মানুষের মনের ভাব প্রকাশের প্রধানতম মাধ্যম ভাষা। সব মানুষই মনের ভাব প্রকাশ করে তার মাতৃভাষায়। বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। মাতৃভাষায় কথা বলা মানুষের জন্মগত অধিকার। আমাদের মায়ের কাছে শেখা প্রথম বুলি বাংলা। বাংলা ভাষা পৃথিবীর অন্যতম সমৃদ্ধ একটি ভাষা। এ ভাষার রয়েছে হাজার বছরের গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্য। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সামার ইনস্টিটিউট অব লিঙ্গুইস্টিকসের ভাষ্য মতে, পৃথিবীতে এখন ভাষার সংখ্যা ৭১৬৮টি। ভাষাভাষীর দিক থেকে বর্তমানে বাংলা ভাষা, পৃথিবীর ষষ্ঠ বহুল প্রচলিত ভাষা।
বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় ১৫ শতাংশ কথা বলেন এই ভাষায়। কিন্তু এই বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষার মর্যাদা পেতে অনেক আন্দোলন ও বুকের তাজা রক্ত দিতে হয়েছে। বাংলা ভাষাকে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে জীবন দিয়ে গেছেন সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারসহ আরো অনেকে। সমগ্রবিশ্বে শুধুমাত্র বাংলা ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যই রক্ত দিতে হয়েছে যা পৃথিবির অন্য কোন ভাষার জন্য নজিরবিহীন। যে বাংলা ভাষার জন্য আমাদের এত ত্যাগ-তিতিক্ষা সেই বাংলা ভাষাকে কি আমরা আপন করে নিতে পেরেছি? আমাদের প্রাথমিক থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গুলোতে ইংরেজি ভাষা শিক্ষার ওপর যেরূপ গুরুত্ব দেয়া হয়, তার সামান্যতমও যদি বাংলা ভাষা শিক্ষার ক্ষেত্রে দেয়া হতো তাহলে বাঙালির বাংলা লেখার অবস্থা হয়তো এতোটা খারাপ হতো না। যেখানে মাতৃভাষা ব্যবহারের প্রতি গভীর শ্রদ্ধাবোধ থাকার কথা, সেখানে হীনমন্যতায় ভোগে ইংরেজি ভাষা ব্যবহারের দাপটে বাংলা আজ অসহায় এবং বাঙালি জাতি হিসেবে আমরা প্রশ্নবিদ্ধ। রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে স্বীকৃতির ৭৩বছর পরও আমরা আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে শুদ্ধ বাংলার ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারিনি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলোতে প্রায়ই বাংলা লেখার ক্ষেত্রে অজ্ঞতাবশত এবং অনেক ক্ষেত্রেই অবজ্ঞাবশত ভুল বানানের ব্যবহার অহরহ চোখে পড়ে। সাবেক সরকারের একজন টেকনোক্র্যাট মন্ত্রীর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভুলভাল বাংলা বানানের পোস্ট সর্বজনবিদিত। বাংলা ভাষায় সাহিত্য চর্চা করে বিখ্যাত হয়েছেন এবং একই সাথে বাংলা ভাষাকেও ধন্য করেছেন এমন ব্যক্তিবর্গের তালিকাটা নেহায়েত ছোট হবে না। কালজয়ী কবি-সাহিত্যিক, লেখক, বুদ্ধিজীবীদের পাশাপাশি এ ভাষার রত্নভাণ্ডারকে প্রতিনিয়ত ঋদ্ধ করে চলেছে এ কালের অনেক গুনীজনরা। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠার ইতিহাসকে তোয়াক্কা না করা প্রজন্ম বাংলা ভাষার বিকৃতিকরণসহ বাংলা-ইংরেজির মিশ্রণে কথা বলার অশুভ প্রচেষ্টায় লিপ্ত। এছাড়া অনলাইন, ব্যানার, পোস্টার, ফেস্টুন, সাইনবোর্ডে ভুল বানানে বাংলা লেখার অশুভ প্রতিযোগিতার দ্বারা প্রতিনিয়ত নিগৃহীত হচ্ছে বাংলা ভাষা। এই নিগৃহীত হওয়ার কাজটি সবচেয়ে বেশি করে ঢাউস সাইজের ব্যানার টাঙানো তথাকথিত রাজনৈতিক দলের ব্যক্তিবর্গ। আধুনিকতার ছোঁয়ায় বাংলা ভাষার সঙ্গে সমস্বরে উচ্চারিত হচ্ছে অনেক বিদেশি ভাষার শব্দও।
বিদেশি ভাষার সংমিশ্রণের ফলে ভাষার ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হচ্ছে এবং অপপ্রয়োগ ঘটছে। যা বাংলা ভাষা সমৃদ্ধির প্রধান অন্তরায়। জাতীয় দৈনিক পত্রিকাগুলো প্রমিত বাংলার চর্চা করলেও দেশের সরকারি-বেসরকারি অফিস-আদালত থেকে শুরু করে টিভি চ্যানেল, নাটক, সিনেমা, সাহিত্য রচনা, এফএম রেডিওসহ সোশ্যাল মিডিয়ায় বিকৃত উচ্চারণ, মিশ্র ভাষার অত্যধিক ব্যবহার, ইংরেজি বর্ণে বাংলা লেখা এবং জোড়াতালি শব্দে কথা বলার বিকৃত ব্যবহারে বাংলা তার আসল সৌন্দর্য হারাচ্ছে। ভাষা সামাজিক অস্তিত্বের অন্যতম বাহক। পাকিস্তান আমলে উর্দু হরফে বাংলা লেখার চরম আপত্তি থেকেই বাঙালিরা রাষ্ট্রভাষা বাংলার জন্য আন্দোলন করেছিল। দুঃখজনক হলেও সত্য সেই বাংলা ভাষাকেই নতুন প্রজন্ম সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অহরহ ইংরেজি বর্ণে লিখছে।
বাংলাদেশের সংবিধানের ৩ নম্বর অনুচ্ছেদে বাংলাকে প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। সংবিধানের এ বিধান সমুন্নত রাখতে ১৯৮৭ খ্রিষ্টাব্দে বাংলা ভাষা প্রচলন আইন করা হয়। এ আইনের ৩(১) ধারায় বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশের সর্বত্র তথা সরকারি অফিস, আদালত, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান কর্তৃক বিদেশের সাথে যোগাযোগ ব্যতীত অন্যান্য সকল ক্ষেত্রে নথি ও চিঠিপত্র, আইন-আদালতের সওয়াল-জবাব এবং অন্যান্য আইনানুগ কার্যাবলী অবশ্যই বাংলায় লিখিতে হইবে।’ আর ৩(৩) ধারায় বলা হয়েছে, ‘যদি কোন কর্মকর্তা বা কর্মচারী এই আইন অমান্য করেন, তাহা হইলে উক্ত কার্যের জন্য তিনি সরকারি কর্মচারী শৃঙ্খলা ও আপিল বিধির অধীনে অসদাচরণ করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবে এবং তাহার বিরুদ্ধে সরকারি কর্মচারী শৃঙ্খলা ও আপিল বিধি অনুসারে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হইবে।’ আদালত ২০১৪ সালে সর্বস্তরে বাংলা প্রচলনের নির্দেশ দিলেও তা আজও বাস্তবে প্রতিফলিত হয়নি। গণতন্ত্রের চর্চা, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নিজস্ব ভাষায় আদালতের রায় লেখা হয়। কিন্তু বাংলাদেশে নিম্ন আদালতে বাংলা ভাষার ব্যবহার করা হলেও উচ্চ আদালতে বাংলা ব্যবহার এখনো উপেক্ষিত। বাংলা ভাষার সমৃদ্ধ ইতিহাস ও সংস্কৃতিকে রক্ষা করতে সম্প্রতি ভারত সরকার বাংলা ভাষাকে ‘ধ্রুপদী ভাষার’ স্বীকৃতি দিয়েছে। ভাষাশহীদদের আত্মদানের প্রতি সম্মান জানিয়ে হাজার মাইল দূরের সিয়েরা লিওন বাংলাকে তাদের দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিলেও আমরা কেবল আনুষ্ঠানিক কিছু শিষ্টাচার ছাড়া অনেক ক্ষেত্রেই ভাষাশহীদদের যথাযথ মর্যাদা দিতে পারিনি। যার প্রমাণ আমাদের দৈনন্দিন জীবন ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন স্তরে বাংলা ভাষা ব্যবহারের প্রতি উদাসীনতাণ্ডঅনীহা, ক্ষেত্রবিশেষে বিকৃত রূপ ব্যবহার। নিরন্তর চর্চার মাধ্যমে ভাষা টিকে থাকে। যথাযথ চর্চার অভাবে বাংলা ভাষা বিপন্ন হওয়ার দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলা একাডেমির বানান বিষয়ক কমিটি বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের দাবি অনুযায়ী নতুন কিছু নিয়ম সংযোজন করে ‘প্রমিত বাংলা বানান’-এর নিয়মাবলি তৈরি করেছে। তবু বাংলা বানান নিয়ে সংকটের অবসান হয়নি। একেকজন একেকরকম বানান লিখছেন। প্রমিত বানান সবাই মানছেন না। তাই বাংলা বানানকে এই বিশৃঙ্খল অবস্থা থেকে মুক্ত করতে হবে রাষ্ট্রকেই। বাংলাভাষা প্রচলন আইন থাকার পরও আমরা পিএটিসি, নেপ, এফবিসিসিআই, বিআরটিএ, বিআরটিসি, টেলিটক, বিটিএমসি, বিজিবি, বিটিসিএল, বিজেএমসি ইত্যাদি নামকরণ দেখতে পাই। অথচ প্রতিবেশী দেশ নেপালে সরকার ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে বিদেশি ভাষা পরিত্যাগ করে স্থানীয় নিজ ভাষায় মাত্র দুই মাসের মধ্যে তাদের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান সমূহের নামকরণ করেছে। ইংরেজি, স্প্যানিশ কিংবা ফ্রেঞ্চ ভাষার দাপটে এশিয়া, আফ্রিকা এবং লাতিন আমেরিকার অনেক দেশ ও জাতিসত্তা আকাশ সংস্কৃতির যাঁতাকলে পড়ে নিজস্ব ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। ঠিক তেমনি গভীর আবেগ থাকা সত্ত্বেও বাংলা ভাষার ব্যবহারিক চর্চার ক্ষেত্রটি ক্রমশ সঙ্কুচিত হয়ে আসছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ইংরেজি মাধ্যমের দুর্মূল্য দাপট। এই দাপট যেমন শিক্ষাদান ও শিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে তেমনি জীবিকার ক্ষেত্রেও। তাই বাংলার শুদ্ধচর্চা, নির্ভুল বলা ও লেখার ক্ষেত্রটি ক্রমশই ছোট হচ্ছে। সর্বস্তরে বাংলাকে প্রতিষ্ঠিত করতে সর্বাগ্রে হাত দিতে হবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলোতে। শিশু শ্রেণি থেকে উচ্চ শিক্ষা পর্যন্ত শুদ্ধ বানানে এবং মাতৃভাষায় পড়াশোনার জন্য পাঠ্যক্রম ও নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে। ভুল বানানের রাজত্বে আমাদের যে গভীর অসুখ হয়েছে সেখান থেকে বাংলা ভাষাকে সারিয়ে তুলে শুদ্ধ মাতৃভাষায় জ্ঞানচর্চার দ্বার উন্মোচন করতে হবে।
লেখক: প্রভাষক (তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ), নূরুল আমিন মজুমদার ডিগ্রি কলেজ, লাকসাম, কুমিল্লা।