নিজের ভাষায় কথা বলার জন্য কত যুদ্ধ, পরিশ্রম। অথচ অনেকই আছেন যাদের ভাগ্যে নিজের ভাষাটুকু উচ্চারণের সেই সুযোগটাই হয়নি আর হয়তো হবেও না। তারা তাদের মনের ভাষা ব্যক্ত করেন নিজের ইশারার মাধ্যমে। সেই ইশারায় কিছু ভাষা রয়েছে। শ্রবণ ও বাকপ্রতিবন্ধী মানুষ ইশারার মাধ্যমে তাদের মনের ভাব প্রকাশ করে। ইশারা ভাষা বা সাংকেতিক ভাষা বা প্রতীকী ভাষা বলতে শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিশেষ করে হাত ও বাহু নড়ানোর মাধ্যমে যোগাযোগ করার পদ্ধতিকে বোঝানো হয়। মুখের ভাষাতে যোগাযোগ করা অসম্ভব বা অযাচিত হলে এই ভাষা ব্যবহার করা হয়। সম্ভবত মুখের ভাষার আগেই ইশারা ভাষার উদ্ভব ঘটে। মুখের বিভিন্ন ভঙ্গিমা, কাঁধের ওঠাণ্ডনামা কিংবা আঙুল তাক করাকে মোটা দাগে ইশারা ভাষা হিসেবে গণ্য করা যায়। সভ্যতার বিকাশের আগে ইশারা ভাষাই প্রচলিত ছিল। তবে প্রকৃত ইশারা ভাষায় হাত ও আঙুল দিয়ে সৃষ্ট সুচিন্তিত ও সুক্ষ্ম দ্যোতনাবিশিষ্ট সংকেত সমষ্টি ব্যবহৃত হয়। এর সাথে সাধারণত মুখমণ্ডলের অভিব্যক্তিও যুক্ত করা হয়। মূক ও বধির লোকেরা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগের জন্য ইশারা ভাষা ব্যবহার করে থাকেন।
ইশারা ভাষা কাদের জন্য জরুরি : বর্ণমালা আবিষ্কারের আগে ইশারায় নিজের মনের ভাব প্রকাশ করতে হতো। আদিম জনগোষ্ঠী ইশারায় তাদের শিকারের গল্প জনতার সামনে তুলে ধরতো। বর্ণমালা আবিষ্কারের ফলে এ আঙ্গিক প্রকাশ বিলুপ্ত হতে থাকে। তবুও বিশেষ শ্রেণির জন্য ইশারাই হয়ে ওঠে ভাব প্রকাশের মাধ্যম। তারই ধারাবাহিকতায় প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে ইশারা ভাষা। যার ইংরেজি হচ্ছে ‘সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ’। একে সাংকেতিক ভাষা বা প্রতীকী ভাষাও বলা হয়ে থাকে। এ ভাষা শ্রবণ ও বাকপ্রতিবন্ধী মানুষের জন্য জরুরি। তারা ইশারার মাধ্যমেই ভাবের আদান-প্রদান করে থাকেন। তবে প্রকৃত ইশারা ভাষায় হাত ও আঙুল দিয়ে সৃষ্ট সুচিন্তিত ও সুক্ষ্ম দ্যোতনাবিশিষ্ট সংকেত সমষ্টি ব্যবহৃত হয়। এর সাথে সাধারণত মুখমণ্ডলের অভিব্যক্তিও যুক্ত করা হয়। মূক ও বধির লোকেরা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগের জন্য ইশারা ভাষা ব্যবহার করে থাকেন। বাংলাদেশের সংবিধানের ২৭ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা আছে যে, ‘সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী।’ এই অনুচ্ছেদ ছাড়াও সংবিধানের মৌলিক অধিকার অনুচ্ছেদে আরো অনেক অধিকারের কথা এসেছে, যেখানে বলা হয়েছে রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিগণ অন্যান্য অপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিগণের অনুরূপ সমান অধিকার ভোগ করবেন। যোগাযোগ ও ভাষা ব্যবহারের অধিকার প্রত্যেক ব্যক্তির মৌলিক অধিকার। এই ভাষা হতে পারে বাচনিক কিংবা অবাচনিক; কিন্তু এর মাধ্যমেই একজন নাগরিক তার মৌলিক অধিকার ও মতামত প্রকাশ করে থাকেন। ইশারা ভাষা একটি অবাচনিক ভাষার প্রয়োগ, যা শ্রবণ ও বাক্প্রতিবন্ধী ব্যক্তির যোগাযোগে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার মহান জাতীয় সংসদে ২০১৮ সালের ১৪ নভেম্বর পাশ করে বাংলাদেশ রিহ্যাবিলিটেশন কাউন্সিল আইন, ২০১৮।
যার তপশিল (ক)-তে রিহ্যাবিলিটেশন পেশাজীবী হিসেবে স্পিচ অ্যান্ড ল্যাংগুয়েজ থেরাপিস্টের পেশাগত লাইসেন্স প্রদানের নিমিত্তে ন্যূনতম যোগ্যতা নির্ধারিত হয়েছে বিএসসি ইন স্পিচ অ্যান্ড ল্যাংগুয়েজ থেরাপি ডিগ্রি। স্পিচ অ্যান্ড ল্যাংগুয়েজ থেরাপিস্ট রাষ্ট্রের নাগরিকের কথা, ভাষা ও যোগাযোগ এবং খাবার গ্রহণ ও গলাঃধকরণ প্রক্রিয়া সমস্যার চিকিৎসা প্রদান করে থাকেন। তাই বাক ও শ্রবণপ্রতিবন্ধীসহ নানা প্রতিবন্ধীর মানুষের জন্য ইশারা বা অন্যান্য অবাচনিক ভাষার কৌশল নির্ধারণ, কারো কারো ক্ষেত্রে সমস্যার ধরন ও মাত্রা অনুয়ায়ী স্বল্প হলেও বাচনিক ভাষার প্রয়োগ এবং সর্বোপরি ইশারা ভাষার সর্বজনীন ও শুদ্ধ ব্যবহার নিশ্চিতকরণে আইন দ্বারা স্বীকৃত দক্ষ ও যোগ্যতাসম্পন্ন স্পিচ অ্যান্ড ল্যাংগুয়েজ থেরাপির ব্যবস্থা করা জরুরি। বাক-শ্রবণপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের পুনর্বাসনে আদালত, থানা, হাসপাতালসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এই স্পিচ অ্যান্ড ল্যাংগুয়েজ থেরাপিস্টের ব্যবস্থা করার কথা প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন, ২০১৩-এর ধারা ২ (৭)-এও বলা হয়েছে, যা দ্রুত কার্যকর হওয়া প্রয়োজন। তাছাড়া দেশের নানা প্রান্তে শ্রবণ ও বাকপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ধর্ষণসহ নানারকম শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়, যা সুস্পষ্টভাবে মানবাধিকারের লঙ্ঘন। যেহেতু তারা তাদের অধিকারের কথা বলতে পারেন না, বা ন্যায়বিচার চাইতে অপারগ হন, তাই অনেকাংশে তারা তাদের ন্যাঘ্য বিচার থেকে বঞ্চিত হন। পরিশেষে বলতে চাই,বর্তমানে সারাবিশ্বে প্রায় দুই শতাধিক ইশারা ভাষা প্রচলিত রয়েছে। আর মানুষের মনের ভাব প্রকাশের সবচেয়ে বড় মাধ্যম হলো মুখের ভাষা অর্থাৎ কথা। কিন্তু সবাই কি মুখের ভাষা বা শব্দ ভাষায় কথা বলতে পারেন? মনে হয় পারেন না। কারণ, বেসরকারি জরিপে জানা গেছে, বাংলাদেশে প্রায় ৩২ লাখ মানুষ কানে শুনতে পায় না, কথাও বলতে পারে না। তাদের বলা হয় বাক ও শ্রবণপ্রতিবন্ধী ব্যক্তি বা জনগোষ্ঠী। তাদের যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম হলো ইশারা ভাষা।
সম্ভবত পৃথিবীতে মুখের ভাষা সৃষ্টির আগেই সৃষ্টি হয় ইশারা ভাষার। সারা বিশ্বের বাক ও শ্রবণপ্রতিবন্ধী মানুষের যোগাযোগের মাধ্যম হলো এ সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ বা ইশারা ভাষা। আমেরিকান এবং ব্রিটিশ সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ (এএসএল ও বিএসএল) কে মৌলিক ধরে বিভিন্ন দেশে সৃষ্টি হয়েছে আলাদা সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ বা ইশারা ভাষা। যেমন আমাদের দেশের বাক ও শ্রবণপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা বাংলা সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ বা বাংলা ইশারা ভাষায় মনের ভাব আদান-প্রদান করে থাকেন। যেহেতু আমরা ব্রিটিশ শাসনের অন্তর্ভুক্ত ছিলাম, তাই ব্রিটিশ সাইন ল্যাঙ্গুয়েজের একটা বড় প্রভাব রয়েছে বাংলা ইশারা ভাষার ওপর। আর শুধু শ্রবণপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিই নন, ক্যানসার বা দুর্ঘটনাজনিত কারণে কণ্ঠনালির অপসারণ হওয়া ব্যক্তি, স্ট্রোক-পরবর্তী ‘এফাসিয়া’ আক্রান্ত অনেক ব্যক্তি, এপ্রাক্সিয়ার মতো জটিল ভাষাবৈকল্য, অটিজমসহ নানা স্নায়বিক বৈকল্যের বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশু ও ব্যক্তিরও যোগাযোগের অন্যতম প্রধান মাধ্যম হতে পারে ইশারা ভাষা। যেহেতু শ্রবণ ও বাকপ্রতিবন্ধী মানুষ ইশারার মাধ্যমে তাদের মনের ভাব প্রকাশ করে থাকেন। আমরা জানি, শ্রবণ ও বাকপ্রতিবন্ধী মানুষের বৈচিত্র্যময় জীবনের প্রকাশ ঘটে এ ভাষার মাধ্যমে। এছাড়া অটিস্টিক, নিউরোলজিক্যাল ডিজঅর্ডার ও বুদ্ধিপ্রতিবন্ধীদের অনেকে ইশারা ব্যবহারের মাধ্যমে মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করে থাকেন।আসুন আমাদের দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সকল শ্রেণির শ্রবণ ও বাকপ্রতিবন্ধীদের সুস্থ মানুষ হিসেবে দেখি। তাদের উন্নয়নে প্রয়োজন সরকারি বাধ্যবাধকতার সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন। অধিকন্তু ইশারাভাষী জনগোষ্ঠীর অধিকার রক্ষা এবং বাংলা ইশারা ভাষা ইনস্টিটিউট স্থাপন এখন সময়ের দাবি ।
লেখক, সংগঠক, কলাম লেখক ও গবেষক, প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি।