একবারও চাইনি, আমি যদি অমুকের মতো ভালো মানুষ হতে পারতাম। হাজারবার আফসোস করে বলেছি, আমার অমুকের মতো টাকা নেই। কখনো কি ভেবেছি, আমি যদি তার মত জ্ঞান অর্জন করতাম? বারবার চেয়েছি, আমার তাদের মত ক্ষমতা হোক। তবে দেখিয়ে দেবো! মানুষের মধ্যে নেতিবাচক গুণাগুণ অর্জন করার জন্য যেমন বাসনা, তেমন ইচ্ছা ইতিবাচক কিছু অর্জনের জন্য নেই। মানুষ জীবদ্দশায় অর্থ-সম্পদ এবং ক্ষমতার জন্য যতটা হা-হুতাশ করে, উত্তম চরিত্র গঠন কিংবা মানুষের মতো মানুষ হওয়ার জন্য ততটা সচেষ্ট হয় না। মানুষ যেন কেমন? অচেনা। যতটা ভালো মুখে বলে ততটা ভালো কাজের মাঝে হয় না।
সমাজে ভালো মানুষ বেশি নাকি মন্দ মানুষ বেশি? সঠিক সংখ্যা জানি না। কেউ কোনোদিন কোনো পরিসংখ্যানও করেনি। তবে অসৎ লোকের উৎপাত ও উৎপাদন আপাতত বেশি। বর্তমানে ভালো মানুষের নিরবতা আরো বেশি। মানুষদের অধিকাংশই অগাধ সম্পদশালী হতে চায়। উৎসের বাছবিচার করে না, নিয়ে ভাবেও না। কে কীভাবে মানুষকে ঠকাবে এবং অন্যকে ঠেকিয়ে রাখবে- সেই ভাবনাতেই সন্ধ্যা হয়। নিজের ভুলগুলো পরিবর্তন করা উচিত, ভালোর আলো স্পর্শ করা উচিত- তেমন চেষ্টা কতজনের মধ্যে দৃশ্যমান? সমাজে সব ধরনের অপরাধ বিস্তৃত হচ্ছে। মানুষের মধ্যে নৈতিকতা না থাকলে, সত্য না জন্মালে এবং ধর্মভীরুতা তৈরি না হলে- সেই মানুষ আর মানুষ থাকে না; পশুদের পাশবিকতায় বদলে যায়। পত্রিকায়- খবরে আমরা কী দেখছি?
মস্তিষ্কের মধ্যে অসুস্থতা এবং নেতিবাচক চিন্তাভাবনা এত গভীরভাবে প্রবেশ করেছে, যাতে মানুষ মিথ্যাচারে মেতে উঠেছে। সুদণ্ডঘুষ স্বাভাবিক জীবনযাপনের অংশ হয়েছে। দুর্নীতি বাসা বেঁধেছে মানুষের মনে ও চিন্তার রন্ধ্রে। মানুষ যেকোনো উপায়ে ধনী হতে চায়। আজকাল মানুষ আর মানুষ হতে চায় না বললেই চলে। মানুষ মিথ্যা বলবে, অসৎ পথে চলবে, লুটতরাজ করবে, খাদ্যে ভেজাল মেশাবে কিংবা অন্যের ক্ষতি করবে- যেন শয়তানের নিত্যকার রুটিনে মানুষ ভাগ বসিয়েছে। মানুষ এখন সুখের বদলে অসুখ তালাশে ব্যস্ত। অন্যের ক্ষতি করতে সে বিনিয়োগ করে। মানুষে মানুষে শত্রুতা সৃষ্টি করে সে তৃপ্ত হয়। হাতাহাতি, মারামারিতে মত্ত রয়।
মানুষ এখন নিজের কল্যাণের তরে যতটাভাবে তার চেয়েও অধিক চেষ্টা করে অপরের ক্ষতি করতে। ‘আমার এক চোখ অন্ধ হয়ে যাতে সবার দুই চোখ বন্ধ হয়’ এমন জীবনদর্শন মানুষকে রোজ অমানুষ করে দিচ্ছে। যেকোনো উপায়ে সম্পদ অর্জন, যেকোনো তরিকায় মানুষকে চেপে রাখা কিংবা কারো অধিকার কেড়ে খাওয়া- মানুষ এসবকে অপরাধ ভাবতেও ভুলে যাচ্ছে। কত সাবলীলভাবে ঘুষ গ্রহণ করছে, অনায়াসে মিথ্যা সাক্ষ্য দিচ্ছে এবং অবলীলায় দুর্বলকে পিষে দিচ্ছে। দুর্নীতিবাজরা তাদের স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ। সভ্যতাকে বিনষ্ট করতে, দেশটাকে লুটে খেতে এবং সমাজটাকে বিষিয়ে দিতে মানুষ এখানে স্বার্থবাদের আসর জমিয়েছে। চুষে খাওয়া, পেষণ করা- সবলের অঙ্গীকার। মেনে যাওয়া, চুপ থাকাণ্ড দুর্বলের সংবিধান।
ভালোর দিকে আমাদের যাত্রা হোক। জীবনে সম্পদের গুরুত্ব অস্বীকার্য নয়, তবে ভালো মানুষ হওয়ার মতো ততটা জরুরি নয়। আগে সোনার মানুষ হতে হবে। তারপর অন্যসব। প্রত্যেকটি কথা ও কাজের পেছনে নৈতিক মানদ- থাকতে হবে। প্রত্যেকটি পদক্ষেপে ধর্মনীতি মানতে হবে। এই জীবনে মূর্খ হওয়ার মাঝে কোনো সফলতা নেই। সত্য জানতে হবে এবং জানাতে হবে। যা কিছু কল্যাণকর সে সবকিছুর অংশীজন হতে হবে। একেকজন ভালো মানুষ একেকটি বাতিঘর। সমাজে বাতিঘরের সংখ্যা ক্রমশ আশঙ্কাজনকভাবে কমে যাচ্ছে। সমাজের আলো বাড়ানোর প্রজেক্ট নিজের থেকেই শুরু হওয়া উচিত। আমাকেই তো আমার কাজের কৈফিয়ত দিতে হবে। যা কিছু সুন্দর তা যদি নিজের মাঝে গড়া যায় তবে জীবনের কাছে মধু থাকবে এবং মৌমাছি সে মধু গ্রহণ করতে আসবে। ভালোর চক্র মৌমাছিতেই সমাপ্তি হয় না। ভালোর মধু গ্রহণ করে জাতিসত্তা উন্নত হবে।