কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে অবস্থিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ৬ হাজার ৪৯৩ টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেছে জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ ও সেভ দ্যা চিলড্রেন।
মঙ্গলবার বিকেলে কক্সবাজার শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারকে পত্রের মাধ্যমে ইউনিসেফ ও সেভ দ্যা চিলড্রেন এই বন্ধের ঘোষণা দেন।
ইউনিসেফ কক্সবাজার ফিল্ড অফিসের প্রধান এনজেলা কার্নে ও সেভ দ্যা চিলড্রেন এর মোহাম্মদ গোলাম মোস্তফা স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়, উখিয়ায় উদ্ভূত পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের শিক্ষা সেক্টরের সকল শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করা হলো।
এর আগে ইউনিসেফ গতকাল সোমবার ২ জুন প্রেস ব্রিফিংয়ে জানিয়েছিলেন তহবিল সংকটের কারণে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ২ লাখ ৩০ হাজার শিক্ষার্থী শিশু শিক্ষা ঝুঁকিতে রয়েছে। পর্যাপ্ত তহবিল না পাওয়ায় পর্যায়ক্রমে স্থানীয় শিক্ষক স্বেচ্ছাসেবকদের ছাটাই করতে হচ্ছে।
শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশন কার্যালয়ের অতিরিক্ত কমিশনার শামসুদ দৌজা নয়ন চিঠি পাওয়ার সত্যতা নিশ্চিত করে জানিয়েছেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ইউনিসেফ পরিচালিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলোর ১২ শত স্থানীয় শিক্ষককে ছাটাই করা হয়। এসব শিক্ষকরা দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে আসছে। এ বিষয়ে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কার্যালয় থেকে শিক্ষকদের চাকরি পুনর্বহাল এবং পর্যাপ্ত তহবিল প্রদানের জন্য জাতিসংঘকে বলা হয়েছে।
এদিকে মঙ্গলবার কক্সবাজার-টেকনাফ (শহিদ এটি এম জাফর আলম) আরাকান মহাসড়কের উখিয়া উপজেলার কোর্টবাজার স্টেশন চত্বর ও টেকনাফ উপজেলার হোয়াইক্যং উনচিপ্রাং স্টেশন চত্বরে এই আন্দোলন শুরু হয়।
উখিয়া ও টেকনাফ ৩৩টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফের ফান্ডে পরিচালিত শিক্ষা প্রকল্পের স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ের বিভিন্ন এনজিও সংস্থা থেকে চাকরিচ্যুত শিক্ষকদের আন্দোলনের মুখে কক্সবাজার-টেকনাফ মহাসড়কে সকাল সাড়ে সাতটা থেকে দুপুর দুইটা পর্যন্ত ৭ ঘণ্টার অধিক সময় ধরে যানচলাচল বন্ধ ছিল। যার কারণে ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে সড়কে চলাচলকারী যানবাহন ও যাত্রীদের।উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কাছে বিষয়টি সমাধানের আশ্বাস পেয়ে আন্দোলন স্থগিত করেন শিক্ষকরা।
আন্দোলনকারীরা অভিযোগ করে জানান, উখিয়া ও টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে শিক্ষা প্রকল্পের আওতায় পরিচালিত এনজিও সংস্থা ব্র্যাক, কোডেক, ফ্রেন্ডশিপ, মুক্তি কক্সবাজার, জেসিএফ সহ শিশু শিক্ষা কেন্দ্রগুলোতে রোহিঙ্গা সেচ্ছাসেবকদের বহাল রেখে ১২৫০ জন বাংলাদেশি শিক্ষকদের চাকরিচ্যুত করে। যা দাতাসংস্থা ইউনিসেফের ফান্ড সংকট বলে দাবি করে আসছে।
শিক্ষা প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলো হঠাৎ করে একযোগে ১২৫০ শিক্ষককে চাকরিচ্যুত করায় স্থানীয়দের মাঝে নেতিবাচক ধারা তৈরি হয়। যা স্থানীয় উখিয়া টেকনাফের মানুষের সাথে ষড়যন্ত্র ও প্রহসন মনে করেন অনেকেই।
শিক্ষকদের চাকরিতে বহাল রেখে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো দাবিতে স্থানীয় বাংলাদেশি শিক্ষকরা প্রতিবাদে সড়ক অবরোধ ও আন্দোলনে নামেন। এতে করে মহাসড়কে অ্যাম্বুলেন্স সহ শতশত বিভিন্ন ধরনের দূরপাল্লার যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে পড়লে ভোগান্তিতে পড়েন যাত্রীরা।
উনচিপ্রাংয়ের আন্দোলনকারী শিক্ষক মোহাম্মদ করিম বলেন, রোহিঙ্গা শিশুদের নিয়ে ক্যাম্পে পরিচালিত শিশু শিক্ষা কেন্দ্র থেকে রোহিঙ্গা শিক্ষকদের চাকরিতে বহাল রেখে স্থানীয় বাংলাদেশি শিক্ষকদের চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। এর আগেও চাকরি ফিরে পেতে কয়েক দফা আন্দোলন করা হয়েছে। এখনো পর্যন্ত চাকরিতে যোগদান করতে পারিনি। বিপরীতে নতুন করে আরো ১২৫০ জনকে ছাঁটাই করা হয়েছে।
উখিয়া উপজেলার কোর্টবাজারে আন্দোলনকারী শিক্ষক বোরহান উদ্দিন বলেন, দাতাসংস্থা ইউনিসেফের নির্দেশে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলো স্থানীয় বাংলাদেশি শিক্ষকদের চাকরিচ্যুত করেছে। স্থানীয়দের বাদ দিয়ে দেশের অন্যান্য বিভাগ ও জেলা থেকে তাদের আত্মীয়স্বজন এবং নিজস্ব জনবল নিয়োগ দেওয়ার পাঁয়তারা করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, চাকরি ফিরে পেতে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার সহ এনজিও সংস্থাগুলোর প্রধানদের কাছে বিষয়টি অবগত করা হয়েছে। কোনো কাজ হয়নি এর আগেও বহুবার আন্দোলন করা হয়েছে। তারা বার বার অর্থ সংকট দেখিয়ে যাচ্ছে। কোনো মতে চাকরি ফিরিয়ে দিচ্ছে না। তাই রাজপথে আন্দোলনে নামতে শিক্ষকদের বাদ্য করা হয়েছে।
টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী অফিসার শেখ এহেসান উদ্দিন বলেন, স্থানীয় শিক্ষকরা সড়কে আন্দোলন করছে শুনেছি বিষয়টি জেলা প্রশাসক বরাবরে অবগত করা হয়েছে।
উখিয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোহাম্মদ কামরুল হোসেন চৌধুরী বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে চাকুরিচ্যুত ৪ হাজার শিক্ষকের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত না হওয়া পর্যন্ত ক্যাম্প ভিত্তিক সকল শিক্ষা কার্যক্রম অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করা হল। কার্যক্রম চালু করতে হলে স্থানীয় শিক্ষকদের সাথে নিয়ে প্রকল্প চালু করতে পারবে। অন্যথায় প্রকল্প বন্ধ থাকবে।
আন্দোলনে একাত্মতা পোষণ করেছেন উখিয়া উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান সরওয়ার জাহান চৌধুরী, উপজেলা জামায়াতের আমির মাওলানা আবুল ফজল, উপজেলা বিএনপির সদস্য সচিব সুলতান মাহমুদ চৌধুরী, জামায়াত সেক্রেটারি সোলতান আহমদ, শিক্ষক শামিম হোসেন সহ নানা শ্রেণি পেশার মানুষ এতে অংশগ্রহণ করেন।