ঢাকা শনিবার, ০৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ২১ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

২৫তম সুন্দরবন দিবস

বাংলাদেশের ফুসফুস সুন্দরবন

মো. তাহমিদ রহমান
বাংলাদেশের ফুসফুস সুন্দরবন

পদ্মা, মেঘনা ও ব্রহ্মপুত্র নদীত্রয়ের অববাহিকায় গড়ে ওঠা পৃথিবীর বৃহত্তম বদ্বীপের জোয়ারধৌত বনভূমি সুন্দরবন। প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি সুন্দরবন দেশের দক্ষিণাঞ্চলকে মাতৃস্নেহে আগলে রেখেছে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বনভূমি হলো সুন্দরবন যাকে বাংলাদেশের ফুসফুস বলা হয়। সুন্দরবনের অন্য নাম বাদাবন। এই বাদাবন বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ের মতো ভয়ংকর সব প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিরুদ্ধে ঢাল হয়ে বাংলাদেশের উপকূলবর্তী জনগণ ও তাদের সম্পদের প্রাকৃতিক নিরাপত্তাবলয় হিসাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। সুন্দরবন রাষ্ট্রীয়ভাবে বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যে অবস্থিত। সময়ের পরিক্রমায় সংকুচিত হতে হতে সুন্দরবনের মোট আয়তন দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার। মোট আয়তনের ষাট ভাগ বাংলাদেশের অংশে। সুন্দরবনের বেশিরভাগ এলাকা বাংলাদেশের সাতক্ষীরা, খুলনা ও বাগেরহাট জেলায় অবস্থিত। মাত্র ৯৫ বর্গকিলোমিটার পটুয়াখালী ও বরগুনায় অবস্থিত।

প্রায় ৪০০ নদী-নালা, খাল এবং ২০০টি ছোট বড় দ্বীপ ছড়িয়ে আছে সুন্দরবনে। সুন্দরবনের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত প্রধান প্রধান নদীগুলো হলো পশুর, শিবসা, রায়মঙ্গল, বলেশ্বর প্রভৃতি। সুন্দরবনের পূর্বে বলেশ্বর এবং পশ্চিমে রায়মঙ্গল। সুন্দরবন অংশে বাংলাদেশ ও ভারতকে বিভক্তকারী নদী হাঁড়িয়াভাঙ্গা। অসংখ্য উদ্ভিদ ও বিচিত্র সব প্রাণীর এক অনন্য আবাসস্থল সুন্দরবন। বিশ্বের আকর্ষণীয়, রাজকীয় ও বিলুপ্তপ্রায় প্রাণীদের অন্যতম ‘রয়েল বেঙ্গল টাইগার’ এর আবাসস্থল সুন্দরবন। বাঘের উপস্থিতির কারণেই সুন্দরবন বৈচিত্র্যময় ও আকর্ষণীয়। বাংলাদেশসহ বিশ্বের মাত্র ১০টি দেশে বাঘ পাওয়া যায়। পূর্বে ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, লাওসে বাঘ পাওয়া গেলেও বর্তমানে এসব দেশের বনাঞ্চল থেকে বাঘ বিলুপ্ত হয়ে গেছে।

বিশ্বব্যাপী বর্তমানে বাঘের সংখ্যা ৩ হাজার ৮৪০টি। ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসে শুরু হয়ে ২০২৪ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত বাঘ গণনায় দেখা গেছে ২০১৮ সাল পরবর্তী বর্তমানে সুন্দরবনে ১১টি বাঘ বৃদ্ধি পেয়েছে। বাঘ না থাকলে সুন্দরবনের প্রতিবেশ ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে চোরাকারবারি ও বনদস্যুদের দ্বারা বাঘ নিধন বন্ধ করতে হবে। সুন্দরবন রক্ষাসহ বাঘের প্রজনন, বংশবৃদ্ধি এবং অবাধ চলাচলের জন্য সুন্দরবনের মোট আয়তনের ৫১ শতাংশ এলাকাকে সংরক্ষিত বন হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। সুন্দরবন পাহারা দেয়ার জন্য স্মার্ট প্যাট্রলিংয়ের ব্যবস্থা রয়েছে। বাঘ সংরক্ষণের জন্য বাংলাদেশ টাইগার অ্যাকশন প্ল্যান ২০১৮-২০২৭ প্রণয়ন করেছে। সুন্দরবনে দুই ধরনের হরিণ পাওয়া যায়। যথা- মায়া হরিণ এবং চিত্রা হরিণ। এ বনে তিন প্রজাতির কচ্ছপ (কেটো কাছিম, সুন্দি কাছিম, ধুম তরুণাস্থি কাছিম) দেখা যায়। বাংলাদেশ বিশ্বে সর্বপ্রথম ডলফিনের অভয়ারণ্য ঘোষণা করেছে। সুন্দরবনের তিনটি এলাকাকে সরকার প্রথম ডলফিনের অভয়ারণ্য ঘোষণা করে।

বাংলাদেশের দেখাদেখি কম্বোডিয়া, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, পাকিস্তান, ভারত এবং নেপাল ডলফিনের জন্য তাদের নদীতে অভয়ারণ্য ঘোষণা করে। বাংলাদেশে এখন প্রায় সাত হাজার ডলফিন রয়েছে। দেশে থাকা ১২ প্রজাতির ডলফিনের মধ্যে স্বাদু পানির ডলফিন আছে দুই প্রজাতির। দেশে ডলফিনের বড় অংশের বাস সুন্দরবনে। সাত হাজারের মধ্যে প্রায় ছয় হাজারই আছে সুন্দরবনে। এর মধ্যে ইরাবতী ডলফিনই পাঁচ হাজার ৮০০টি। অন্যান্য প্রাণীর মধ্যে গিরগিটি, রেসাস বানর, বনবিড়াল, লিওপার্ড, সজারু, উদ, বন্য শূকর, মোহনা কুমির, গুই সাপ, অজগর, হরিয়াল, বালিহাস, গাঙচিল, ঈগল, চিল, মাছরাঙা প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও সুন্দরবনে রয়েছে নানারকম ক্ষুদ্র প্রাণী যাদের সম্পর্কে আমরা খুব কমই জানি। এসব প্রাণী সুন্দরবনকে করে তুলেছে জটিল ও বৈচিত্র্যময়। এই বনে পাওয়া যায় সুন্দরী, গরান, গেওয়া, পশুর, ধুন্দুল, কেওড়া, বাইন, ওড়া, হেন্দাল, কাকড়া প্রভৃতি উদ্ভিদ। সুন্দরী বৃক্ষ ‘লুকিং গ্লাস ট্রি’ নামেও পরিচিত। ‘সুন্দরী’ বৃক্ষের প্রাচুর্যের জন্য এই বনের নামকরণ করা হয়েছে ‘সুন্দরবন’। সুন্দরবনে প্রায় সব খালের পাড়েই ঘনভাবে জন্মে নিপা পাম বা গোলপাতা। স্থানীয়ভাবে পরিচিত বাউয়ালদের পেশা গোলপাতা সংগ্রহ করা। এসব উদ্ভিদ ও প্রাণিবৈচিত্র্যের দ্বারা সুন্দরবনের বাস্তুসংস্থান এবং দেশের পরিবেশের ভারসাম্যও টিকে থাকে। সুন্দরবনের বনসম্পদকে কেন্দ্র করে অনেক শিল্প কারখানা গড়ে উঠেছে। সুন্দরী বৃক্ষ খুঁটি তৈরিতে, গেওয়া নিউজপ্রিন্ট ও দিয়াশলাই কারখানায়, ধুন্দুল পেন্সিল তৈরিতে, গরান বৃক্ষের ছালের কষ রং তৈরি, জাল রং করা ও চামড়া পাকা করার কাজে এবং গোলপাতা ঘরের ছাউনিতে ব্যবহৃত হয়।

সরকারিভাবে পরিচালিত দেশের একমাত্র কুমির প্রজনন কেন্দ্র সুন্দরবনের করমজলে অবস্থিত। সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে জনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে ২০০১ সালে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের আওতায় খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনার স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন রূপান্তর ও পরশ-এর উদ্যোগে এবং দেশের আরো ৭০টি পরিবেশবাদী সংগঠনের অংশগ্রহণে ১৪ ফেব্রুয়ারিকে ‘সুন্দরবন দিবস’ ঘোষণা করা হয়। ‘বিশ্ব ভালোবাসা দিবসে সুন্দরবনকে ভালোবাসুন’ প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে এবার পালিত হচ্ছে ২৫তম সুন্দরবন দিবস। ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে উপকূলীয় মানুষকে বুক পেতে রক্ষা করে সুন্দরবন। কিন্তু দুঃখের বিষয় বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তন, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, ঝড়-ঘূর্ণিঝড়, ভৌগোলিক অবস্থান ও মানবসৃষ্ট দুর্যোগে সুন্দরবন এবং এর জীববৈচিত্র্য বর্তমানে হুমকির মুখে। প্রায় প্রতিবছর ঘূর্ণিঝড়ে সুন্দরবনের গাছপালা ও বন্যপ্রাণীর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। সুন্দরবনের প্রধান উদ্ভিদ ‘সুন্দরী’ও রয়েছে ঝুঁকির শীর্ষে। সুন্দরী গাছ স্বাভাবিকভাবেই অতিরিক্ত লোনা পানি সহ্য করতে পারে না। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সুন্দরবনের লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে, এর ফলে সুন্দরী গাছ নিজেকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হচ্ছে। ফারাক্কা বাঁধের কারণে উজান থেকে পানি কম আসায় সুন্দরবনের সব নদীর পানি ক্রমান্বয়ে শুকিয়ে যাচ্ছে। তাই চোখণ্ডজুড়ানো বিশাল এই অরণ্যের বাস্তুতান্ত্রিক মূল্য সমুন্নত রাখার জন্য রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে নায্য পানির হিস্যা আদায় করতে হবে। সুন্দরবন সম্পদ এবং জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধশালী হওয়ায় ইতিমধ্যে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পেয়েছে। ১৯৯৭ সালে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে সুন্দরবনকে স্বীকৃতি দিয়েছে। তালিকাভুক্ত যে কোনো স্থানের বিশ্ব ঐতিহ্য কেন্দ্র প্রণীত শর্ত অর্থাৎ বৈশিষ্ট্য নষ্ট হয়ে গেলে তাকে প্রথমে ‘বিপদাপন্ন স্থান’ হিসেবে ঘোষণা করা হয় ও তা পূরণ করার জন্য সময় দেয়া হয়। এরপর নির্দিষ্ট সেই সময়ের মধ্যে তা পূরণ করতে ব্যর্থ হলে তখন সেই স্থানকে তালিকা থেকে বাদ দেয়া হয়। বর্তমানে পৃথিবীতে এক হাজার ১২১টি বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের মধ্যে ৫৩টি স্থানকে বিপদাপন্ন বলে ঘোষণা করা হয়েছে।

সুন্দরবনের বাস্তুতন্ত্র যেভাবে ধ্বংস করা হচ্ছে তাতে যে কোনো সময় এই বাদাবনটিও বিপদাপন্ন স্থান হিসেবে ঘোষিত হতে পারে। সুন্দরবনের প্রাকৃতিক বাস্তুসংস্থান ধ্বংস করার পেছনে মানবসমাজের কৃতকর্ম অনেকাংশে দায়ী। অবৈধ বসতি স্থাপন ও অনিয়ন্ত্রিত গাছ কাটায় গত ৫৪ বছরে সুন্দরবন হারিয়েছে ১৪৪ বর্গকিলোমিটার এবং সৌন্দর্যের প্রতীক সুন্দরী বৃক্ষ কমে গেছে প্রায় ২৮.৭৫ শতাংশ, যা পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের জন্য চরম হুমকিস্বরূপ। শিল্প-কলকারখানা, কৃষি, গৃহস্থালি ও নগরকেন্দ্রিক বর্জ্য থেকে শুরু করে নৌযানের তেল ও তেলজাতীয় পদার্থসহ নানা ধরনের দূষক প্রধানত নদীর মাধ্যমে সুন্দরবনের পরিবেশ দূষিত করছে। ২০১৪ সালের ৯ ডিসেম্বর সাড়ে তিন লাখ লিটার ফার্নেস অয়েল নিয়ে ট্যাঙ্ক ডুবির কারণে ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়ে সুন্দরবন। ২০১৫ সালের ৫ মে সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের শরণখোলা রেঞ্জের মরা ভোলা নদীর বিমলের চরে এমভি জাবালে নূর নামে একটি সারবাহী কার্গো ডুবে যায়। জাহাজটিতে প্রায় ৫০০ মেট্রিক টন এমওপি (মিউরেট অব পটাশ) সার ছিল। ২০১৭ সালের ১৪ জানুয়ারি এক হাজার মেট্রিক টন কয়লাবাহী এমভি আইচগাতি লাইটার জাহাজ ডুবে। ২০১৮ সালের ১৫ এপ্রিল ৭৭৫ মেট্রিক টন কয়লা নিয়ে একটি জাহাজ মোংলা বন্দর এলাকায় ডুবে যায়। ২০২১ সালের ৩০ মার্চ পশুর নদীতে ৪০০ টন কয়লাবোঝাই কার্গো জাহাজ ডুবে যায়। ২০২৩ সালের ১৭ নভেম্বর পশুর নদের চরকানা এলাকায় ৮০০ টন কয়লা নিয়ে তলা ফেটে ডুবে গিয়েছিল আরেকটি কার্গো জাহাজ। সেই বছরই ১৫ অক্টোবর মোংলায় পশুর নদে ৮০০ টন ক্লিংকার (সিমেন্টের কাঁচামাল) নিয়ে আরো একটি লাইটার জাহাজ ডুবে যায় । ২০২৪ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি পশুর নদীর কানাইনগর এলাকায় ‘এমভি ইশারা মাহমুদ’ নামে ৯৫০ টন কয়লাবোঝাই একটি কার্গো জাহাজের তলা ফেটে ডুবে যায়। এমন জাহাজডুবির ঘটনা নতুন নয়। বিভিন্ন সময় জাহাজডুবির কারণে বিষাক্ত ফার্নেস অয়েল, সিমেন্ট তৈরির কাঁচামাল (ফ্লাই অ্যাশ) ও সার সুন্দরবনের বিভিন্ন নদী ও খালের পানিতে মিশে ছড়িয়ে পড়ে। এতে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্যসহ মারাত্মক হুমকির মুখে পড়ে সেখানকার জলজ, বনজ উদ্ভিদ ও প্রাণী। জীববৈচিত্র্যের জন্য ক্ষতিকর ভারী ধাতু ক্যাডমিয়াম, ক্রোমিয়াম, সিসা ইত্যাদি ক্ষতিকর মাত্রার চেয়ে বেশি পরিমাণ সুন্দরবনের নদীর পানি চরে পাওয়া গেছে। সুন্দরবনের মাত্র ১৪ কিলোমিটার উত্তরে পশুর নদের কোলঘেঁষে নির্মিত বাংলাদেশ-ভারতের যৌথ রামপাল পাওয়ারপ্ল্যান্ট প্রকল্প। গবেষকদের মতে সুন্দরবন দূষণের অন্যতম উৎস এই রামপাল পাওয়ারপ্ল্যান্ট। আবার সুন্দরবনের বিভিন্ন নদী ও খালে দীর্ঘদিন ধরে বিষ দিয়ে মাছ শিকার করছে একটি চক্র। এতে বিভিন্ন মাছের পোনা, কাঁকড়া, সাপ, ডলফিন, শুশকসহ জলজপ্রাণি মারা যাচ্ছে। মাঝে মধ্যে পাচারের উদ্দেশ্যে বিষ দিয়ে হত্যা করা হচ্ছে বাঘ-কুমিরও। পর্যটকের সংখ্যা বৃদ্ধির কারণেও আলোক, শব্দ ও বর্জ্য দূষণ ঘটছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সুন্দরবন ও এর আশপাশের নদী-খালগুলোতে একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকের ব্যবহার ব্যাপকভাবে বেড়েছে। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে পরিবেশ অধিদপ্তরকে ২০২১ সালের মধ্যে এ ধরনের প্লাস্টিকের ব্যবহার বন্ধ করতে আদেশ দেন হাইকোর্ট। এরইমধ্যে পাঁচ বছর কেটে গেলেও এ বিষয়ে দৃশ্যমান তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি। খুলনা শহরে প্রতিদিন গড়ে ১২০০ থেকে ১৬০০ মেট্রিক টন বর্জ্য তৈরি হয়। এর মধ্যে ২৫-৩০ মেট্রিক টন প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি হচ্ছে। এই বর্জ্যরে ১০-১৫ শতাংশ সিঙ্গেল প্লাস্টিক, যার ৫৫-৬০ শতাংশ সংগ্রহ করা সম্ভব হয় না। এর সঙ্গে প্রায় ৫-৬ লাখ সিঙ্গেল প্লাস্টিক শপিং ব্যাগ ব্যবহারের পর অন্যান্য বর্জ্যের সঙ্গে মিশে ড্রেন ও জলাশয়ে যাচ্ছে এবং ধীরে ধীরে তা উপকূলের বিভিন্ন নদী-খাল দিয়ে সুন্দরবনে প্রবেশ করছে। সুন্দরবনের প্রতি লিটার পানিতে গড়ে দুটি মাইক্রোপ্লাস্টিক এবং প্রতি কেজি মাটিতে গড়ে ৭৩৪টি মাইক্রোপ্লাস্টিক রয়েছে। প্লাস্টিক দূষণের কারণে বনের স্থল ও জলজ প্রাণী এবং গাছপালার হুমকি বাড়ছে। দূষণের কারণে শুশুক-ডলফিন ও কচ্ছপ মারা যাচ্ছে। অন্যান্য জলজ প্রাণীও প্লাস্টিকের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশ খেয়ে মারা যাচ্ছে। গাছের শ্বাসমূলের ওপর পলিথিন ও প্লাস্টিকসামগ্রী পড়ে ক্ষতি হচ্ছে। এখানকার অর্থনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ প্রজাতি মৌমাছি। স্থানীয়ভাবে পরিচিত ‘মৌয়াল’দের পেশা মধু সংগ্রহ করা। আমাদের দেশের প্রাকৃতিক মধুর সবচেয়ে বড় উৎস হলো সুন্দরবন। সুন্দরবনের মধুর নানা প্রকারভেদ রয়েছে। খলিষামধু, গরানের মধু, গেওয়া মধু, কালিজিরা মধু প্রভৃতি। এগুলোর রঙ, গন্ধ ও স্বাদ ভিন্ন। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সুন্দরবন থেকে ২ হাজার ৫০০ কুইন্টাল বা ২ লাখ ৫০ হাজার কেজি মধু আহরণ করা হয়েছে এবং ৪৫০ কুইন্টাল বা ৪৫ হাজার কেজি মোম আহরণ করা হয়েছে। সুন্দরবনের মধুর দুই-তৃতীয়াংশ বাংলাদেশের অংশ থেকে সংগৃহীত হয়। অপরদিকে ভারত সুন্দরবন থেকে তুলনামূলক কম মধু সংগ্রহ করে থাকে। এ হিসাবে বাংলাদেশ সুন্দরবনের মধুর ভৌগোলিক পণ্যের দাবিদার। কিন্তু দেশের দায়িত্বশীলদের গাফিলতি, অবহেলা, অবজ্ঞা ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা কারণে সুন্দরবনের মধুর ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্যের (জিআই) মর্যাদা হারিয়েছে বাংলাদেশ। প্রকৃতির রক্ষাকবচ ও সৌন্দর্যমণ্ডিত ঐতিহ্যবাহী অনুপম নিসর্গ এই সুন্দরবনের পরিবেশ নিয়ে আমাদের সচেতন হতে হবে। সুন্দরবন আমাদের মর্যাদাপূর্ণ জাতীয় অস্তিত্ব ও অর্থনীতির অন্যতম ধারক ও বাহক। নিজেদের অস্তিত্বের স্বার্থে সরকার ও জনগণ উভয়ের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সুন্দরবনকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে।

প্রভাষক (তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ) নূরুল আমিন মজুমদার ডিগ্রি কলেজ, লাকসাম, কুমিল্লা।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত