লীর শিক্ষক। ‘মাদ্রাসা-ই-আলিয়া ঢাকার প্রধান ছাত্রাবাসের নাম ‘আল্লামা কাশগড়ি হল’ রেখে তাকে স্মরণীয় করে রাখা হয়।
১৮৭৬ সালে চীনের মাঞ্চু রাজবংশের আক্রমণের আগ পর্যন্ত পূর্ব তুর্কিস্তানে স্বাধীন-সার্বভৌম ও সমৃদ্ধ ইসলামি উইঘুর রাজত্ব টিকে ছিল। দীর্ঘ আট বছরের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ১৮ নভেম্বর ১৮৮৪ সালে মাঞ্চু রাজা পূর্ব তুর্কিস্তান দখলে সক্ষম হয়। দখলের পর পূর্ব তুর্কিস্তানের নাম পরিবর্তন করে রাখেন শিনজিয়াং। অর্থ নতুন ভূমি বা অঞ্চল। মাঞ্চু রাজত্ব প্রতিষ্ঠার পর উইঘুরদের সামাজিক মর্যাদা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য ধ্বংসের উদ্যোগ নেওয়া হয়।
১৯১১ সালে মাঞ্চু সাম্রাজ্যে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন শুরু হওয়ার পর পূর্ব তুর্কিস্তান চীনের জাতীয়তাবাদী সরকারের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। সে সময় থেকে উইঘুররা স্বাধীনতার জন্য তীব্র আন্দোলন শুরু করে এবং দুইবার (১৯৩৩ ও ১৯৪৪ সালে) ‘পূর্ব তুর্কিস্তান রিপাবলিক’ নামে স্বাধীনতা লাভে সক্ষম হয়। ১৯৪৯ সালে কমিউনিস্ট বিপ্লবের পর চীনা কমিউনিস্ট সেনারা শিনজিয়াংয়ে অভিযান চালায়। এর সূত্র ধরে চীনের হান সামরিক গোষ্ঠী শিনজিয়াংয়ে অভিবাসী হয়েছে। চীনের কমিউনিস্ট সরকারের পরিকল্পনা ও প্রচেষ্টায় বহিরাগত ‘হান’দের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে জনসংখ্যার ৪০ ভাগে। বর্তমানে ৭.৫ মিলিয়ন হান বসবাস করে জিংজিয়াংয়ে। সরকার বিপুল সংখ্যক অমুসলিমকে এই অঞ্চলে পুনর্বাসনে উৎসাহিত করছে।
চীনের নির্মমতা ও দমন-নিপীড়ন উইঘুর অঞ্চলে বারবার মানবিক সংকট তৈরি করেছে। এক্ষেত্রে চীন ধর্মীয় উগ্রবাদ ও সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনার মিথ্যা অভিযোগকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে মুসলিমদের নানাভাবে লাঞ্ছিত করছে। যেমন, বন্দিশিবিরে আটক রাখা, নির্যাতন করা ও নির্বাসনে বাধ্য করা, মসজিদ ও ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে এবং শিক্ষার ভাষা হিসেবে উইঘুরকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। জাতিগত উইঘুরদের রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন প্রকল্পে বিনা বেতনে শ্রমদানে বাধ্য করা হচ্ছে। পৃথিবীর অন্যতম ধর্মীয় নিপীড়ক দেশ চীনে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা না থাকায় এসব নিপীড়নের গোঙানির শব্দ বিশ্ববাসী খুব একটা জানতে পারে না। কালেভদ্রে কিছু জানা যায়। ২০০৯ সালের সংঘটিত দাঙ্গায় প্রায় ২০০-এর কাছাকাছি মানুষ মৃত্যুবরণ করে, যার অধিকাংশই ছিল হান জনগোষ্ঠীর। চীনের সরকারি বাহিনী এই দাঙ্গার জন্য উইঘুরদের ঘরে ঘরে গিয়ে তল্লাশি ও নির্যাতন চালানো শুরু। তখন থেকেই চীন উইঘুরদের প্রতি নির্যাতনের মাত্রা কঠোর থেকে কঠোরতর করে। ২০১১ সাল থেকে চীন সরকার স্বাধীনতাকামী ও সন্ত্রাস দমনের অজুহাতে ব্যাপক দমন-পীড়ন শুরু করেছে উইঘুর অঞ্চলে। প্রায় ১০ লাখ উইঘুরকে বিভিন্ন বন্দিশিবিরে আটক চীনের নিরাপত্তা বাহিনী। এসব শিবিরে বন্দিদের মান্দারিন ভাষা শিখতে, কমিউনিস্ট পার্টির প্রশংসা করতে বাধ্য করা হচ্ছে।
উইঘুর সংস্কৃতি ও জাতিগত সত্তাকে মুছে ফেলার চেষ্টা করা হচ্ছে। খাদ্য হিসেবে শূকরের মাংস খেতে বাধ্য করা হচ্ছে। মাইলের পর মাইল লম্বা লম্বা টাইট সিকিউরিটির ভেতর লাখ লাখ মুসলিম তরুণ যুবককে কী মেরে-কেটে গলিয়ে ফেলা হচ্ছে, ধর্মান্তরিত করা হচ্ছে, ছেলে-মেয়ে, বাবা-মা, দাদা-নানা, দাদি-নানি- সব বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হচ্ছে। গুম করে ফেলা হচ্ছে। উইঘুর মুসলিম জনগোষ্ঠীর বিস্তার রোধে মুসলিম নারীদের জোর করে জন্মরোধক ওষুধ সেবন, গর্ভপাত ও বন্ধ্যাকরণ কার্যক্রম চালাচ্ছে দেশটির সরকার। শিনজিয়াং প্রদেশে চীনের এইসব গোপন বন্দিশিবিরের ৯ মাস বন্দি থাকা তুরসুনে জিয়াউদুন বিবিসিকে দেয়া তার ওপর এবং তার দেখা বন্দি অন্য নারীদের ওপর পরিচালিত যৌন নির্যাতন ও সহিংসতার যে বর্ণনা দিয়েছেন, তা রীতিমতো কল্পকাহিনীকে হার মানার মতো। গুলজিরা নামের এক নারীর সাক্ষাৎকারও নিয়েছে বিবিসি। তিনিও শিনজিয়াংয়ের বন্দি শিবিরে আটক ছিলেন ১৮ মাস। তাকে চীনা পুরুষদের নারী ধর্ষণে সহযোগিতা করতে বাধ্য করা হয়েছিল। অভিজ্ঞতা বর্ণনায় গুলজিরা বলেন, রক্ষীদের হয় এভাবে সহযোগিতা করা, নয়তো শাস্তি ভোগ করা ছাড়া তার আর কোনো পথ ছিল না। চীন বিশ্ববাসীর চোখ ফাঁকি দিয়ে সোনা-রুপার খনি সমৃদ্ধ উইঘুর মুসলিম জাতিকে নিজস্ব মাটি থেকে উৎখাত করে বা তাদের নিজেদের ‘হান’ জাতিতে রূপান্তর করার নিখুঁত পরিকল্পনা চালিয়ে গেলেও শত মাইল ওপরের সেটেলাইট ক্যামেরাকে ফাঁকি দিতে পারেনি। ভুক্তভোগী ও প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণের সঙ্গে বিবিসির স্যাটেলাইট চিত্রের বেশ মিল রয়েছে। চীনা কর্তৃপক্ষ এই বন্দিশিবিরকে ধর্মীয় উগ্রবাদ রোধে সহায়তার জন্য বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হিসেবে উল্লেখ করেছে।
চীনের উইঘুর নিয়ে মুসলিম বিশ্ব চুপ কেন?
উইঘুরদের বিরুদ্ধে চীনের মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে সবচেয়ে বেশি আওয়াজ উঠছিল পশ্চিমা দেশগুলো থেকেই। তবে পশ্চিমা দেশগুলোর প্রতিবাদ মুসলিম বিশ্বে খুব একটা আবেদন সৃষ্টি করতে পারেনি। সোভিয়েত ইউনিয়ন-পরবর্তী আমেরিকার নেতৃত্বে পশ্চিমা বিশ্বের মধ্যপ্রাচ্য নীতি, বিশেষ করে মুসলিম সমৃদ্ধ দেশ ইরাক, আফগানিস্তান, লিবিয়া, সিরিয়াকে বিরান ভূমিতে পরিণত এবং ফিলিস্তিন ইস্যুতে ইসরায়েলের প্রতি একচোখা নীতির ফলে উইঘুরের মুসলমানদের প্রতি পশ্চিমা বিশ্বের সহানুভূতিকে মায়াকান্না হিসেবে আখ্যায়িত করে প্রতিদ্বন্দ্বী চীনকে বেকায়দায় ফেলার কৌশল বলে মনে করতে থাকে। মুসলিম বিশ্বের প্রভাবশালী দেশ সৌদি আরব, পাকিস্তান, তুরস্ক, ইরান, মালয়েশিয়া মুসলিম ইস্যুতে বরাবরই সরব থাকলেও উইঘুরের মুসলমানদের ব্যাপারে খুব একটা ভূমিকা রাখতে দেখা যায়নি। ২০১১ সাল থেকে উইঘুরের মুসলিম জনগোষ্ঠীর ওপর চলে আসা চীন সরকারের ধারাবাহিক নির্মমতার বিরুদ্ধে তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোগানকে এক সময় সরব দেখা গেলেও আঙ্কারার এই নীতিতে পরিবর্তন এসেছে।
২০১২ সালে এরদোগান জিনজিয়াংয়ে চীনা নীতিকে ‘গণহত্যা’ হিসেবে অভিহিত করেছিলেন। অনেক দিন ধরে বিচ্ছিন্নতাবাদকে সমর্থন করেন এবং জিনজিয়াংয়ের শরণার্থীদের আশ্রয়ও দিয়েছিলেন। উইঘুর নেতাদের শুধু রাজনৈতিক আশ্রয়ই দেয়া হয়নি, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালানোর সুযোগও তাদের দেয়া হয়েছিল। উইঘুর ইস্যুতে তুরস্ক আর চীনের মাঝে বেশ কূটনৈতিক টানাপড়েন চলছিল। ২০১৭ সালে তুরস্ক প্রবাসী উইঘুরদের বিষয়ে কড়া নীতি বাস্তবায়নের ঘোষণা দেন। তুরস্কে এখন আর উইঘুর সংখ্যালঘুদের বিক্ষোভ এবং রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের অনুমতি দেয়া হয় না। তুর্কি নীতি হঠাৎ পাল্টে যাওয়ার পেছনে দুটি কারণ রয়েছে বলে মনে করা হয়। প্রথমত, ২০১৭ সালে প্রেসিডেন্ট এরদোগানের বিরুদ্ধ ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানে প্রচ্ছন্ন সমর্থনের ফলে পশ্চিমাদের সঙ্গে তুরস্কের সম্পর্কের অবনতি। ফলে আঙ্কারা বিকল্প শক্তি হিসেবে চীনকে এক্ষেত্রে নতুন মিত্র মনে করে। দ্বিতীয় কারণটি বাণিজ্যিক। তুরস্ক এখন একটি অর্থনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে এবং এ অবস্থা থেকে উত্তরণে নতুন বাণিজ্য সম্পর্ক দরকার। পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্য ক্রমেই কঠিন হয়ে পড়ছে।
এদিকে ইরান চীনানীতির সমালোচনা করে না। ইরান থেকে তেলের সবচেয়ে বড় আমদানিকারক চীন। ইরানের তেল ও গ্যাস খাতেও চীন প্রচুর পরিমাণে বিনিয়োগ করে। ইরানের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক আরও প্রসারিত করছে দেশটি। অর্থনৈতিক কারণে চীনের সঙ্গে মালয়েশিয়া, সৌদি আরবের সম্পর্কও বেশ ভালো। যুবরাজ মুহাম্মদ বিন সালমান চীনা সংখ্যালঘু বিষয়ক নীতির প্রশংসাও করেছেন। অন্য আরব দেশগুলোরও অবস্থান একই রকম। এক্ষেত্রেও অর্থনৈতিক সম্পর্ক একটি বড় কারণ। পাকিস্তান চীনের বিশাল সামরিক, বাণিজ্যিক ও কৌশলগত ভৌগোলিক অংশীদার। পাকিস্তানে রয়েছে চীনের বিশাল বিনিয়োগ। করাচির গোয়াদার বন্দরকে ঘিরে চায়না-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডোরে চীন পাকিস্তানে ৫০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে। আকসাই চীনের মধ্যদিয়ে যাওয়া কারাকোরাম হাইওয়ের মাধ্যমে কাশগড় থেকে পাকিস্তানের গিলগিত-বালতিস্তানের খুলজেরাব গিরিপথ দিয়ে আরব সাগরের বন্দর গোয়াদরকে চীনের সিংজিয়াংয়ের সঙ্গে যুক্ত করার কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। পাকিস্তানের এ প্রকল্প চীনের আগামী শতাব্দীর বেল্ট রোড প্রকল্পের প্রধান অংশ।
সুতরাং কারাকোরাম মহাসড়ক চীনের জন্য ক্রমেই অর্থনৈতিক ও ভূকৌশলগত কারণে গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল হয়ে উঠেছে। এ কারণে ‘চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডর’ রক্ষায় পাকিস্তান চীনের অর্থায়নে বিশেষ বাহিনী গড়ে তুলেছে। কারাকোরাম হাইওয়ে মোট ১ হাজার ৩০০ কিলোমিটার, যার ৮৮৭ কিলোমিটার পাকিস্তান অঞ্চলে এবং ৪১৩ কিলোমিটার চীনের মধ্যে রয়েছে। বর্তমানে পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদ হয়ে চীনের কাশগড় পর্যন্ত রেলওয়ে লাইনের সম্প্রসারণ কাজ চলছে পুরোদমে। চীনের জন্য মধ্যপ্রাচ্যে এবং উত্তর আফ্রিকার জ্বালানি সঞ্চালনের প্রধান পথ হলো পাকিস্তান। কারাকোরাম হাইওয়ে শুধু যোগাযোগের ব্যবস্থাই নয়, সামরিক দিক থেকেও খুব গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া কাশ্মির ইস্যুতে ভারতের সঙ্গে অস্থিতিশীলতার সময়ে চীন পাকিস্তানকে বরাবরই কূটনৈতিক ও সামরিক সহায়তার প্রস্তাবও দিয়েছে। সুতরাং চীনের বিপরীত মেরুতে চলা আপাতত কোনো সুযোগ নেই পাকিস্তানের। এক কথায়, চীনের অর্থনীতির রমরমা অবস্থা এবং তাদের কাছ থেকে নানান সুবিধা পেয়ে অধিকাংশ মুসলিম দেশ উইঘুরের মুসলমানদের ওপর পরিচালিত দমন-নিপীড়ন ও শুদ্ধি অভিযানের বিরুদ্ধে কোনো কথা বলে না। উইঘুরে চীনা দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে একশ্রেণির বুদ্ধিজীবীরাও কথা বলেন না। কারণ, তাদের অনেকের কাঁধে মার্ক্সীয় তত্ত্ব, মাও তত্ত্ব ভর করে আছে।
উইঘুর মুসলমানদের ওপর চীনা কর্তৃপক্ষের এই নির্যাতনের শেষ কোথায়- তা হয়তো কেউ-ই বলতে পারবে না! কারণ, একরোখা চীন কারও হুমকি-ধমকি থোড়াই তোয়াক্কা করে না। দৈবিক কিছু না ঘটলে উইঘুর মুসলিমদের ভাগ্য বোধ হয় এমনই রয়ে যাবে। আল্লাহপাক উইঘুর মুসলিমদের হেফাজত করুন।
লেখক : অধ্যাপক, কলামিস্ট ও আন্তর্জাতিক
রাজনীতি বিশ্লেষক