বিশ্ব দ্রুত নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে- এই ধারণাকে জোরদার করছে ঘটে চলা পরিবেশগত ও স্বাস্থ্যগত বিপর্যয়গুলো। যেমন লস অ্যাঞ্জেলেসের সাম্প্রতিক দাবানল, আফ্রিকার সাহেল অঞ্চলের খরা এবং ইবোলাসহ অন্যান্য প্রাণঘাতী সংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাব। অন্যদিকে বিভিন্ন সরকারের ঐক্যনাশী ধ্বংসাত্মক আচরণও বিশ্বকে অস্থিতিশীল করে তুলতে মুখ্য ভূমিকা রাখছে। বিশেষত সরকারগুলো জাতিসংঘের সনদ, আন্তর্জাতিক সীমান্ত, মৌলিক মানবাধিকার এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতকে (আইসিসি) অবজ্ঞা করে চলেছে। বাড়তে থাকা এ প্রবণতার মধ্য দিয়ে অস্থিতিশীলতায় তাদের ভূমিকাটি প্রকট হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তথা ১৯৪৫ সালের পর প্রতিষ্ঠিত বিশ্বব্যবস্থার সবচেয়ে বড় অভিভাবক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সেই তিনিই যখন পশ্চিম ইউরোপীয় মিত্রের সার্বভৌম ভূখণ্ড দখলের জন্য বিনা প্ররোচনায় সামরিক হামলার হুমকি দেন, তখন আশ্চর্য কী যে সবাই আরো বেশি অনিরাপদ বোধ করবেন! তা সত্ত্বেও গ্রিনল্যান্ডের দখল ছেড়ে দেয়ার জন্য ডেনমার্ককে হুমকি দিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প ঠিক সেই কাজটাই করছেন। ট্রাম্পের কাছের প্রতিবেশী পানামা, মেক্সিকো ও কানাডাও একই ধরনের শাসানির মুখে আছে। স্বাধীন ও অলাভজনক সংগঠন আক্লেড বিভিন্ন সহিংস সংঘাতের গতিবিধি জানা এবং প্রতিহত করায় সহায়তার লক্ষ্যে তথ্য ও বিশ্লেষণ জড়ো করে থাকে। আক্লেডের হিসাবে গত পাঁচ বছরে বৈশ্বিক সংঘাত বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। আগের বছরের তুলনায় ২০২৪ সালে রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনা বেড়েছে ২৫ শতাংশ। বিশ্বের প্রতি আটজনের মধ্যে একজন সংঘাতের ভুক্তভোগী হয়েছেন। এসব মাপকাঠিতে বিচার করলে বিশ্ব দিন দিন আরো বিপজ্জনক হয়ে ওঠার ধারণাটি উড়িয়ে দেয়ার মতো বিষয় নয়।
উদাহরণ হিসেবে কিছু দেশের নাম উল্লেখ করাই যায়। গণতান্ত্রিক কঙ্গো প্রজাতন্ত্রের (ডিআরসি) পূর্ব সীমান্তে দীর্ঘদিন ধরে সংঘাত চলছিল। এম২৩ নামের একটি বিদ্রোহী গোষ্ঠী ওই অঞ্চলের গোমা শহর দখল করে নিলে সংঘাতটি বিশ্বের মনোযোগ কাড়ে। জাতিসংঘ অভিযোগ করেছে, রুয়ান্ডার প্রেসিডেন্ট পল কাগামে এম২৩-কে অস্ত্র দিচ্ছেন এবং পরিচালনা করছেন। তিনি সীমান্তের ওপারে সেনাও পাঠিয়েছেন। কিন্তু কাগামে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। এলাকাটি সাধারণভাবে দরিদ্র। কিন্তু এলাকাটি কোল্টানের মতো ধাতব আকরিকে সমৃদ্ধ, পশ্চিমা দেশে যেগুলোর বিপুল চাহিদা রয়েছে।
সেখানে যুদ্ধে হাজারো মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে, যৌন সহিংসতার শিকার হয়েছে। রয়েছে জনস্বাস্থ্যজনিত জরুরি অবস্থার ঝুঁকি। এই আকস্মিক সংকট নিয়ে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। বৈঠকে যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স রুয়ান্ডার আচরণের সমালোচনা করেছে। যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, তারা ডিআরসির সার্বভৌমত্বকে সমর্থন করে। কিগালির (রুয়ান্ডার রাজধানী) সঙ্গে সহায়তাবিষয়ক আলোচনা স্থগিত করেছে জার্মানি। কিন্তু এসব পদক্ষেপ সামান্যই প্রভাব ফেলতে পারে। গত বছর রুয়ান্ডার সঙ্গে খনিজ পদার্থ নিয়ে একটি কৌশলগত চুক্তি করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। কিছু খনিজ পদার্থ কঙ্গো থেকে পাচার হয়ে থাকে, এই কথা জানার পরও ইইউ এই চুক্তি করেছে। আরেকটি সমস্যা হলো, রুয়ান্ডার প্রেসিডেন্ট পল কাগামেকে আফ্রিকার আদর্শ নেতা বলে প্রশংসা করেছিল যুক্তরাজ্যের আগের সরকার। সে সময় তারা যুক্তরাজ্যে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের পাঠিয়ে দেয়ার মতো জায়গা খুঁজছিল। মোটা দাগে, ডিআরসির ভেতরে ও আশপাশে কয়েক দশক ধরে থেমে থেমে সংঘাত চলছে। মারা গেছে লাখ লাখ মানুষ। মিয়ানমারে শান্তিতে নোবেলজয়ী অং সান সু চির নির্বাচিত সরকারকে ২০২১ সালে উৎখাত করে ক্ষমতা নেয় সামরিক জান্তা।
গত বছরজুড়ে দেশটিতে জান্তার বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ বেড়ে চলেছে। এর জবাবে সেনাবাহিনী নৃশংস হয়ে ওঠে, যেটাকে পোড়া মাটি কৌশল বলে উল্লেখ করেছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)। এই কৌশলের মধ্যে রয়েছে জনসাধারণের ওপর নির্বিচার বিমান হামলা, হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন ও অগ্নিসংযোগ চালানো। এইচআরডব্লিউ বলছে, এগুলো হয়ে উঠেছে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধ। জাতিসংঘ বলছে, মিয়ানমার ‘ফ্রি-ফল’ অবস্থায় চলে গেছে, অর্থাৎ সেখানে পরিস্থিতি অবাধে দ্রুত খারাপ হয়ে চলেছে। ২০২৫ সালে দেশটির প্রায় দুই কোটি মানুষের সহায়তা দরকার হবে। তারপরও সেখানে প্রায়ই মানবিক সহায়তার পথ আটকে দেয়া হচ্ছে। অপহরণ ও আটক করে প্রাপ্তবয়স্ক তরুণ ও শিশুদের সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে বাধ্য করা হচ্ছে। অং সান সু চি এখনো গ্রেপ্তার রয়েছেন। তিনি প্রায় ২১ হাজার রাজনৈতিক বন্দীর একজন। রাখাইন রাজ্যে মুসলমান সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়ন অব্যাহত রয়েছে। হাইতিকে বলা হয় পশ্চিম গোলার্ধের দরিদ্রতম দেশ। বলা হয়ে থাকে দেশটিকে শাসনের আওতায় আনা অসাধ্য কাজ। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে অনেকগুলো আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ দেশটিতে দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতা আনতে ব্যর্থ হয়েছে।
১৯১৫ থেকে ১৯৩৪ সাল পর্যন্ত দেশটি দখল করে রেখেছিল যুক্তরাষ্ট্র। বিল ক্লিনটনের আমলে ১৯৯৪ সালে দেশটিতে আইনশৃঙ্খলা ফেরাতে ২০ হাজার সেনা পাঠানো হয়েছিল। এটা ছিল দেশটিতে যুক্তরাষ্ট্রের সর্বশেষ বড় হস্তক্ষেপ। যেটুকু অর্জন হয়েছিল, তা ছিল সাময়িক মাত্র। দেশটিতে জাতিসংঘেরও অনেক মিশন যাওয়া-আসা করেছে। হাইতির শেষ নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জোভেনেল মইসি ২০২১ সালে আততায়ীর গুলিতে প্রাণ হারান। দেশটিতে নতুন করে বিশৃঙ্খলা শুরু হয়। সেখানে সর্বত্র সশস্ত্র গোষ্ঠীর শাসন চলে। সহিংসতা, চাঁদাবাজি এবং অপহরণজীবী গোষ্ঠীগুলোর নিয়ন্ত্রণ সর্বব্যাপী।
হাইতি এখন একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। আন্তর্জাতিক সাহায্য ও উন্নয়ন প্রচেষ্টার প্রতীক বা পোস্টার চাইল্ড হিসেবে ইথিওপিয়ার যে পরিচিতি, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সেটার কড়া পুনর্মূল্যায়ন চলছে। ২০২২ সালের নভেম্বরে এক শান্তি চুক্তির মধ্য দিয়ে এই সামরিক অভিযান শেষ হয়। এই সংঘাতে জড়িত সব পক্ষ প্রবলভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছিল, তবে সবচেয়ে বেশি করেছিল ইথিওপিয়ার সরকার এবং তাদের মিত্র ইরিত্রিয়ার বাহিনী। এখন আলোচনার কেন্দ্রে আছে ইথিওপিয়ার আমহারা অঞ্চল। যেখানে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে চলমান সংঘাতের মধ্যে সরকারবিরোধীদের ওপর দমনপীড়ন বেড়েছে এবং তারা গণহারে গ্রেপ্তার হচ্ছে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলেছে, ইথিওপিয়ার প্রতি বিশ্ব মোটেই নজর দিচ্ছে না। সংস্থাটির বক্তব্য, আমহারা অঞ্চলে গণহারে এবং নির্বিচার হাজার হাজার মানুষকে আটকের বিষয়ে আন্তর্জাতিক নীরবতা লজ্জার সীমা ছাড়িয়ে গেছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাটি ইথিওপিয়ার উন্নয়নের অংশীদারদের বলেছে দেশটিতে আইনের শাসন ফেরানোর দাবিতে সোচ্চার হতে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, ২০২০ সালে টাইগ্রেতে যেমনটা হয়েছিল, ২০২৫ সালে আমহারা অঞ্চলেও তেমন সর্বাত্মক বিচ্ছিন্নতাবাদী বিদ্রোহ শুরু হয়ে যেতে পারে। গত ডিসেম্বরে বাশার আল-আসাদকে উৎখাত করে ক্ষমতা দখল করে ইসলামি বিপ্লবী গোষ্ঠী হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস)। গোষ্ঠীটির নেতা আহমেদ আল-শারা অন্তর্বর্তী সরকারের প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। তিনি অনেকগুলো বড় পরিবর্তন এনেছেন। আগের পার্লামেন্টের জায়গায় একটি আইন পরিষদ করা হয়েছে। সব সশস্ত্র গোষ্ঠীকে দল ভেঙে নতুন জাতীয় সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে বলা হয়েছে। যারা আশা করছেন সিরিয়া একটি স্বাভাবিক দেশ হয়ে উঠবে, তাদের জন্য এগুলো আশাপ্রদ ব্যাপার। তবে আগামী তিন-চার বছরের মধ্যে নির্বাচন হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন আহমেদ আল-শারা। এই সময়ের মধ্যে অনেক কিছু বিগড়ে যেতে পারে।
বাশারের উৎখাতকে স্বাগত জানালেও যুক্তরাষ্ট্র, ইইউ এবং উপসাগরীয় দেশগুলো সিরিয়াকে সহায়তা করার জন্য তড়িঘড়ি সুনির্দিষ্ট কিছু করছে না। যেমন দেশটির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার এবং তহবিল ছাড় করতে তারা দেরি করছে। জাতিসংঘ বলছে, দেশটির ৬৭ লাখ মানুষের জরুরি ভিত্তিতে সহায়তা দরকার। দেশটিতে স্বাস্থ্যসেবা, স্কুল ও বাসস্থান অপর্যাপ্ত। অধিকাংশ গ্রামাঞ্চলে স্থলমাইন পোঁতা রয়েছে। মানবিকতার বিপন্নতা বিচারে ইয়েমেনের পরিস্থিতিকেই সবচেয়ে জরুরি অবস্থা হিসেবে গণ্য করা হয়ে আসছে। সম্ভবত এখনো সেটাই সত্য, সুদানের বাড়তে থাকা বিভীষিকা সত্ত্বেও। কিন্তু ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামাসের হামলার পর বিশ্বের মনোযোগ ইয়েমেনের অভ্যন্তরীণ সংকট থেকে দেশটির হুতি বিদ্রোহীদের দিকে সরে যায়। হুতিরা লোহিত সাগরে পশ্চিমা দেশগুলোর জাহাজে এবং গাজার মানুষের সমর্থনে ইসরায়েলে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়। এর জবাবে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও তাদের মিত্ররা পাল্টা হামলা চালিয়েছে। গাজায় যুদ্ধবিরতির পর থেকে লোহিত সাগরে হুতিদের হামলা অনেকাংশে বন্ধ হয়েছে। কিন্তু বৃহত্তর গৃহযুদ্ধের কারণে বিশাল সমস্যা হয়েই চলেছে। এতে এখন পর্যন্ত প্রায় দেড় লাখ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে এবং ১ কোটি ৮০ লাখ মানুষ খাদ্যসংকটে রয়েছে। জাতিসংঘের বিশেষ দূত হ্যান্স গ্রুন্ডবার্গ গত জানুয়ারি মাসে জাতিসংঘের নিরাপত্তা কাউন্সিলকে বলেছেন, অঞ্চলটির স্থিতিশীলতা আংশিকভাবে নির্ভর করছে ইয়েমেনে সংঘাত শেষ হওয়ার ওপর। দেশটিতে সৌদি সহায়তাপুষ্ট প্রবাসী সরকারের সঙ্গে হুতিদের গৃহযুদ্ধ চলছে সেই ২০১৫ সাল থেকে। চলতি বছরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্র-মেক্সিকো সীমান্তে সামরিক উপস্থিতি কায়েম করেছেন। মেক্সিকো উপসাগরের নাম পরিবর্তন করে আমেরিকা উপসাগর রাখার শিশুতোষ দাবি জানিয়েছেন। ট্রাম্পের এসব তৎপরতা বোঝার ওপর শাকের আঁটি অথবা শাকের আঁটির ওপর বোঝার মতো মেক্সিকোর সমস্যাগুলো নিশ্চিতভাবে বাড়িয়ে তুলবে। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে, অভ্যন্তরীণ বিবদমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি ২০২৫ সালে সশস্ত্র বা জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোর জন্য স্থানীয় ক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে ফায়দা লোটার আরো সুযোগ তৈরি করে দিতে পারে।
লেখক: গবেষক ও কলাম লেখক