প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫
ভাষা, শব্দ, প্রতীক এবং অভিব্যক্তির বহিঃপ্রকাশ যোগাযোগের একটি অন্যতম মাধ্যম থেকেও অনেক বেশি। ভাষা পরিচয়ের একটি ভিত্তিপ্রস্তর, সংস্কৃতির শিঁড়দাড়া এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণের একটি অন্যতম ধারক ও বাহক। একটি ভাষাকে যখন সঠিকভাবে ধারণ ও লালন-পালন করা হয় তখন সে ভাষা হয়ে ওঠে যে কোনো সমাজ ও সম্প্রদায়ের অতীত ও বর্তমানের সাথে সংযুক্ততার সেতু, একটি জাতিকে তার ঐতিহাসিক শেকড়ের সাথে সংপৃক্ত করার মাধ্যম। আর এই ভাষাই যখন হয়ে ওঠে জাতীর শিক্ষা পদ্ধতির একমাত্র মাধ্যম তখন যে কোনো সমাজ ও জাতীর উন্নয়ন ও প্রগতিতে নেমে আসে প্রাঞ্জল ঋজুতা। সমাজ, চরিত্র ও স্বাবলম্বী হওয়ার শিক্ষায় হয়ে ওঠে সক্ষম। ভাষার কথা মনে হলেই আমাদের চিন্তায়-চেতনায় ভর করে অমর একুশের কথা। ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখটি এলেই বাঙালির প্রাণ-বেদনায় কেঁদে ওঠে।
১৯৫২ সালের বাংলা ভাষা আন্দোলন পরবর্তীতে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ও শিক্ষাগত আন্দোলনে রূপ দিয়েছিল। ভাষাগত অধিকারের সংগ্রাম শুধু বাংলা ভাষাকে রক্ষা করেনি বরং একটি সাংস্কৃতিক নবজাগরণকেও উৎসাহিত করেছিল। একুশের বাংলা ভাষা আন্দোলন মূলত ভাষাগত অধিকারের সংগ্রাম থেকে জন্মগ্রহণ করে। এই দিনটি বাঙালির ইতিহাসে একটি মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে যুগ যুগ ধরে নিঃসন্দেহে। এই গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাটি জাতির নৈতিক কাঠামোতে প্রভাব ফেলেছে গভীরভাবে। আজ বাংলাদেশের সর্বত্র এই দিনটিকে ঘিরে চলে নানা ধরনের আয়োজন।
বাংলা একাডেমি আর স্বাধীনতার মাঠ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বসে একুশের বইমেলা, হাজারো বাঙালির পদচিহ্নে ভারি হয় প্রাঙ্গণ। কি এক রমরমা পরিবেশ, হাসি-কান্না-আনন্দের আর বেদনার। আমরা স্মরণ করি বাংলার সে তাজা তরুণদের শ্রদ্ধা ভরে যারা নিজের জীবনকে তুচ্ছ করে এনে দিয়েছিল আমাদের কথা বলার অধিকার। ওদের আত্মত্যাগেই আমরা পেয়েছি একটি দিবস ২১ ফেব্রুয়ারি খালি পায়ে প্রভাত ফেরিতে শামিল হওয়ার সুবর্ণ সুযোগ। শহীদ মিনারের বেদিতে ফুলের তোড়া দিয়ে অর্ঘ দেয়ার একটি কারণ। মায়ের ভাষায় কথা বলার উদ্যাম উচ্ছ্বাস। একুশ আমাদের জাতীয় গর্ব। আত্মপরিচয়ের তিলক। বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা।
ভাষা এবং আত্মপরিচয়, একে অপরের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। ভাষা এককভাবে কেবল শব্দগত অর্থ প্রকাশ করে না; একইসঙ্গে যিনি সেই ভাষাটি প্রকাশ করেন, সেই ভাষার মধ্যে তিনি তার পরিচয়টুকু তুলে ধরেন। তার মানে ভাষার সঙ্গে আইডেন্টিটির একটি সম্পর্ক আছে। হতে পারে সেটি আত্মপরিচয়ের অনুসন্ধান, হতে পারে সেটি কালচারাল আইডেন্টিটি, হতে পারে সেটি চিন্তার অনুসন্ধান।
ভাষা তো অনেক আছে। একজন মানুষ বর্তমান পৃথিবীতে এখন একসঙ্গে অনেক ভাষায় বলতে-বুঝতে-লিখতে এবং পড়তে পারে। এদের মধ্যে মাতৃভাষার সঙ্গেই আমাদের আত্মপরিচয় সবচেয়ে বেশি জড়িত। মায়ের ভাষা বা মাতৃভাষা বা প্রথম ভাষা বা স্থানীয় ভাষা, যেভাবে বলি না কেন, জন্মের পরে যে ভাষায় আমরা আমাদের প্রকাশ করতে শিখি এবং আমাদের চারপাশকে জানতে-বুঝতে শিখি যে ভাষার মধ্য দিয়ে, সেটি হলো তার মাতৃভাষা। এ মাতৃভাষায় শিশু প্রথম কথা বলতে শিখে, এ মাতৃভাষায় শিশু প্রথম তার মায়ের মুখ থেকে প্রথম ভাষাটি শুনে। দিনে দিনে আমরা যখন শিশু থেকে বড় হয়ে উঠি, আমাদের আত্মসম্মানবোধ এবং আমাদের চারপাশ, আমাদের সংস্কৃতি, আমাদের সম্প্রদায়, আমাদের জাতি, এমনকি আমাদের ধর্মের সঙ্গেও আমাদের সংযোগ গঠন করে এ মাতৃভাষা।
এ মাতৃভাষার মধ্য দিয়ে ভাষাগত অর্থ বুঝে আমাদের মধ্যে জ্ঞানের সমাবেশ ঘটাই, চিন্তার ক্ষমতা তৈরি করি। আর সেটার মাধ্যমে আমরা মুখে হোক, লিখিত আকারে হোক, নিজেদের প্রকাশ করি, চারপাশের বিশ্বকে বুঝতে পারি, নিজেদের চারপাশে অন্যদের সঙ্গে সংযোগ করতে শিখি এ মাতৃভাষা দিয়েই।
এতসব গুরুত্ব থাকার পরও প্রত্যেকটি সমাজ-সংস্কৃতি এবং জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে দেখা যায় যে- স্থানীয় কিংবা চারপাশে কিংবা আন্তর্জাতিকভাবে যে ভাষাগুলো প্রভাবশালীর ক্ষমতা রাখে, সেগুলো তখন সেই সমাজের ওপর চেপে বসে এবং স্থানীয় ভাষাকে হটিয়ে তার নিজের দখলদারিত্ব নেয়ার চেষ্টা করে। এতে মাতৃভাষার সংরক্ষণ, বিকাশ, গুরুত্ব এবং তার সংস্কৃতি বাধার সম্মুখীন হয়।
কোনো জাতিগোষ্ঠীর সংখ্যাগরিষ্ঠ ভাষা এক্ষেত্রে যতটা না হুমকির সম্মুখীন হয়, তার চেয়ে সংখ্যালঘু কিংবা আদিবাসী ভাষাগুলোর ক্ষেত্রে অন্য আরেকটি মাতৃভাষার চাপ বেশি থাকে। কী করে প্রভাবশালী ভাষা সেসব সংখ্যালঘু ভাষাকে বিলুপ্ত করে দেয়, আজকের বিশ্বের বিভিন্ন সংস্কৃতিতে এসবের অনেক উদাহরণ খুঁজে পাওয়া যায়।
এমন করে পৃথিবীর অনেক স্থানীয় ভাষা হারিয়ে যায় কিংবা হারিয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে থাকে। কারণ সেই অঞ্চলের বেশিরভাগ অধিবাসীরা তাদের শিক্ষা, কর্মসংস্থান এবং অন্যান্য সুযোগগুলো পাওয়ার সুবিধার্থে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভাষার দিকে ধাবিত হয়।
মাতৃভাষা বা প্রথম ভাষা বা স্থানীয় ভাষা একজন মানুষের আত্মপরিচয়, আত্মণ্ডঅনুসন্ধান, ব্যক্তিত্ব গঠন এবং চারপাশের প্রেক্ষাপটে নিজের পরিচয় গঠনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখে। এ ভাষায় সে নিজেকে শেখে, চারপাশকে শেখে, তার সংস্কৃতি এবং পারিবারিক পরিচয়ের সঙ্গে এ ভাষা দিয়েই ঘনিষ্ঠভাবে আবদ্ধ থাকে।
এক গবেষণায় দেখা গেছে যে- একজন ব্যক্তি যে ভাষায় কথা বলেন, তা তাদের চিন্তা-ভাবনা, যোগাযোগের ধরন এবং আচরণকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করতে পারে এবং করে। যেমন উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, যে ভাষার মধ্যে কমিউনিটির আন্তঃসংযোগ বেশি, সেই ভাষায় একজন ব্যক্তি কথা বললে, তার মধ্যে সেই ভাষার গোষ্ঠীর সঙ্গে একটি সম্প্রীতি এবং সহযোগিতার ভাব তৈরি হয়। তিনি তখন তার কমিউনিটির যে কোনো কাজকেই অগ্রাধিকার দেন। অন্যদিকে যেসব ভাষার মধ্যে ইন্ডিভিজুয়ালিজম বা ব্যক্তিত্ববাদের প্রভাব বেশি, সেই ভাষায় যখন তিনি চর্চা করেন, তখন সেই ভাষায় দেখা যায় যে- তিনি তার আত্মপ্রকাশ এবং স্বায়ত্তশাসনের বিভিন্ন দিককে অগ্রাধিকার দিয়ে প্রকাশ করেন বেশি।
একজন ব্যক্তি যে ভাষায় বা যে মাতৃভাষায় কথা বলেন, সেটা তার বা তাদের সামাজিক পটভূমি, সাংস্কৃতিক পরিচয়, এমনকি ব্যক্তিক সম্পর্কেও তথ্যকে ধারণ করে। সামগ্রিকভাবে ব্যক্তির ভেতরে যে বিশ্বের ছাপ থাকে, সেটি মাতৃভাষার মধ্য দিয়েই তার মধ্যে প্রবেশ করে এবং এ মাতৃভাষার মধ্য দিয়েই সে তার ভেতরের ছাপের দৃষ্টি থেকে বিশ্বকে উপলব্ধি করে।
তাই এক বাক্যে বলা যায়- মাতৃভাষার প্রভাব হারানো আসলে একটি ভাষাগত সমস্যা নয়, বরং এটি একটি সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক সমস্যা। যখন একটি ভাষা তার প্রভাব হারায় কিংবা মারা যায় কিংবা বিলুপ্ত হয়, তখন তার মধ্য দিয়ে চলে আসা গল্প-পৌরাণিক রীতিনীতি-সংস্কৃতি-ঐতিহ্য এবং সামাজিক অনেক সত্য মারা যায়। বিখ্যাত ভাষাবিদ নোয়াম চমস্কি তাই বলেছেন, ‘যে সমাজ তার মাতৃভাষা হারায়, সে তার স্মৃতিকে হারিয়ে ফেলে।’
তাই আমাদের উচিত মাতৃভাষার গুরুত্ব স্বীকার করে নেয়া, তার মূল্যায়ন করা, তার সংরক্ষণ এবং প্রচারে কাজ করা। এটি কেবল যে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভাষার ক্ষেত্রেই হতে হবে এটি ঠিক নয়। একইসঙ্গে একটি জনগোষ্ঠীর মধ্যে যেসব সংখ্যালঘু ভাষা রয়েছে, তাদের ভাষায় শিক্ষা এবং সম্পদের সংরক্ষণ, এর সঙ্গে সঙ্গে সেই ভাষায় তার ভাষিকদের ভাষা ব্যবহার এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে সেই ভাষার ঐতিহ্যকে প্রেরণ করার সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে। একটি জনগোষ্ঠীর মধ্যে যদি অনেক ভাষার প্রচলন থাকে এবং সেই ভাষাগুলো চালু থাকে, সেই ভাষাগুলোর স্বীকৃতি দেয়ার মধ্য দিয়ে তার সাংস্কৃতিকে স্বীকৃতি দেয়া এবং তা চালু রাখার মাধ্যমে মূল্যায়ন করে সমাজের পরস্পরের মধ্যে বোঝাপড়ার বোধকে উৎসাহিত করে একটি সম্প্রীতির পরিবেশ রক্ষা করা যায়।
মাতৃভাষা আমাদের সবার একটি পরিচয়। মাতৃভাষা আমাদের আইডেন্টিটি। মাতৃভাষা আমাদের আত্মগঠনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। মাতৃভাষা আমাদের অনুভূতির গঠন এবং প্রকাশের অন্যতম মাধ্যম। মাতৃভাষা আমাদের সংস্কৃতি এবং সম্প্রদায়ের সঙ্গে সংযোগের সেতু। কেবল ভাষাগত বৈচিত্র্যের স্বার্থে নয়, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণ এবং সামাজিক সংহতি বৃদ্ধির জন্যও মাতৃভাষার সংরক্ষণ-প্রচার-বিকাশ-শিক্ষা প্রত্যেকটা ক্ষেত্রেই দরকারি। নাইজেরিয়ান উপন্যাসিক চিমামান্দা আদিচি তাই বলেছিলেন, ‘একটি সংস্কৃতির ভাষা তার গল্প, তার ইতিহাস, তার মূল্যবোধ, তার প্রথা এবং তার ঐতিহ্যের বাহক। যখন একটি ভাষা মারা যায়, তখন সেটি তার সংস্কৃতিকেও সঙ্গে নিয়ে চলে যায়।’
লেখক : প্রাবন্ধিক