ঢাকা শুক্রবার, ২০ জুন ২০২৫, ৬ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

২৪-এর গণঅভ্যুত্থানে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা

২৪-এর গণঅভ্যুত্থানে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা

মনির হোসেন ও ড. এবিএম শওকত আলী

মানবেতিহাসে ‘ইতিহাস কখনো বিদায় বলে না, ইতিহাস ঐতিহাসিক প্রয়োজনেই বলে আবার দেখা হবে (এদিয়ার্তু)।’ কালান্তরে ‘ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটে, প্রথমত ট্র্যাজেডি, দ্বিতীয়ত প্রহসন (কার্ল মার্কস)।’ ট্র্যাজেডিস্বরূপ বাংলাদেশে গণঅভ্যুত্থানে ৬৯-এর আইয়ুব খান, ৯০-এর এরশাদ পতনের ৩৪ বছর পর; ২৪-এর সংগঠিত গণঅভ্যুত্থানে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সাথে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা ফ্যাসিবাদ ও স্বৈরাচারবিরোধী লড়াইয়ে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটানোর অন্যতম রটনাকারীর ভূমিকা পালন করেছে। ৬৯, ৯০ সালের সামাজিক ও সাংস্কৃতিকগত ঘটনাবলিই যেমন সমকালিন পটভূমি তৈরি করেছিল। ২৪-এর গণঅভ্যুত্থানের ঘটনাগুলো তারই নামান্তর। একথা অনস্বীকার্য যে, ২৪-এর গণঅভ্যুত্থানে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার বাইরে; বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নিহত ও আহত অত্যধিক। নিকট অতীতে কর আরোপ নিয়ে ‘শিক্ষা কোনো পণ্য নয়, শিক্ষা সবার অধিকার’ ১৫-এর ভ্যাটবিরোধী আন্দোলন, ১৮-এর কোটা সংস্কার ও নিরাপদ সড়ক আন্দোলন এবং নাগরিক হিসেবে প্রাত্যহিক জীবন-সংগ্রাম বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের সাহস সঞ্চারে যে কালানুক্রমিক অভিজ্ঞতার জন্ম দিয়েছে; ২৪-এর গণঅভ্যুত্থানে তাদের অবদান ‘বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের’ এক যুগান্তকারী ঘটনা।

উচ্চশিক্ষা ও বেকারত্ব : ঔপনিবেশিক ব্রিটিশরা অখণ্ড ভারেত ঘন ঘন বিদ্রোহ দমন ও শোষণ-পাচার অব্যাহত রাখতে সমাজের একটা অংশকে নিজেদের আজ্ঞাবহ করে শিক্ষিত এবং সৃষ্টিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির স্থাপন করেছিল ‘কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় (১৮৫৮)’। রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ১৯০৫-১৯২৩, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (১৯২১), রাজশাহী বিশ্বদ্যিালয় (১৯৫৩), বাকৃবি (১৯৬১), বুয়েট (১৯৬৩), চট্টগ্রাম (১৯৬৬), জাহাঙ্গীরনগর (১৯৭০) সবমিলিয়ে স্বাধীনতার (১৯৭১) আগ পর্যন্ত বাংলাদেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা দাঁড়ায় ছয়টি। ১৯৮২ সালে মুক্তবাজার অর্থনীতিতে প্রবেশায়নে উদ্ধৃত পুঁজি বেসরকারি খাতে শিল্প-কারখানার মালিক ও শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিদের অবদানে সৃষ্টি হয় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন (১৯৯২)। ২০১০ সালেও এই আইন পরিবর্ধিত ও সংশোধিত হয়ে ‘বর্তমানে দেশে প্রায় ৫৩টি পাবলিক ও ১১০টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে (প্রথম আলো, ২৪)।’ বস্তুত, দেশে বিশ্ববিদ্যালয় আছে সত্য- আক্ষরিক অর্থে গবেষণায়, উদ্ভাবনে, সৃজনশীলতায় অবদান দুর্বিষহ ক্ষীণ। বরং প্রচলিত রাষ্ট্রীয় শিক্ষাব্যবস্থায় উচ্চশিক্ষিত বিশাল গ্র্যাজুয়েট বাহিনী তৈরির কারখানায় যারা এক ফ্যাক্টরি থেকে বের হয়ে আরেক ফ্যাক্টরিতে নিজেদের আধুনিক দাসানুদাস ও ম্যানেজার রূপে আত্মপ্রকাশ করে। তাতে ‘আমরা কেবল অফিস আদালতের, কলকারখানার শ্রম বিক্রির প্রয়োজনীয় দাসানুদাস সামগ্রী হয়ে উঠি’ (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)। মোদ্দাকথা বিশ্ববিদ্যালয় আটকা পড়ে গেছে গবেষণাবিমুখী চকচকে-ঝকঝকে উচ্চ অট্টালিকার ঔপনিবেশিয়ান শাসন-কাঠামোর প্রাচ্যের অক্সফোর্ড, প্রাচ্যের ক্যামব্রিজ নামে ঔপনিবেশিক ব্র্যান্ডিংকরণের গণ্ডিতে। অন্যদিকে শিক্ষার ব্যয় বৃদ্ধি সমাজে অভিভাবক ও সামাজিক সম্মানের সাথে যোজন-যোজন দূরত্ব সৃষ্টি করে ফেলেছে। লক্ষ্যহীন এসব উচ্চশিক্ষা গ্রহণকারীদের সমাজ ও পরিবারের নিকট উপহাসের পাত্র হিসেবে পরিচিত পায় মানসম্মত চাকরি না জুটলে। জুটেই বা কয়জনের! এলিট চাকরিই বা আছে কয়টি। বেসরকারি খাত ও তার উপর সরকারি চাকরির বাজার খুবই সংকুচিত। সাথে বেসরকারি চাকরির নিরাপত্তা কম। ফলে বাংলাদেশে পাবলিক-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ শেষে নিশ্চিত সামাজিক নিরাপত্তার জন্য সকলেই সরকারি চাকরি প্রত্যাশা করেন। বস্তুত উচ্চশিক্ষা শেষে বিদেশমুখী তারাও যে গিয়ে খুব ভালো পজিশন করতে পারে বিষয়টা তত সহজ না। ফলে প্রতিনিয়ত আমাদের শ্রমণ্ডবাজারে আগত উচ্চশিক্ষিত এসব বেকারদের জন্য চাকরির বাজার হয়ে দাঁড়িয়েছে অমানবিক, তীব্র প্রতিযোগিতামূলক। সরকারি পরিসংখ্যান মতে-‘বিদ্যমান উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত বেকারত্বের হার সবচেয়ে বেশি, প্রতিবছর ২০-২২ লাখ তরুণ-তরুণী শ্রমবাজারে যুক্ত হওয়া ও দেশে ৬৩ লাখ বেকারের মধ্যে ৮৭ শতাংশই শিক্ষিত বেকার (আজকের পত্রিকা, ২৪)’। ‘আবার অনানুষ্ঠানিক খাতে অতিনিম্ন মজুরি, ঝুঁকিপূর্ণ অভিবাসীর হার বৃদ্ধিতে এগিয়ে আছে দেশের উচ্চশিক্ষিত বেকাররা। বর্তমানে ইউরোপমুখী পিপলের উৎস দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয় (পরিসংখ্যান ব্যুরো, ২০২২)।’ যার মধ্যে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা শিক্ষার্থীর সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি। কিন্তু যারা বিদেশে যেতে পারে না এবং সরকারি চাকরি পায় না; তাদের বিশাল অংশ দেশে তীব্র হতাশার মধ্যে নিমজ্জিত হয়। বিশেষ দেশে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরি মোট জনসংখ্যার ১ শতাংশেরও কম। এই অংশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকারি প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরি পাবার হার ০.০০০৭৪ শতাংশ। মানে সরকারি চাকরি পাওয়াদের মধ্যে শতকরা একজনও না। ফলে তাদের বড় অংশই বেসরকারি চাকরির ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার অভাব; অর্থনৈতিক সংকট, সামাজিকভাবে পাবলিক-বেসরকারি বৈষম্যের শিকার এবং রাষ্ট্রীয় প্রশাসনে তাদের অনুপস্থিতির দৃশ্যমানতা; মানবিক দায়বদ্ধতা সবমিলিয়ে ক্রমান্বয়ে তাদের মধ্যে দীর্ঘ ৩০ বছরে ক্ষোভের যে সঞ্চার ঘটেছে; তারই বিস্ফোরণ ২৪-এর গণঅভ্যুত্থানে তাদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ।

ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি (কোটা আন্দোলন) : ১৯৭২ সালে ‘নিহত ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা’র জন্য শেখ মুজিবুর রহমান সরকার সর্বপ্রথম রাষ্ট্রীয়ভাবে কোটা প্রচলন করেছিল। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন হলে মুক্তিযোদ্ধার পাশাপাশি তাদের সন্তান, নাতি-নাতনি ও পরিবারবর্গের জন্য মোট ৩০ শতাংশ আসন বরাদ্দবাবদ সংরক্ষণে ৫৬ শতাংশ কোটায় একীভূত করা হয়। স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরও মাত্র ৪৪ শতাংশ চাকরি মেধার ভিত্তিতে নির্বাচিত হতো। যা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সংবিধানের ১৯ (১), ২৯ (১) ও ২৯ (২) সমতার অনুচ্ছেদ সমূহ স্পষ্টত অস্বীকার করা। তবে কোটাসংক্রান্ত অসন্তোষের ক্ষোভ ৯০-এর দশকে শেষের স্বল্প আভাস পাওয়া যায়। অন্যত্র বিশ্লেষণে- রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্ব, স্বজনপ্রীতি, আঞ্চলিক প্রীতি, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রীতি, দুর্নীতি ছাড়াও সবমিলিয়ে মেধাবীরা যে কোনো পরীক্ষায় কোটার অধীনে থাকা প্রার্থীদের চেয়ে বেশি নম্বর পেয়েও বঞ্চিত হয়েছেন। এই নিয়ে সর্বপ্রথম ২০১৩ সালে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আব্দুর রহিমে’র আহ্বায়কে ২০১৩ সালে মেধা মূল্যায়ন মঞ্চ নামে ১০ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করেছিল (প্রথম আলো, ২০১৩)।’ প্রাথমিক এ আন্দোলন নির্বাচনের উত্তাপের কারণে তেমন আর আগায়নি। তবে বিভিন্ন পত্রপত্রিকাবাবদ জানা যায় ২০১৩ সালে প্রথম কোটা সংস্কার আন্দোলনে একমাত্র বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বল্পসংখ্যক শিক্ষার্থীর প্রত্যক্ষ সম্পৃক্ততা ছিল। পাঁচ বছর পর দ্বিতীয় মেয়াদে ২০১৮ সালে সংগঠিত কোটা সংস্কার আন্দোলন ছিল বাংলাদেশে সব ধরনের সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে কোটা সংস্কার বলবৎ; মেধার ভিত্তিতে নিয়োগের দাবিতে সংগঠিত একটি আন্দোলন। আন্দোলনকারীরা চাকরির ক্ষেত্রে কোটা ব্যবস্থার ৫টি দাবি নিয়ে ১০ শতাংশ সংস্কার চেয়েছিল। কিন্তু প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়ানো ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের আক্রমণ, হামলায় আহত ও নির্যাতনের শিকার হয় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। সরকার যদিও ছাত্র আন্দোলনে পূর্ব আতঙ্ক থেকে আগেভাগেই প্রতিষ্ঠার পর থেকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রকাশ্যে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করে রেখেছিল। এতদসত্ত্বেও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে তখন ‘নর্থ সাউথ, ব্র্যাক, মানারাত, ড্যাফোডিল, বিইউবিটি, নর্দান ইউনিভার্সিটি; ঢাকার বাইরে বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের (সমকালিন জাতীয় পত্রিকাসমূহ, ১৮)’ শিক্ষার্থীরা ১৮-এর কোটা আন্দোলনে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলন সংগঠিত করার ব্যাপারে ভূমিকা পালন করেছিল। প্রতিকূল পরিস্থিতিতে এপ্রিল, ১৮ সালে তখন শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদে প্রদত্ত এক ভাষণে আন্দোলনকারীদের সংস্কার প্রস্তাব প্রাধান্য না দিয়ে সরাসরি চাকরিতে সব ধরনের কোটা বাতিল ঘোষণা করেন। পরে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সরকারি চাকরিতে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে কোটা বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করে। বস্তুত এই পরিপত্র জারির মধ্য দিয়েই কোটা আন্দোলন পরিসমাপ্তি ছিল। কিন্তু সমাপ্ত হয়নি। বরং সরকারি চাকরিক্ষেত্রে লাগাতার রাজনৈতিক প্রীতি, যথেষ্ট কর্মসংস্থানের অভাব, তীব্র উচ্চশিক্ষিত বেকারত্ব, মূল্যস্ফীতি, দেশে এক যুগ ধরে চলা রাজনৈতিক সংকট- সবমিলিয়ে রাজনৈতিক দেউলিয়া আওয়ামী লীগের জনগণের সাথে দূরত্ব বৃদ্ধির মধ্যে পুনরায় বেকার যুবক সম্প্রদায়ের সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে কোটা বিষয়ে হস্তক্ষেপ- যা তৃতীয় মেয়াদে ২০২৪ এসে আবারও শুরু হয়।

গণঅভ্যুত্থানে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা : পহেলা জুলাই থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে কোটা সংস্কার আন্দোলন ৮ জুলাই পালিত বাংলা ব্লকেড কর্মসূচি রাজধানীর বাইরে জেলা, উপজেলা পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। ১৪ জুলাই শেখ হাসিনা ঢাকায় সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বলেন- ‘মুক্তিযোদ্ধার নাতি-পুতিরা কোটা পাবে না, তাহলে কী রাজাকারের নাতি-পুতিরা কোটা পাবে। ২০১৮ সালে আমি বিরক্ত হয়ে কোটা বাতিল করেছিলাম।’ বক্তব্যের জেরে নিগৃহীত ছাত্র সমাজের মধ্যে বাড়ে ক্ষোভ। রাতের বেলায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র হলে প্রতিবাদস্বরূপ মিছিল বের হয়। পরের দিন আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে ঢাকা, রাজশাহী, জাহাঙ্গীরনগর, চবি, খুবি, রোকেয়া, সাস্টসহ সমস্ত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৫ জুলাই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের উপর আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা অস্ত্রশস্ত্র হামলায় ১৬ জুলাই সারা দেশের আন্দোলন আরো তীব্র হয়। এদিন দুপুরে ১৬ জুলাই রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্র আবু সাঈদ আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে প্রথম শহীদ হলে কোটা সংস্কার আন্দোলনের গতিমুখ পাল্টে যায়; বন্ধ হয়ে যায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। নেমে আসে স্থবিরতা। কিন্তু ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে ১৭ জুলাই ঢাকার নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী আসিফ নিহত হলে ১৮ জুলাই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো একক প্রতিবাদস্বরূপ রাজপথে নেমে আসে। বিশেষ করে নর্থ সাউথ, নর্দান, উত্তরা, বিইউবিটি, মানারাত, ইস্ট ওয়েস্ট, ব্র্যাক, সিটি, সাউথ ইস্ট, আহসানউল্লাহ, ইউল্যাব, ইনডিপেনডেন্ট, ইউআইইউ, গণ বিশ্ববিদ্যালয়সহ প্রায় সব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সম্মিলিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ব্যানারে ঢাকার বিভিন্ন পয়েন্টে অবরোধ, প্রতিবাদ মিছিল করে। অংশগ্রহণ করে পাবলিক-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সাথে সর্বস্তরের মানুষ। পরে সরকারের পক্ষে আন্দোলন আর থামানো সম্ভব হয়নি। এর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের মধ্যে শুধু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিহত শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ২২। ক্রমবর্ধমান আন্দোলনে সরকারি, বেসরকারি স্কুল, কলেজের শিক্ষার্থীরা গণহারে অংশগ্রহণ পরিস্থিতি অবনতি হলে সরকার তরিঘড়ি করে ২১ জুলাই, ২৪ সরকারি চাকরিতে ৯৩ মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ পরিপত্র জারি করে। কিন্তু ২২ জুলাই ছাত্ররা দাবি তোলে চার দফা কর্মসূচি। সারা দেশে কারফিউ জারিপূর্বক ২৬ জুলাই থেকে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে সারা দেশে হামলা-মামলাসহ ঢাকার বাইরে ও ঢাকার ভেতরে বাড্ডা থানাতে ১০ হাজার, গুলশান থানায় ৭ হাজার, ভাটারা থানায় ৩ থেকে ১২ হাজার, মিরপুরে ১ হাজার জনকে আসামি করে মামলায় গ্রেপ্তারে গোয়েন্দা সংস্থা, বিজিবি, পুলিশ, র‌্যাব ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নিয়ে এলাকাভিত্তিক ব্লক রেইড দিয়ে শিক্ষার্থীদের বাসা থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। হতাহতের সংখ্যা বৃদ্ধি, জেলে প্রেরণ, রিমান্ড প্রেরণ, আগুনে পুড়িয়ে হত্যা প্রভৃতি মিলিয়ে শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে তোলা হয় ১ দফা- ‘দাবি এক, হাসিনার পদত্যাগ’।

সার্বিক পর্যালোচনায় দেখা যায় ১৮ জুলাই ১০টায় ঢাকার উত্তর অংশে ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ও ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা ঢাকার নতুন বাজারে আমেরিকান দূতাবাসের আন্দোলন শুরু করে। একই সময়ে আরেকটি অংশ ঢাকার রামপুরা-বাড্ডায় ইস্ট ওয়েস্ট, ব্র্যাক, আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল, নর্থ সাউথ শিক্ষার্থীদের রাস্তা অবরোধে যোগ দেয় ইউনিভার্সিটি অব ইনফরমেশন টেকনোলজি অ্যান্ড সাইন্স (ইউআইটিএস)সহ আশপাশের সরকারি ও বেসরকারি স্কুল, কলেজ ও অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালের শিক্ষার্থীরা। পরপর তিনটি মূল পয়েন্টে অবরোধের ফলে কার্যত উত্তর ঢাকা ও ব্যস্ততম কূটনীতিক পাড়া অচল হয়ে পড়ে। ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ায় আতঙ্ক ছড়ায় চতুর্দিকে। আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও পুলিশ অবস্থান নিলে বাঁধে আরো সংঘর্ষ। পরের দিন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা নর্দান, ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ও ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিতে পুলিশ হামলা করলে পাশে দাঁড়াতে নর্থ সাউথ, আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল, ইন্ডিপেন্ডেন্ট, ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল, ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল, প্রাইম এশিয়া ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি অফ ইনফরমেশন টেকনোলজি অ্যান্ড সাইন্সসহ অন্যান্য হাজার হাজার শিক্ষার্থীরা মিছিল নিয়ে রামপুরার উদ্দেশ্যে যাত্রা করলে মধ্যবাড্ডায় পুলিশ মিছিলে গুলিবর্ষণ করে। মিরপুরে বিইউবিটি, বিইউপিসহ আশপাশের কলেজের শিক্ষার্থীদের উপর দফায় দফায় হামলা হয়। উত্তরায় ওয়াল্ড, শান্ত-মারিয়াম, উত্তরা ইউনিভার্সিটি; দক্ষিণ-পূর্বে মোহাম্মদপুর, ধানমণ্ডি, লালমাটিয়া, সংসদ ভবন এলাকায় ইউল্যাব, ইউওডিএ, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটিসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা রাস্তা অবরোধে ব্যাপক সংঘর্ষ ও গোলাগুলি সংগঠিত হয়। গুলিবিদ্ধ ও আহত হয় শত শত শিক্ষার্থী। ঢাকার বাইরে চট্টগ্রামের নিউমার্কেট এলাকায় বিজিসি ট্রাস্ট ও প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটি চট্টগ্রাম; রাজশাহীতে বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়; খুলনায় নর্দান ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি শিক্ষার্থীরা এ আন্দোলনের প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেছে।

শিক্ষার্থীদের আসার কারণ : বাংলাদেশে ১৯৯৭-২০১২ সালের মধ্যে জন্মগ্রহণ করা প্রজন্মকে আখ্যায়িত করা হয়েছে জেন-ত জেনারেশন নামে। এই জেনারেশনের শিক্ষার্থীরাই ছিল মূল সংগঠক ও আন্দোলনকারী। যাদের একটা অংশ সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজে অধ্যয়নরত এবং উচ্চশিক্ষা শেষে বৃহৎ অংশ বেকার। প্রাপ্ত বয়স থেকে তারা দেশে আওয়ামী লীগের ভোটার বিহীন নির্বাচন, ইতিহাসকে একক ব্যক্তি-দলের আদলে ইতিহাসিকীকরণ; আয়নাঘর, দমন-পীড়ন, হত্যা-গুম, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, দুর্নীতি, ঋণনির্ভর বাজেট, শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ, বে-হিসাবি উন্নয়ন প্রকল্প, তীব্র বেকারত্ব; রাষ্ট্র পরিচালনায় প্রশাসন, আমলা, দলীয় ক্যাডার ও পুলিশ নির্ভরশীলতা, হিন্দুত্বপ্রীতি, ভারতপ্রীতি; এবং বাংলাদেশে বুর্জোয়া রাজনৈতিক চরিত্রের আওয়ামী-বিএনপি-জামায়াত-জাতীয় পার্টির ভোট নিংড়ানোর রাজনীতি প্রভৃতি সবমিলিয়ে জেন-ত ছিল রাষ্ট্র ও সরকার ব্যবস্থার প্রতি ক্ষোভান্বিত ও গোটা ব্যবস্থার প্রতি অপরাগ। আর এসব বিষয়গুলো মানসিকভাবে জেন-ত কে আন্দোলনমুখী করে তুলেছে।

২৪-এর গণঅভ্যুত্থানে নিহত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর সংখ্যা : পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য যাচাই-বাছাই পূর্বক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের সাথে যোগাযোগ, সাক্ষাৎকার এবং সরেজমিন প্রাপ্ত তথ্যের পর্যালোচনার ভিত্তিতে সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিহত হওয়ার স্পষ্ট পরিসংখ্যান পরিচয়সহকারে তুলে ধরা হলো। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় : ‘নর্দান ইউনিভার্সিটি একজন (আসিফ হাসান-ইংরেজি বিভাগ; বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে দ্বিতীয় শহীদ, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ১ম); বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যান্ড টেকনোলজি [বিইউবিটি] ৩ জন- (তাহমিদ আবদুল্লাহ অয়ন-সিএসই, সুজন মাহমুদ মিথি-ইইই বিভাগ, আহসানুল দীপ্ত- সিভিল ইঞ্জিনিয়ার ডিপার্টমেন্ট); সাউথইস্ট ৪ জন (কামরুল হাসান রাব্বি-ইইই ডিপার্টমেন্ট, রাকিব হাসান-টেক্সটাইল ডিপার্টমেন্ট, ইমতিয়াজ আহমেদ জাবির-বিবিএ, রবিউল ইসলামণ্ডটেক্সটাইল ডিপার্টমেন্ট); বিইউপি দুইজন (মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধ- খুবি থেকে গণিতে স্নাতক এবং মৃত্যুর সময় বিইউপিতে এমবিএ অধ্যয়নরত ছিলেন, জোবায়ের ওমর খান-আইন বিভাগ); নর্থ সাউথ ১ জন (আবদুল্লাহ আল আবির- এ বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করতেন); সিটি ইউনিভার্সিটি দুইজন (মো. সাজ্জাদ হোসেন সজল- টেক্সটাইল বিভাগ, আহনাফ আবির-ইইই ডিপার্টমেন্ট); ইউরোপিয়ান ইউনিভার্সিটি দুইজন (তৌফিকুল ইসলাম ভূঁইয়া-ইইই বিভাগ, নয়ন শেখণ্ডআইন বিভাগ); গাজীপুর ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি একজন (জাহিদুজ্জামান তানভীন-মেকানিক্যাল অ্যান্ড প্রডাকশন ইঞ্জিনিয়ারং বিভাগ); মানারাত ইউনিভার্সিটি: দুজন (শাকিল পারভেজ-বিবিএ, আশরাফুল্লাহ-ইইই বিভাগ); ড্যাফোডিল দুজন (শাহরিয়ার আল আফরোজ শ্রাবণ, রমিজউদ্দিন আহমেদ রূপ); সোনারগাঁও ইউনিভার্সিটি দুজন (রাসেল মাহমুদণ্ডবাংলা বিভাগ, সাজ্জাদ হোসেন-অ্যাপারেল মার্চেন্টাইজিং ডিপার্টমেন্ট); ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অল্টারনেটিভ একজন (জুলফিকার আহমেদ শাকিল- চারুকলা বিভাগ); ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল এজন (মোহাম্মদ ইরফান ভূঁইয়া-সিএসই); ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি একজন (শাহনেওয়াজ ফাহাদ); পাঠশালা সাউথ এশিয়ান ইনস্টিটিউট: একজন (তাহির জামান প্রিয়); নিকুঞ্জ ক্রাউন ইনস্টিটিউট অব বিজনেস টেকনোলজি একজন (আকরাম খান রাব্বি); বিজিএমইএ ইউনিভার্সিটি অব ফ্যাশান অ্যান্ড টেকনোলজি একজন (মো. সেলিম তালুকদার-অ্যাপারেল মার্চেন্টাইজিং ডিপার্টমেন্ট); মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি দুজন (শাইখ আসহাবুল ইয়ামিন- সিএসই ডিপার্টমেন্ট, মো. রাকিবুল হোসেন-মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারং বিভাগ); সিসিএন ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি : ১ জন (হামিদুর রহমান-পুরপ্রকৌশল বিভাগ); ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি একজন (আসিফ ইকবাল); বরেন্দ্র ইউনিভার্সিটি, রাজশাহী একজন (সাকিব আনজুমণ্ডসিএসই ডিপার্টমেন্ট ); প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটি, চট্টগ্রাম একজন (ফয়সাল আহমেদ শান্ত); বিজিসি ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটি, চট্টগ্রাম একজন (কাউসার মাহমুদ); বাংলাদেশ অব গ্লাস অ্যা- সিরামিক একজন (আবদুল্লাহ আল তাহির); তাছাড়া দেশে অবস্থানরত মালয়েশিয়া টিংকু আবদুল রহমান ইউনিভার্সিটি অব ম্যানেজমেন্ট টেকনোলজির একজন (শ্রাবণ গাজী-সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার), প্রাইম এশিয়া ইউনিভার্সিটি একজন (আহনাফ শরীফ-মাইক্রোবায়োলজি বিভাগ) ও অজ্ঞাতনামা দুজন। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়: বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়-আবু সাঈদ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়-জহিরুল ইসলাম, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়-আহসান হাবিব তামিম, একরামুল হক সাজিদ; কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়-কাইয়ুম; চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়-হৃদয় চন্দ, রাসেল; শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়-রুদ্র সেন, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়-নাইমুর রহমান। [জুলাই-ডিসেম্বর, ২০২৪]

বর্ণিত তথ্য বিশ্লেষণে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নিহত শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৯ জন। পক্ষান্তরে দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নিহত শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৪০ জন। যা বাংলাদেশের ‘রাজনৈতিক ইতিহাসে’ স্মরণকালের চেয়ে সবচেয়ে বেশি। আহত ও গুলিবিদ্ধ শিক্ষার্থীর সংখ্যাও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অগণিত।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের ভূমিকা : দেশে সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ, স্বায়ত্তশাসন অনুপস্থিত। তাছাড়া বাংলাদেশে ‘রাজনীতি, দল ও রাজনৈতিক সংস্কৃতি’ ‘শিকার-শিকারি’ পর্যায়ে আবর্তিত। ফলপ্রসূত, রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন দল আরেক দলের উপর চালায় নির্মম উৎপীড়ন ও নিপীড়ন। ক্ষমতা থেকে ছিটকে যাবার ভয়ে অতীতের ন্যায় এরা দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপর ভর করে। কারণ বাংলাদেশ সৃষ্টির পেছনে ছাত্র রাজনীতি ভূমিকা অত্যধিক। ফলে এরকম পূর্বের একটা আতংক জায়গা থেকে আমাদের ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতাহীন রাজনৈতিক দলগুলো রাজনৈতিক কর্মসূচিতে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র রাজনীতিতে প্রত্যক্ষ এবং শিক্ষকদের মধ্যে পরোক্ষ বলয় রাখতে সদা তৎপর। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সরাসরি ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতি থাকলেও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে নিষিদ্ধ। তাছাড়া বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বৈষম্যমূলক বেতন কাঠামো, পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধার অভাব, মানসম্মত আবাসনের অভাব ছাড়াও বিশেষ করে শিক্ষকদের চাকরির নিরাপত্তা সংক্রান্ত ঝুঁকি সবচেয়ে প্রবল। ফলে পার্থক্যের মাত্রা নানাবিধ দিক থেকে স্পষ্ট থাকায় তারা গণআন্দোলন ও গণ-আকাঙ্ক্ষার বৈপরীতমুখী। পরোক্ষভাবে নিয়ন্ত্রিত বলা চলে। নিয়ন্ত্রিত কারণ; যিনি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা করেন তাকে ওই প্রতিষ্ঠানের কড়া নিয়মণ্ডনীতির বেড়াজালে আবদ্ধ থাকতে হয়। পক্ষান্তরে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যেহেতু ব্যক্তি মালিকানাধী; ফলে প্রতিষ্ঠানের প্রধান তিনিও কোনো না কোনোভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলায় সরকারবিরোধী মন্তব্য, অংশগ্রহণ যাতে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি প্রতিকূলে না যায় সেই দিক থেকে তিনি সরকার ও ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকেন। মূলত ব্যবসায়িক ও প্রাতিষ্ঠানিক বিপদসংকুল পরিস্থিতি, ঝুঁকিহ্রাস ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাসীন দলের খড়গকৃপার আগাম বিপদ মোকাবিলা করার পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিষ্ঠানের প্রধানরা তার প্রতিষ্ঠানের উক্ত বিষয়ে অত্যন্ত সজাগ থাকতে বাধ্য হোন। এতকিছু সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণের পরও ২৪-এর গণঅভ্যুত্থানে (১৭ জুলাই-আগস্ট ৪, ২০২৪) বাংলাদেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বল্পকিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সচেতন শিক্ষকরা ছাত্রদের ন্যায্য আন্দোলন প্রাতিষ্ঠানিক বাধা অতিক্রম করে সংহতি সমাবেশে হত্যার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার চেয়ে প্রকাশ্যে মানববন্ধন করেছে। সর্বপ্রথম দেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে শিক্ষার্থীদের পক্ষে সংহতি জানিয়ে প্রতিবাদ সমাবেশ ও মানববন্ধন করেছে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা (৩০ জুলাই)। এর দুদিন পর ঢাকার ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের (৬২৬ শিক্ষক); রাজধানীর বাইরে (জুলাই,২৯-৪,আগস্ট) খুলনার নর্দান ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি (১২৪ জন শিক্ষক), উত্তরা বিশ্ববিদ্যালয়, সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয় ও ইউল্যাবের হাতেগোনা অল্পসংখ্যক শিক্ষকরা সংহতি সমাবেশে বিচার চেয়ে প্রকাশ্যে মানববন্ধন করেছে। তবে ‘বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক’ এর ব্যানারে সংঘবদ্ধ দেশের পাবলিক ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা প্রথম থেকেই এ আন্দোলন প্রত্যক্ষভাবে বুদ্ধিবৃত্তিক ও নানাভাবে আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ মুখ্য ভূমিকা পালন করেছেন।

লেখক পরিচিতি : শিক্ষকদ্বয়-বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যান্ড টেকনোলজি (বিইউবিটি), ঢাকা

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত