পূর্ব এশিয়ার দ্বীপরাষ্ট্র জাপান। এখানে মুসলমানের সংখ্যা খুব বেশি নয়। তবে ২০২১ সালের ৭ জানুয়ারি প্রভাবশালী পত্রিকা দি ইকোনমিস্টে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, জাপানে মুসলমানের সংখ্যা বাড়ছে। ২০১০ সালে সেখানে মুসলমানের সংখ্যা ছিল ১ লাখ ১০ হাজার; যা ২০১৯ সালে গিয়ে ২ লাখ ২৩ হাজারে দাঁড়ায়। ধারণা করা হয়, এ সময়ের মধ্যে কমপক্ষে ৫০ হাজার জাপানি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। জাপানের সঙ্গে মুসলমানদের যোগাযোগ শুরু হয় ১৭ শতকে। এ শতাব্দীর জাপানি ইতিহাসে প্রথম মুসলমানদের বিবরণ পাওয়া যায়। মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে জাপানের কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয় আরও পরে।
জাপানে ইসলামের ইতিহাস : ইসলামি ইতিহাসের প্রথম ও মধ্যযুগে এখানে কোনো মুসলমানের আগমন কিংবা দাওয়াতি তৎপরতার উল্লেখ পাওয়া যায় না। ধারণা করা হয়, ওসমানি খেলাফতের সময় সুলতান আবদুল হামিদ সর্বপ্রথম ১৮৯০ খ্রিষ্টাব্দে নৌপথে তার জাহাজ সৌজন্যমূলক মিশন জাপানে পাঠিয়েছিলেন। তার উদ্দেশ্য ছিল, এ অঞ্চলে ইসলামের দাওয়াতের সম্ভাবনা সম্পর্কে সমীক্ষা চালানো। প্রতিনিধি দলটি জাপানে খুব ভালো প্রভাব সৃষ্টি করে। মূলত তারা এ অঞ্চলে ইসলাম গ্রহণের বীজ বপন করে যান। কিন্তু এটি একটি ট্র্যাজেডি ছিল। প্রতিনিধি দল যখন তুরস্কে ফিরে যাচ্ছিলেন, তখন জাপানের সমুদ্রে প্রচণ্ড ঝড়ের আঘাতে জাহাজটি ডুবে যায়। ৬০৯ জন যাত্রীর মধ্যে মাত্র ৬৯ জন জীবিত ছিলেন। অবশিষ্ট সবাই শহিদ হন। এদের মধ্যে সুলতানের ভাইও ছিল। দুর্ঘটনাটি ঘটেছিল রাতের আঁধারে। পাশের দ্বীপের জাপানি অধিবাসীরা দুর্ঘটনাকবলিত লোকদের আন্তরিকভাবে সাহায্য করেন। জাপানের বাদশা আহতদের চিকিৎসা ও জীবিতদের তুরস্কে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। শহিদদের দুর্ঘটনাস্থলের কাছে সমাহিত করা হয়। সেখানে একটি জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করা হয়। সে সময় থেকে প্রতিবছর এ দুর্ঘটনার স্মৃতি হিসেবে একটি অনুষ্ঠান করা হয়।
আত্মত্যাগে কার্যকর ভূমিকা : সৌজন্যমূলক মিশনের অধিকাংশ সদস্য যদিও শহিদ হন; কিন্তু তাদের আত্মত্যাগ কার্যকর ভূমিকা পালন করে। জাপানের লোকদের ওপর এ দুর্ঘটনার গভীর প্রভাব পড়ে। চব্বিশ বছর বয়সী এক তরুণ যুবক তুরাজিরু ইয়ামাডা; যিনি একজন উচ্চ শিক্ষিত সাংবাদিক ছিলেন।
এ দুর্ঘটনায় খুব প্রভাবিত হন। দুর্ঘটনাকবলিত শহিদ পরিবারের জন্য সারা দেশে চাঁদা সংগ্রহের অভিযান চালান। ৫৪০ জন শহিদ পরিবারের জন্য বিরাট একটি অংক সংগ্রহ করে জাপানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে আবেদন করে এ অর্থ তুরস্ক পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তার আবেগের মূল্যায়ন করে তাকেই সে অর্থসহ তুরস্কে পাঠিয়ে দেন। তুরাজিরু ইস্তাম্বুল পৌঁছে তুরস্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। বিশাল ও জাঁকজমকপূর্ণ এক অনুষ্ঠানে অর্থগুলো তুরস্কের নৌ মন্ত্রণালয়ের কাছে হস্তান্তর করা হয়; যেন মন্ত্রণালয় এ অর্থ দুর্ঘটনা কবলিত লোকদের মধ্যে বণ্টন করতে পারে।
জাপান ভূখণ্ডের প্রথম মুসলমান : এ সময় সুলতান আবদুল হামিদ স্বয়ং তুরাজিরুকে ডেকে নিয়ে দু’বছর তুরস্কে অবস্থান করে এখানের সেনা অফিসারদের জাপানি ভাষা শেখানোর প্রস্তাব দেন। তুরাজিরু তার এ প্রস্তাব গ্রহণ করেন। তুর্কি অফিসারদের জাপানি ভাষা শেখানোর পাশাপাশি নিজেও তুর্কি ভাষা শেখেন। ইসলাম সম্পর্কে জ্ঞানার্জন শুরু করেন। কিছুদিন পরে তিনি মুসলমান হয়ে নিজের নামের সঙ্গে ‘সিঙ্গিতুস’ শব্দ যোগ করেন। জাপানি ভাষায় এর অর্থ ‘চাঁদ’। অন্য সূত্রে জানা যায়, তিনি তার ইসলামি নাম রেখেছিলেন ‘আবদুল খলিল’। তুরস্কে অবস্থানকালে তিনি যখন বাড়ির লোকদের কাছে পত্র লিখতেন, তখন তার ইসলামি নামও জুড়ে দিতেন। যদিও জাপানে ইসলামের অনুপ্রবেশের ইতিহাসের ওপর অনেক গবেষণা অবশিষ্ট রয়েছে, তবে এখন পর্যন্ত জানা তথ্যানুসারে তুরাজিরু ছিলেন জাপান ভূখণ্ডের প্রথম ব্যক্তি, যিনি ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। তিনি ৯১ বছর বয়স পান। ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দে তার মৃত্যু হয়।
আরেক সূত্রে জানা যায়, জাপানি প্রথম মুসলিম ছিলেন অসোতারো নোডা। যিনি পেশায় সাংবাদিক। ৬৯ জন বেঁচে যাওয়া যাত্রীর সঙ্গে তুরস্কে গিয়েছিলেন তিনি। সুলতানের অনুরোধে সেখানে থাকেন। সেখানে অবস্থানকালে একজন ব্রিটিশ মুসলিমের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হয়। তাদের দুজনের মাঝে এক দীর্ঘ আলোচনার পর অসোতারো মুসলিম হয়ে যান। নিজের নাম রাখেন আবদুল হালিম।
ইসলাম গ্রহণের হিড়িক : ধারণা করা হয়, তুরাজিরু ও অসোতারো একসঙ্গে গিয়েছিলেন এবং মুসলমান হয়েছিলেন। বলা হয়, এ ঘটনার পর অপর আরেক জাপানি ইয়ামাওকা ১৯০৯ খ্রিষ্টাব্দে ইসলাম গ্রহণ করেন। নিজের নাম রাখেন ওমর ইয়ামাওকা। তিনি হজ করার সৌভাগ্যও লাভ করেছিলেন। স্থানীয় মুসলমানদের তাবলিগে প্রভাবিত হন আরেক জাপানি। নিজের নাম রাখেন ‘আহমদ আরিগা’। তারা দুজন জাপান ফিরে এসে ইসলামের তাবলিগ আরম্ভ করেন। তারপর আরও অনেক জাপানি লোক মুসলমান হন। অপরদিকে তুর্কিস্তানে বলসেভিক বিপ্লবের সময় রাশিয়ানদের নির্যাতনে অসহ্য হয়ে উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান, কাজাখস্তান ও কিরগিজস্তান থেকে বহু সংখ্যক মুসলমান পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে। তাদের মধ্য থেকে কিছু লোক জাপানেও পৌঁছে। তাদের এখানে এসে রাজনৈতিক আশ্রয় লাভ করে। তাদের জাপানে বসবাস গ্রহণ করায় মুসলমানদের সম্মিলিত তৎপরতা শুরু হয়। তাদের প্রচেষ্টার ফলেও বহু জাপানি ইসলাম গ্রহণ করে। সেই সঙ্গে ভারত, চীন ও দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশ থেকেও অনেক মুসলমান জাপানে এসে বসবাস শুরু করেন।
মসজিদ ও নামাজঘর প্রতিষ্ঠা : জাপানে বসবাসরত মুসলমানদের প্রচেষ্টায় প্রথমবার ১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দে কোবেতে একটি মসজিদ প্রতিষ্ঠিত হয়। তারপর ১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দে টোকিওতে একটি মসজিদ প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই মসজিদ প্রতিষ্ঠায় জাপানের প্রভাবশালী কিছু অমুসলিম ব্যক্তিও আর্থিক সহযোগিতা করেন। তারপর ১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দে জাপানের অপর একটি শহর নাগোয়াতে একটি মসজিদ নির্মিত হয়। ১৯৭৭ খ্রিষ্টাব্দে ওসাকাতেও একটি মসজিদ প্রতিষ্ঠিত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে জাপানকে অনেক মুসলিম দেশের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করতে হয়। যুদ্ধ শেষে শিল্পের উন্নতির জন্য তেল উৎপাদনকারী মুসলিম দেশের সঙ্গে তার সম্পর্ক আরও স্বাভাবিক হয়। ফলে জাপানে মুসলমানদের যাতায়াত বাড়ে। জাপানি অধিবাসীরাও মুসলিম দেশসমূহে আসে। এভাবে দু’তরফা জাপানে ইসলামের প্রসার দ্রুত হয়। এ সময় জাপানি মুসলমানরা কিছু সংগঠনও প্রতিষ্ঠা করেন। ওয়াজেদা ইউনিভার্সিটির তথ্যমতে, ১৯৯০ সালের পর থেকে জাপানের বিভিন্ন এলাকায় মসজিদ ও নামাজঘরের সংখ্যা বাড়ছে। জাপান ফোকাস ডট ওআরজির তথ্যমতে, ২০০৯ সাল পর্যন্ত জাপানে ৩০ থেকে ৪০টি একতলা মসজিদ হয়েছে। পাশাপাশি আরও ১১০টি বা তার বেশি অ্যাপার্টমেন্ট রুম নামাজের জন্য নির্ধারণ করা আছে। এ মসজিদগুলোর ৯০ শতাংশ দ্বিতীয় তলা এবং প্রথমতলা হালাল খাদ্যের দোকান হিসেবে ব্যবহার করে। খাবারগুলো মূলত ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া থেকে আমদানি করা হয়। বর্তমানে জাপানিরা ইসলাম শিক্ষা গ্রহণ করছে। জাপানিজ ভাষাভাষীদের মধ্যে ইসলাম প্রচার করছে। তাদের ইসলামি বিধিবিধান শেখাচ্ছে।
ইসলামিক সেন্টার প্রতিষ্ঠা : ১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দে একটি ইন্টারন্যাশানাল ইসলামিক সেন্টার প্রতিষ্ঠিত হয়; যা ১৯৭৪ সালে ‘ইসলামিক সেন্টার জাপান’-এর সঙ্গে সংযুক্ত হয়। সেন্টারটি একটি বোর্ড অব ডিরেক্টরের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হচ্ছে। এর সদস্যদের মধ্যে আরবি, পাকিস্তানি, তুর্কি ও খোদ জাপানি মুসলমান রয়েছেন। সেন্টারটির পক্ষ থেকে অনেক বই জাপানি ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো কোরআনের অনুবাদ। ‘আস-সালাম’ নামে একটি ত্রৈমাসিক পত্রিকাও প্রকাশিত হয়। এর পক্ষ থেকে জাপানি শিশুদের প্রাথমিক ধর্মীয় শিক্ষার ব্যবস্থা ও হজ ইচ্ছুকদের হজে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়। সেন্টারটি ছাড়া তাবলিগ জামাতও ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে জাপানে তাদের দাওয়াতি কাজ আরম্ভ করেছে। তাবলিগ জামাতের লোকেরা টোকিওর শহরতলী এলাকা সাইতামার একটি ভবন ক্রয় করে সেখানে একটি মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেছেন; যা এখন তাবলিগের মারকাজের কাজও করছে। তাদের তৎপরতা প্রতিদিন বাড়ছে।
ক্রমে বাড়ছে মুসলমানদের সংখ্যা : জাপানে ক্রমে বাড়ছে ইসলাম ধর্মাবলম্বীর সংখ্যা। গত এক দশকে দেশটির মুসলিম জনসংখ্যা বেড়েছে দ্বিগুণের চেয়ে বেশি। পূর্ব এশীয় দেশগুলোর মধ্যে জাপানে সবচেয়ে দ্রুত গতিতে বিস্তার লাভ করছে ইসলাম। দ্য ইকোনমিস্টের খবরে বলা হয়েছে, জাপানের বৃহত্তম দ্বীপপুঞ্জের সর্ব দক্ষিণের কিউশুর মেক্কা বেপ্পুর মসজিদে প্রতি জুমাবার কয়েক হাজার মুসলিম নারী-পুরুষের জমায়েত হয়। জাপানে পড়তে আসা বিদেশি শিক্ষার্থীদের অনেকেই রিতসুমেইকান এশিয়া প্যাসিফিক ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা করেন। পাশাপাশি তারা শহরের বিভিন্ন হোটেলগুলোতে খণ্ডকালীন কাজ করে থাকেন। কেউ কেউ মাছ ধরার নৌকায় কাজ করেন। অন্যরা জাহাজ নির্মাণ শিল্পে কাজ করেন। জাপানের ওয়াসেদা ইউনিভার্সিটির টানাডা হিরোফুমির এক জরিপ অনুযায়ী, গত এক দশকে ৫০ হাজারেরও বেশি মানুষ অন্য ধর্ম থেকে ইসলামে ধর্মান্তরিত হয়েছেন।
আশায় বাঁধি বুক : এসব তৎপরতার ফলে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত জাপানে মুসলমানদের সংখ্যা ৩ হাজার বলা হতো। এখন সরকারী হিসাবমতে, সেখানে মুসলমানদের সংখ্যা ৫০ হাজার। তাছাড়া যেসব মুসলমান অন্যান্য দেশ থেকে এসে এখানে অধিবাস গ্রহণ করেছেন, তাদের সংখ্যা দু’লাখে পৌঁছেছে। এর অর্থ হলো, জাপানে সর্বমোট আড়াই লাখ মুসলমান রয়েছে। যদিও গত কয়েক বছরে জাপানে মুসলমানদের সংখ্যা বেশ বেড়েছে; কিন্তু তাদের ধর্মীয় প্রয়োজানাদি পূর্ণ করার কাজ চলছে তার তুলনায় খুবই কম গতিতে। এখনও এখানে ধর্মীয় তৎপরতার সেই পরিবেশ সৃষ্টি হয়নি, যা ইউরোপ ও আমেরিকার কিছু দেশে হয়েছে। তারপরও জাপানের বর্তমান মুসলমান প্রজন্ম জাপানে ইসলামের প্রচার ও প্রসারের আন্তরিক ইচ্ছা করেন। হয়তো বা একসময় অন্যান্য দেশের মতো জাপানেও ইসলাম জনপ্রিয় ও প্রভাব বিস্তারকারী ধর্মে পরিণত হবে।
লেখক : গবেষক ও প্রাবন্ধিক