ভারতশাসিত কাশ্মীরের পহেলগামে পর্যটকদের ওপর বন্দুকধারীদের হামলার ঘটনায় ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা এখন তুঙ্গে। দুই পক্ষই প্রতিশোধমূলক পাল্টপাল্টি পদক্ষেপ নিয়েছে। এ ঘটনার পর দ্রুত কতগুলো সিদ্ধান্ত জানায় দিল্লি। এ তালিকায় সিন্ধু জল বণ্টন চুক্তি স্থগিত, প্রধান সীমান্ত ক্রসিং বন্ধ করে দেওয়া, পাকিস্তানিদের জন্য ভিসা বন্ধ এবং কূটনীতিকদের বহিষ্কারের মতো সিদ্ধান্তও রয়েছে। জবাবে পাকিস্তানও ভারতের বিরুদ্ধে একাধিক পদক্ষেপ নিয়েছে। জানানো হয়েছে, ভারত আর পাকিস্তানের আকাশসীমা ব্যবহার করতে পারবে না। সব ধরনের বাণিজ্য বন্ধ থাকবে। এ ছাড়া ১৯৭২ সালের সিমলা চুক্তিও স্থগিতের ঘোষণা করেছে পাকিস্তান। ভারতের দিক থেকে সিন্ধু চুক্তি স্থগিতের পরপরই অবশ্য পাকিস্তানের ভেতরে সিমলা চুক্তি স্থগিতের দাবি ওঠে।
সিমলা চুক্তি স্থগিতের দাবি : পাকিস্তানি সাংবাদিক হামিদ মীর এক্স-এ লিখেছেন, ‘পাকিস্তানে নতুন বিতর্ক শুরু হয়েছে। ভারত যদি বিশ্বব্যাংকের অধীন সিন্ধু জল চুক্তিকে বিদায় জানাতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়, তবে পাকিস্তানেরও সিমলা চুক্তি থেকে সরে আসা উচিত। যার মধ্যস্থতায় কোনো আন্তর্জাতিক সংস্থা অন্তর্ভুক্ত নেই।’ পাকিস্তান-শাসিত কাশ্মীরের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী রাজা মুহাম্মদ ফারুক হায়দার খান এক্স হ্যান্ডেলে লিখেছেন, ‘ভারত একতরফাভাবে সিন্ধু জল চুক্তি স্থগিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর জবাবে সিমলা চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসা উচিত। বিশেষত কাশ্মীর সংক্রান্ত বিষয়ে।’ পাকিস্তান সিমলা চুক্তি স্থগিতের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর দেশটির অনেক নাগরিক মনে করছেন, এতে তারা উপকৃত হবেন। এর পেছনে তারা যুক্তি দিয়েছেন, সিমলা চুক্তি পাকিস্তানকে কাশ্মীর ইস্যুর আন্তর্জাতিকীকরণ থেকে বিরত রেখেছে। ওই চুক্তি স্থগিত হলে পাকিস্তান কোনোরকম কূটনৈতিক বাধ্যবাধকতা ছাড়াই আন্তর্জাতিক ফোরামে কাশ্মীর-ইস্যু উত্থাপন করতে পারবে। তবে সিমলা চুক্তির অধীনে থাকা অবস্থাতেও অবশ্য পাকিস্তান তা করেছে। কিন্তু পাকিস্তানি বিশ্লেষকদের মতে, সিমলা চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে কাশ্মীর ইস্যু আরও জোর গলায় তুলে ধরতে পারবে পাকিস্তান।
সিমলা চুক্তি কী : সিমলা চুক্তি এমন একটা আনুষ্ঠানিক চুক্তি ছিল, যেটিকে দুই দেশের মধ্যে শত্রুতা অবসানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হয়েছিল। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে ভারত-পাকিস্তান লড়াইয়ের পর ১৯৭২ সালের জুলাইতে স্বাক্ষরিত হয়েছিল এ চুক্তি। তার মাস ছয়েক আগেই পাকিস্তানের সেনাবাহিনী তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। পাকিস্তানের সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ৪৫ হাজার সৈন্য এবং আধা সামরিক বাহিনীসহ ৭৩ হাজার যুদ্ধবন্দি ভারতের কারাগারে ছিল। পশ্চিম পাকিস্তানের প্রায় পাঁচ হাজার বর্গমাইল এলাকাও ভারতের দখলে ছিল। এ পটভূমিতেই ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এবং পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো ভারতের হিমাচল প্রদেশের সিমলায় বৈঠক করছিলেন। সেখানে যে সমঝোতা হয়, তার নাম সিমলা চুক্তি। চুক্তির দলিল স্বাক্ষরের তারিখ রেকর্ড করা হয়েছে ১৯৭২ সালের ২ জুলাই। তবে বাস্তবে ৩ জুলাই সকালে স্বাক্ষরিত হয়েছিল এ চুক্তি। দুই দেশের মধ্যে শত্রুতার অবসানের পাশাপাশি দুই দেশের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সমঝোতাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রেও সিমলা চুক্তির বিশেষ ভূমিকা পালন করতে পারে বলে মনে করা হয়েছিল। সিমলা চুক্তি অনুযায়ী, দুই দেশ দ্বিপাক্ষিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ উপায়ে সব সমস্যার সমাধান করবে।
সিমলা চুক্তির অধীনে দুই দেশের মধ্যে নিয়ন্ত্রণ রেখা (এলওসি) গঠিত হয়। সে সময় ভারত-পাকিস্তান দু’পক্ষই এ নিয়ন্ত্রণ রেখাকে সম্মান জানাতে রাজি হয়। তারা এ বিষয়েও সম্মত হয়েছিল, দু’পক্ষই কোনোরকম একতরফা সিদ্ধান্ত নেবে না। নিয়ন্ত্রণ রেখাকে স্কেল হিসেবে বিবেচনা করে একে অপরের ভূখণ্ড থেকে সেনা প্রত্যাহারে সম্মত হয়েছিল ভারত ও পাকিস্তান। কিন্তু দুই দেশই একে ওপরের বিরুদ্ধে নিয়ন্ত্রণ রেখাকে না মানার অভিযোগ তুলে এসেছে।
পাকিস্তান যা বলছে : পাকিস্তানের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী খুরশিদ মাহমুদ কাসুরিকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, তার আমলে ভারতের সঙ্গে আলোচনা সিমলা চুক্তির সীমারেখার মধ্যে থেকেই হয়েছিল কিনা। উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘এখন এ অঞ্চলের পরিস্থিতি সিমলা চুক্তির যুগ পার করে গেছে। গত দশকেও লাহোর চুক্তি, ইসলামাবাদ চুক্তির কথা মাথায় রেখে আলাপ-আলোচনা এগোচ্ছিল। যে কারণে দুই দেশ আলাপ-আলোচনা করছিল।’ ভারতের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছেন তিনি। তার কথায়, সিমলা চুক্তিতে দ্বিপাক্ষিক ও শান্তিপূর্ণভাবে বিতর্কিত বিষয়গুলো সমাধানের কথা বলা হলেও ভারত একতরফা পদক্ষেপের মাধ্যমে কাশ্মীরের সাংবিধানিক মর্যাদা পরিবর্তন করেছে। যা এ দ্বিপক্ষীয় চুক্তির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। দুই দেশ সম্মত হয়েছিল, তারা এলওসিকে সম্মান করবে। তবে পাকিস্তানের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মতে, সিমলা চুক্তি বাতিল করা সম্ভব নয়। ভারতের বিরুদ্ধে পাল্টা অভিযোগ তুলে তিনি বলেছেন, ‘মোদির পদক্ষেপে এ চুক্তি শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু আমি এটি বাতিল করতে পারি না। কারণ, (সবসময়) সরকার এবং নীতি এক থাকে না।’
ভারতের ওপর প্রভাব : জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল কি সিমলা চুক্তির লঙ্ঘন? এ প্রশ্নের উত্তরে দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর সাউথ এশিয়া স্টাডিজের অধ্যাপক মহেন্দ্র পি লামা বলেন, ‘৩৭০ ধারা বিলোপের বিষয়টি সিমলা চুক্তির লঙ্ঘন ছিল না। ৩৭০ ধারা ভারতীয় সংবিধানের বিষয় ছিল। সংবিধান সংশোধন করার ক্ষমতা সংসদের রয়েছে।’ তার মতে, সিমলা চুক্তি স্থগিত হলে তার প্রভাব ভারতে পড়বে না। এমনিতেও পাকিস্তানকে মোকাবিলা করা যাবে। সেটা শুধু বলপ্রয়োগের মাধ্যমে, সিমলা চুক্তির মাধ্যমে নয়। সিমলা চুক্তির এখন কোনো অর্থ নেই। পাকিস্তান প্রতিদিনই তা লঙ্ঘন করছে। সুতরাং এটা ভালো বিষয়, তারা এখন চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসছে।