ঢাকা বুধবার, ০৯ জুলাই ২০২৫, ২৫ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

অর্থনীতি যেভাবে ঘুরে দাঁড়াতে পারে

ড. লিপন মুস্তাফিজ
অর্থনীতি যেভাবে ঘুরে দাঁড়াতে পারে

অর্থনৈতিক কার্যকলাপকে বস্তুগত দিকে দিয়ে বিবেচনা না করে নৈতিক দিক থেকে বিবেচনা করার বিষয়টি অনেক বেশি পুরোনো না হলেও নতুন নয়। তবে ১৯৭১ সালে এই চিন্তার উদ্ভব হলেও এর ব্যাপ্তি ছড়িয়ে পড়েনি আমাদের সমাজে, বিশেষ করে বাংলাদেশে। ব্রিটিশ সামাজিক ইতিহাসবিদ এবং রাজনৈতিক কর্মী ইপি থ¤পসন তার ‘দ্য মোরাল ইকোনমি অফ দ্য ইংলিশ ক্রাউড ইন দ্য এইটটিন্থ সেঞ্চুরি’ শীর্ষক প্রবন্ধে নৈতিক অর্থনীতি সম্পর্কে ধারণাটি তুলে ধরেছিলেন।

তিনি অনুসন্ধান করেছিলেন যে, কীভাবে কৃষকদের অভিযোগগুলো একটি জনপ্রিয় ঐকমত্যের দ্বারা প্রতিফলিত করা যায় এবং এটাও খুঁজেছিলেন যে, এর মাধ্যমে অর্থনৈতিক কার্যকলাপগুলো সাধারণ মূল্যবোধের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হওয়া উচিত। যার ভেতর ছিল, সামাজিক নিয়মকানুন, পারস্পরিক বাধ্যবাধকতা এবং দায়িত্ব। শিল্পায়নের সময়, সুরক্ষামূলক আইনগুলো অদৃশ্য হয়ে যায় এবং আগের অবৈধ কার্যকলাপগুলো আইনি অথবা সাধারণ হয়ে ওঠে। সামন্ত কৃষকরা শিল্প শ্রমিক হয়ে ওঠে তখন, যখন বঞ্চনার সম্মুখীন হয় এবং অনাহারে থাকে। থম্পসন বলেছিলেন, ইংরেজ দাঙ্গা কেবল শারীরিক ক্ষুধার প্রতিক্রিয়া ছিল না, বরং নতুন অর্থনৈতিক ব্যবস্থার অনৈতিকতাও এর জন্য দায়ী ছিল। বলার অপেক্ষা রাখে না, আমাদের দেশে দুর্নীতি ও অনিয়মের সবচেয়ে বড় উৎস হচ্ছে, দেশের রাজনীতির ধরন। বাংলাদেশের রাজনীতি মূলত ক্ষমতা চর্চার রাজনীতি।

এর মূল স্তম্ভ হলো, বিভিন্ন আনুগত্য। অর্থাৎ স্বার্থগোষ্ঠীর মধ্যে অন্যায় সুযোগ-সুবিধা বিতরণ করে তাদের কাছ থেকে আনুগত্য আদায় করা। এর মাধ্যমে সম্পদের অসম বণ্টন বৃদ্ধি পায়, অর্থনৈতিক শৃঙ্খলা সহজেই ভেঙে পড়ে। ফলে বিনিয়োগের পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং সৎ উদ্যোক্তারা বঞ্চিত হন। কমবেশি দুর্নীতি সব দেশেই হয়। তবে বাংলাদেশকে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় ধরা হয়।

তার কারণ হচ্ছে, নাগরিকদের প্রায় সবধরনের সরকারি সেবা নিতে গেলে দুর্নীতির শিকার হতে হয়। বিগত বছরগুলোতে ব্যাংক খাতের দিকে তাকালেই বোঝা যায়, দেশের অর্থনীতি কোথায় অবস্থান করছে। বর্তমানে দেশের অর্থনীতির অবস্থা যে নাজুক, সেটা বুঝতে হলে অর্থনীতির ছাত্র না হলেও চলে। তথ্যের অবাধ প্রবাহের যুগের ছেলে-মেয়েরা অনেক বেশি তথ্যের কাছাকাছি বসবাস করে। তারা আমাদের অনেক আগেই জেনে যায়, কী হচ্ছে বা কী হতে যাচ্ছে। এখন পত্রপত্রিকায় দেখা যায় ব্যাংকের সংখ্যা কমিয়ে আনার কথা বলা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, আটকে যাওয়া ঋণ আদায়ের কথা। সেবা সহজীকরণ শব্দটি বিগত কয়েক বছর ধরে বেশ আলোচিত। কিন্তু সেবা কী আসলেই সহজ হয়েছে? ডিজিটাইলাজেশনের কারণে অনেক কাজ আমরা ঘরে বসেই করতে পারি। এসব তথ্য আমরা জানি। কিন্তু বাস্তবতা, ভিন্ন। একইভাবে নামজারি, ভূমি উন্নয়ন কর, জাতীয় পরিচয়পত্র সংশোধন ইত্যাদি কাজ ঘরে বসে করতে চাইলেও পারি না। এখানে এমন কিছু কৌশল আছে, যা অনেকে জানে না, বিধায় তাদের কোনো একটা দোকানে যেতে হয়। চাকরির আবেদন, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আবেদনের ফর্ম পূরণসহ অন্যান্য কাজ করতে হলে দোকানে যেতেই হবে। ঘরে একটা কম্পিউটার, ইন্টারনেট সংযোগ থাকলেই হচ্ছে না। এ বিষয়ে সম্যক ধারনা থাকলেও এখানে এমন কিছু করা আছে, যার ফলে চাইলেও ঘরে বসে কেউ এই সেবা নিতে পারে না। এমনকি, কেউ কাজটা করে ফেললেও আবেদনের কপি জমা দিতে গিয়ে বিপত্তিতে পড়ে। এসব সরকারি প্রতিষ্ঠানের আশপাশে গড়ে উঠেছে একটা চক্র বা সিন্ডিকেট। ফলে এসব কাজের জন্য সেবা প্রত্যাশীদের দোকানে যেতে হচ্ছে, সময় অপচয় হচ্ছে, গুণতে হচ্ছে বাড়তি টাকা। যদিও একটা গোষ্ঠী এই কাজের মাধ্যমে কিছু করে খাচ্ছে। এসব কাজের জন্য আর্থিক লেনদেন হচ্ছে। অস্বীকার করার উপায় নেই, ডিজিটালাইজেশনের কিছুটা হলেও আমরা এর সুফল পাচ্ছি। একটা কাজ শুরু করলে এর কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকে। ধীরে ধীরে এগুলো কমতে শুরু করে। আমরা প্রত্যাশা রাখতেই পারি যে, আগামীতে কাজগুলো আমরা ঘরে বসে করতে পারব। দেশে পণ্যের বাজার অনেক চড়া। সামনে রোজা। তার আগেই রমজানে ব্যবহারযোগ্য পণ্যের দাম আকাশচুম্বী হবে, এটা অভিজ্ঞতার আলোকে বলা যায়। ধরে নেয়া যায়, চিনি, তেল, ছোলা, ডাল ইত্যাদি পণ্যের দাম বাড়বে। প্রতিবছর আমরা সতর্কতার কথা শুনি, কিন্তু বাস্তবে তা প্রতীয়মান হয় না। সমাজের কিছু জনগোষ্ঠীর হাতে টাকা চলে গেছে। তাদের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে। তাদের এই সক্ষমতা আর সোস্যাল মিডিয়াতে ভালো আছি টাইপের পোস্ট দেখে সুখানুভূতির ঢেঁকুর তোলা যাবে না। অনেকেই ভালো ব্যবসা কিংবা চাকরি করেন বটে, কিন্তু খরচের লাগাম টেনে ধরতে পারছেন না। প্রতিটি জিনিসের মূল্য বেড়েছে দ্বিগুণ, সে তুলনায় বেতন কি বেড়েছে? অনেকেই দীর্ঘদিন ধরে একই পদে আছেন। পদোন্নতি পাচ্ছেন না, এমনকি তাদের বাৎসরিক ইনক্রিমেন্ট বৃদ্ধি পায় না। তারা কোথায় যাবে?

থম্পসন আঠারো শতকে ইংল্যান্ডের গ্রামীণ অঞ্চলে কীভাবে দাঙ্গার সূত্রপাত হয়েছিল, তা তদন্ত করেছিলেন। তিনি স্বীকার করেছিলেন, দাঙ্গার সূত্রপাত হয়েছিল ঊর্ধ্বমুখী দাম এবং ডিলারদের অসদাচরণের কারণে। তবে তিনি দাবি করেছিলেন, দাঙ্গা এই ধারণা দ্বারা সংগঠিত হয়েছিল যে, পুরোনো নিয়মগুলো অন্যায়ভাবে বাতিল করা হয়েছে এবং নতুন উপায়গুলো অবৈধ, বিশেষ করে বিপণন, মিলিং এবং বেকিং। তিনি দরিদ্রদের নৈতিক অর্থনীতিকে সংজ্ঞায়িত করেছিলেন সামাজিক নিয়ম ও বাধ্যবাধকতা একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি এবং সম্প্রদায়ের মধ্যে বেশ কয়েকটি দলের যথাযথ অর্থনৈতিক কার্যাবলীর উপর ভিত্তি করে। থম্পসনের মতে, দাঙ্গাগুলো সাধারণত শান্তিপূর্ণ ছিল, যেখানে দাবি করা হয়েছিল, প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম ঐতিহ্যবাহী সামন্ত অধিকার অনুসারে নির্ধারণ করা উচিত। জুলাই অভ্যুত্থানের পর দেশে এখন রাজনীতির পাশাপাশি চলছে অর্থনৈতিক সংস্কার। আর্থিক খাতকে কীভাবে দ্রুত চাঙ্গ করা যায়, তা নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে। নতুন নতুন বিনিয়োগ এর পরিবেশ সৃষ্টি করার পাশাপাশি পাচার হয়ে যাওয়া টাকা ফিরিয়ে এনে শ্রেণিকৃত ঋণ আদায়ের নতুন কৌশল বের করে আর্থিক খাতকে কীভাবে আরো মজবুত করা যায়, সেটা নিয়ে আরো গবেষণার প্রয়োজন। বর্তমান প্রেক্ষাপটে অর্থনীতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সামনে ৫টি চ্যালেঞ্জ রয়েছে, যা সাম্প্রতিক সময়ে আলোচিত হচ্ছে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত