ঢাকা শনিবার, ২১ জুন ২০২৫, ৭ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

নারীর বঞ্চনা : বাল্যবিবাহ তালাক ও সামাজিক সুরক্ষা

মোহাম্মদ শাহী নেওয়াজ
নারীর বঞ্চনা : বাল্যবিবাহ তালাক ও সামাজিক সুরক্ষা

সমাজ-সভ্যতার রূপকার নারী। একজন নারী পরিবারের কেন্দ্রবিন্দু। এ নারীকে নিয়েই গঠিত হয় একটি পরিবার ও সমাজ।

সমাজে বসবাসকারী অর্ধেকই নারী, যারা সমাজের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। কিন্তু নারী সর্বত্র অবজ্ঞার শিকার। সভ্যতার সূচনাকারী নারীদের বিবিধ বৈষম্য ও বঞ্চনা প্রতিনিয়ত গ্রাস করছে। সমাজের নারীরা আজও সবচেয়ে পশ্চাৎপদ, অবহেলিত এবং নির্যাতিত। প্রাগৈতিহাসিক ও আধুনিক সমাজব্যবস্থায় বিশ্বের সর্বত্র পুরুষতান্ত্রিক সমাজের কর্তৃত্ব বিরাজমান।

দেশের সমাজব্যবস্থায় নারীর প্রতি বর্তমান দৃষ্টিভঙ্গিও ব্যতিক্রম নয়। নারীরা ধর্মীয় গোঁড়ামি, সামাজিক কুসংস্কার, সামাজিক অবহেলা ও নিপীড়নের শিকার। যার প্রয়োগ ঘটছে ‘বাল্যবিবাহ’ ও ‘তালাক’ এর মাধ্যমে।

দেশের অপ্রাপ্ত বয়স্ক মেয়েরা ব্যাপক হারে বাল্যবিবাহে পতিত এবং তালাকের সম্মুখীন। এরূপ কুপ্রথার প্রভাবে নারীরা বঞ্চনার শিকার হয়। একজন নারীর অস্তিত্ব অকালেই বিলীন হয়। একজন নারী সমাজিকভাবে ন্যায্য পাওনা ও অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়।

সম্প্রতি জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপি) কর্তৃক ‘বিশ্ব জনসংখ্যা পরিস্থিতি-২০২৩’ প্রকাশ করে। এ প্রতিবেদনে বাংলাদেশে ‘বাল্যবিবাহ’ পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগজনক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এ প্রতিবেদনে দেখা ১৮ বছরের নিচে বাল্যবিবাহের সংখ্যা ৫১.৪০ শতাংশ এবং ১৫ বছরের নিচে বাল্যবিবাহের সংখ্যা ১৫.৫০ শতাংশ। বাংলাদেশ বাল্যবিবাহের ক্ষেত্রে বিশ্বে পঞ্চম এবং এশিয়া মহাদেশে শীর্ষে অবস্থান করছে। বাল্যবিবাহ নিয়ে দেশের খ্যাতিমান বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাক একটি জরিপ পরিচালনা করে। ব্র্যাক পরিচালিত সোস্যাল এমপাওয়ারমেন্ট অ্যান্ড লিগ্যাল প্রটেকশন (সেলপ) কর্মসূচির আওতায় ‘বর্ন টু বি আ ব্রাইড’ শিরোনামে ২৭ জেলার ২৮ গ্রামের ৫০ হাজার পরিবারের উপর জরিপ পরিচালনা করা হয়। এ জরিপে দেখা যায়, বাংলাদেশের ৭০ শতাংশ কিশোরী বাল্যবিবাহের ঝুঁকিতে। দেশের মোট বিবাহের ৪৫ শতাংশ বাল্যবিবাহ এবং এদের মধ্যে ৭ শতাংশ মেয়ের বয়স ১৫ বছরের নিচে। সমাজের মানুষ কেন গণহারে বাল্যবিবাহের দিকে ঝুঁকছে? এ প্রসঙ্গে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ ও সামাজিক সচেতনতা জোরদার করা প্রয়োজন।

বর্তমান সমাজের এক অন্যতম অনাচার ‘তালাক’।

এ কুপ্রবণতা প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। ‘তালাক’ হচ্ছে সামাজিক অবক্ষয়ের নগ্নরূপ। যে প্রক্রিয়ায় বৈবাহিক সম্পর্কের অবসান ঘটে, বিচ্ছেদ বা সম্পর্ক ছিন্ন করা হয়। অর্থাৎ একজন বিবাহিত নারীকে পরিবার থেকে বিতাড়ন করা হয়। যা নারীর প্রতি সামাজিক অবজ্ঞা ও বঞ্চনার শামিল। বিবিএস কর্তৃক সম্প্রতি ‘বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিক-২০২৩’ এর ফলাফল প্রকাশ করা হয়। বিবিএস ৩ লাখ ৮ হাজার ৩২টি পরিবারের উপর একটি জরিপ পরিচালনা করে। এ জরিপে বৈবাহিক অবস্থা, বিয়ের বয়স, তালাক ও বিচ্ছেদ সম্পর্কিত তথ্য পাওয়া যায়। তালাক ও দাম্পত্য বিচ্ছেদ শহর থেকে গ্রামে বেশি। জরিপে প্রাপ্ত তথ্য মতে, বার্ষিক প্রতি ১০ হাজার পরিবারে মধ্যে গ্রামে ১১টি এবং শহরে ৯টি বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটছে। তালাক বা বিচ্ছেদের কারণ হিসেবে দেখা যায়, বাবা-মায়ের অসচেতনতা এবং পূর্বাপর চিন্তা না করে নিজ মেয়ের বিয়ে প্রদান। দারিদ্র্য পরিবার যৌতুকহীন বা স্বল্প যৌতুকের সুযোগ নিচ্ছে। নিজ কন্যাকে বহুবিবাহিত পুরুষ কিংবা অধিক বয়স্ক ব্যক্তির নিকট বিয়ে প্রদানে কুণ্ঠাবোধ করছে না। পরিচালিত জরিপে দেখা যায়- বিবাহ বিচ্ছেদের অন্যতম কারণ বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক, দাম্পত্যজীবন পালনে অক্ষমতা, ভরণপোষণে অসামর্থ্য অথবা অস্বীকৃতি, পারিবারিক চাপ, শারীরিক নির্যাতন, যৌন অক্ষমতা বা অনীহা ইত্যাদি।

‘বাল্যবিবাহ’ ও ‘তালাক’ দেশের চলমান সামাজিক সমস্যাসমূহের মধ্যে অন্যতম। প্রত্যেক সামাজিক সমস্যা থেকে সমাজব্যবস্থায় নতুন নতুন সামাজিক সংকট সৃষ্টি হয়। সামাজিক সমস্যা সমাজব্যবস্থার এক অনাকাঙ্ক্ষিত, অবাঞ্চিত ও ত্রুটিপূর্ণ অবস্থা। এ ধরনের অবস্থা সমাজের চলমান উন্নয়নের পথে প্রতিবন্ধক এবং নিত্যদিনের শান্তিপূর্ণ জীবনযাপন ব্যাহত করে। গ্রামে বসবাসরত স্বজনরা প্রতিনিয়ত নিজ কন্যাকে অল্প বয়সে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করছে।

বিশেষত কৃষি শ্রমিক হিসেবে বাড়িতে যারা কর্মরত ছিল, তাদের প্রত্যেকে নিজ কন্যাকে বাল্যবিবাহে আবদ্ধ করছে। সাধারণত, শিশু-কিশোর বয়সে একজন মেয়ে জীবনধারণ উপযোগী জ্ঞান, শিক্ষা, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা সঞ্চার করবে। কিন্তু বাল্যবিবাহের শিকার অপ্রাপ্ত বয়সি বধূগণ জীবন ধারণের বিবিধ বিষয় তথা শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, মাতৃস্বাস্থ্য, প্রজনন স্বাস্থ্য, শিশুর পুষ্টি ও জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে ধারণা গ্রহণের সুযোগ পাচ্ছে না। ফলে কিশোরী বধূগণ সামাজিক আচার, পারিবারিক দায়িত্ব ও আত্মনিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ। তারা সংসার জীবনে নিজের অজান্তেই নির্যাতন, নিপীড়ন ও বঞ্চনার মুখে পতিত হয়। বাল্যবিবাহের শিকার মেয়েরা বিবাহিত জীবনের প্রতিক্ষেত্রে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে ব্যর্থ। আতঙ্কের বিষয় বাল্যবিবাহিত বধূরাই সর্বাধিক তালাক বা বিচ্ছেদের মুখে পতিত।

দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করে সামাজিক অনাচারসমূহ। যা প্রতিনিয়ত নতুন নতুন সামাজিক সংকট সৃষ্টি করে। ‘বাল্যবিবাহ’ ও ‘তালাক’ সংক্রান্ত সামাজিক সমস্যার হরেক চিত্র গবেষণা প্রতিবেদন, সংবাদপত্র, টেলিভিশন চ্যানেল ও সামাজিক মাধ্যমে ফলাও হচ্ছে। গ্রামের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ থাকার সুবাধে এরূপ অনেক সমস্যা সরাসরি প্রত্যক্ষ করেছি এবং শুনছি। কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা-মাতা দারিদ্র্যতা অসহায়ত্ব মোকাবিলার জন্য কম বয়সে মেয়ের বিবাহ প্রদানে অতি তৎপর। তারা শিশুকন্যার বিবাহের বয়সের দালিলিক প্রমাণের জন্য কাজী, মোড়ল ও জনপ্রতিনিধির কূট পরামর্শ গ্রহণ করছে। অবৈধ বিবাহের ধর্মীয় বৈধতার জন্য ধর্মীয় নেতারা হতে ফতুয়া গ্রহণ করছে। বাল্যবিবাহের শিকার মেয়েরা স্কুল হতে ঝরে পড়ছে, উচ্চ শিক্ষা হতে বঞ্চিত, জীবনমান উন্নয়নে ভূমিকাহীন, অপরিণত গর্ভধারন, সহবাসে রক্তক্ষরণ ও অকাল মাতৃত্বে মৃত্যু ঝুঁকিতে পতিত হচ্ছে। এতে অল্প বয়সে মেয়েরা শারীরিক, মানসিক ও যৌন সমস্যায় ভুগছে।

‘বাল্যবিবাহ’ একটি বহুমাত্রিক সামাজিক সমস্যা। এ সমস্যা হতে সৃষ্ট ঘৃণ্যরূপ ‘তালাক’। অশিক্ষা, অসচেতনতা, দারিদ্র্য, সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা, সামাজিক কুসংস্কার বাল্যবিবাহ সংঘটিত হওয়ার পিছনে দায়ী। বাল্যবিবাহের পিছনে ভিন্নধর্মী অনেক কারণ রয়েছে। যেমন: প্রণয়ঘটিত ব্যাপার, ছেলেদের নৈতিক অবক্ষয়, সাংসারিক কর্মে লোক সংকট, পারিবারিক চাপ, যৌতুকের লোভ, ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার প্রত্যাশা, বর-কনে পক্ষের চাপ, প্রভাবশালীর চাপ, ভালো পাত্র, যৌতুকের চাহিদা কম, পরিবারে বিবাহযোগ্য বোন থাকা ইত্যাদি। যৌতুক, নারী নির্যাতন, দাম্পত্য কলহ, তালাক, ছাড়াছাড়ি ও বহুবিবাহ প্রবণতা প্রভৃতি বাল্যবিবাহের ফল। যা গোটা সমাজকে সংকটে পতিত করে।

বর্তমান সরকার বহুমুখী সংস্কার সাধনে উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। বিশেষত সামাজিক অবক্ষয় প্রতিরোধকল্পে আইনের শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত করতে হবে। সরকার বাল্যবিবাহের কমিয়ে আনতে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। জাতিসংঘের এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা ২০৩০ মোতাবেক শিশুবিবাহ, বাল্যবিবাহ ও জোরপূর্বক বিবাহসহ সকল ধরনের ক্ষতিকর প্রথার অবসান করতে হবে। বর্তমান সমাজে বাল্যবিবাহের প্রভাব প্রবল। স্বল্প বয়সে নিজ কন্যাকে বিবাহ প্রদানে একজন পিতা সাময়িক স্বস্তিবোধ করে। কিন্তু এরূপ অপরিণত বিবাহ বহুমাত্রিক সামাজিক সংকটের কারণ। দেশের হাজার হাজার বিবাহ বিচ্ছেদ বা তালাকের সূত্রপাত বাল্যবিবাহ কেন্দ্রিক। নারীর বঞ্চনা প্রতিরোধে বিদ্যমান আইনের যথার্থ প্রয়োগ ও সমাজিক সচেতনতা জোরদার করতে হবে। গ্রহণ করতে হবে নতুন নতুন রাষ্ট্রীয় কর্মসূচি। নারীর সুরক্ষা ও সামাজিক নিরাপত্তা সুনিশ্চিতকরণে সমাজের পক্ষসমূহ ব্রতী হোক। বঞ্চনার শিকার প্রত্যেক নারীর সামাজিক সুরক্ষা সুদৃঢ় হোক।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত