ঢাকা ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ৪ ফাল্গুন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার অধঃপতন

আরিফ আনজুম
আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার অধঃপতন

আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় অনেক বেশি অভাব রয়েছে পর্যবেক্ষণের বলে আমি মনে করি। কারণ বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা বর্তমানে এক গভীর সংকটের মধ্যে পড়েছে। পরিবর্তনশীল বিশ্বে শিক্ষার ভূমিকা ক্রমেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠলেও, আমাদের দেশে একে শুধু সার্টিফিকেট অর্জনের একটি মাধ্যম হিসেবে দেখা হচ্ছে। বর্তমানে শিক্ষার্থীরা জ্ঞান অর্জন থেকে বরং চাকরি পাওয়ার জন্য পড়াশোনা করছে। এ বাস্তবতা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার অন্ধকার দিকগুলোকে তুলে ধরে, যেখানে গবেষণা, বাস্তব জ্ঞান এবং মানসম্মত শিক্ষা অনেকাংশে অনুপস্থিত। প্রথমেই লক্ষ্য করা যায় যে, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় ধারাবাহিকতার অভাব রয়েছে। বারবার কারিকুলাম পরিবর্তন করা হলেও সেই পরিবর্তনগুলো যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে না। যার কোনো নির্দিষ্ট উপনীতির গন্তব্য নেই। যখন যেভাবে ইচ্ছা হচ্ছে, তা তখন সেভাবে ঢালাওভাবে সাজানো হচ্ছে; কিন্তু বাস্তবায়ন ও মানসম্মত কোনোকিছু নিয়ে আসা হচ্ছে না, এই পরিবর্তন নামক সংস্করণে। বলতে গেলে এটা যেন এক ধরনের নাটকীয়তা হয়ে দাঁড়িয়েছে, যেখানে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অভাবেই স্থায়ী পরিবর্তন আনা সম্ভব হচ্ছে না। শিক্ষা ব্যবস্থায় এমন ধরনের পরিবর্তন প্রয়োজন, যা শুধু তাত্ত্বিক নয়, বরং বাস্তবমুখী, শিক্ষার্থীদের কর্মমুখী দক্ষতা তৈরি করতে সহায়ক হয়। উন্নত দেশগুলোর শিক্ষাব্যবস্থা যেখানে গবেষণাধর্মী এবং বাস্তবমুখী, সেখানে আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থা এখনো মূলত পাঠ্যপুস্তকের মধ্যে সীমাবদ্ধ। আমাদের দেশে শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হয়ে উঠেছে শুধু সার্টিফিকেট অর্জন, অথচ বিশ্বমানের শিক্ষাপদ্ধতি দক্ষতা, সৃজনশীলতা এবং গবেষণাকে গুরুত্ব দেয়। উন্নত দেশের জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আন্তর্জাতিক র‌্যাঙ্কিংয়ে শীর্ষে অবস্থান করে; কিন্তু আমাদের জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান কোথায় তা খুঁজে পাওয়া যাবে কি-না সন্দেহ আছে।

আমাদের দেশের এমনকি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থানও গর্ব করার মতো না। আরেকটি বড় সমস্যা হলো শিক্ষকদের অবস্থা। গুণগত শিক্ষার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো যোগ্য শিক্ষক। কিন্তু শিক্ষক সংকট এবং কম বেতন দেশের শিক্ষার মানকে দুর্বল করছে। কম বেতন ও প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধার অভাব তরুণ প্রজন্মকে এই পেশায় আসতে আগ্রহী করে না। শিক্ষকদের যথাযথ প্রশিক্ষণ, পর্যাপ্ত বেতন এবং প্রফেশনাল রিকগনিশন দেয়ার মাধ্যমে এই সমস্যা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। নয়তো দিন দিন এই শিক্ষাব্যবস্থার অবস্থান আরো নিচে নেমে যেতে অপেক্ষা করবে না। আমাদের দেশে সরকারি চাকরি বা বিসিএস পরীক্ষাকে কেন্দ্র করে যে চাপ তৈরি হচ্ছে, তা আরো একধাপ শিক্ষার অসারতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। ছাত্র-ছাত্রীরা যে শুধু সরকারি চাকরির জন্য পড়াশোনা করছে, তা তাদের ভবিষ্যতের প্রতি এক গভীর বিপদ সংকেত। যদি শিক্ষা ব্যবস্থা শুধুমাত্র সরকারি চাকরি প্রাপ্তির মাধ্যম হয়ে থাকে, তবে তা কর্মমুখী দক্ষতা ও সৃজনশীলতাকে দমন করবে, যা একদিকে বেকারত্ব বাড়াবে, অন্যদিকে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করবে। যা দ্বারা দেশের মঙ্গলময় কোনো কিছু প্রত্যাশা করাটা দুষ্কর বলা চলে। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে নিয়ে দেশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও শিক্ষা গবেষকদের ভাবতে হবে। উন্নতিকরণের নতুন কোনো পদক্ষেপ বের করতে হবে নয়তো আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার অবস্থান অনেকটা বিলিনের পথে। নামে যে সংস্করণ হচ্ছে তা কিন্তু কোনো কাজের সংস্করণ হচ্ছে না। আমাদের এই শিক্ষাব্যবস্থার একটি বড় পরিবর্তন প্রয়োজন, যাতে শিক্ষার্থীরা শুধুমাত্র চাকরি পাওয়ার উদ্দেশ্যে নয়, বরং চিন্তা-ভাবনা, সমস্যা সমাধানের দক্ষতা এবং আত্মবিশ্বাসী নাগরিক হয়ে উঠতে পারে। শিক্ষাব্যবস্থায় গবেষণার সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা, শিক্ষকদের বেতন ও মর্যাদা বৃদ্ধি, কর্মমুখী শিক্ষা, বাজেট বরাদ্দ বৃৃদ্ধি, গুণগত শিক্ষার জন্য রাষ্ট্রীয় নীতির উন্নয়ন আবশ্যকীয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন অনিবার্য। বিশ্বায়নের এই যুগে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা যদি আন্তর্জাতিক মানের না হয়, তবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য তা একটি বড় বাধা হয়ে দাঁড়াবে। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় সুনির্দিষ্ট, বাস্তবসম্মত ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করা জরুরি। শুধুমাত্র কারিকুলাম পরিবর্তন নয়, বরং শেকড় থেকে শুরু করে শিক্ষাব্যবস্থার সমস্ত স্তরেই পরিবর্তন আনা প্রয়োজন, যাতে আমাদের শিক্ষার্থীরা শুধু সনদপত্র নয়, বরং উন্নত মানের জ্ঞান, দক্ষতা ও আত্মবিশ্বাস নিয়ে ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যেতে পারে। তবেই আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার মানোন্নয়ন সম্ভব হবে বলে প্রত্যাশা করা যায়।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত