খুব মনে পড়ে তখন হাফ প্যান্ট পরি। গায়ে ঠিকভাবে ফ্রকও পরি না সবসময়। গ্রামের ছেলে-মেয়েরা খুব ছোট বেলায় সেরকম কিছু পরতও না। প্যান্ট পরে খেলছিলাম উঠানে। দৌড় দিয়ে টয়লেটে যাওয়ার সময় চিৎকার করে মাকে বলে যেতাম- আম্মো মুই পায়খানা করতে যাই। আমরা পাঁচ ভাইবোনই এই কাজ করতাম। দাদা তখন একটু বড়। এই যে বললাম -আম্মো মুই পায়খানা করতে যাই। এই হলো আমার মায়ের ভাষা বা মাতৃভাষা। যে ভাষা আমি মায়ের মুখ থেকে শুনে শিখেছি। এই মাতৃভাষা শুধু মানুষের নয় সমস্ত প্রাণিকুলের পরম আপন এবং আত্মার আত্মীয়। আমাদের শৈশবে দেখেছি- আম্মু মুরগি পুষতেন। একেকটা মুরগির পনেরো থেকে বিশটি বাচ্চা হতো। আম্মু যখন অই বাচ্চা সমেত মুরগিকে চাল ছিটিয়ে দিতেন। মুরগিটি দুই পা দিয়ে চালগুলো আরও ছড়িয়ে দিত। আর ক অ ক অ ক অ বলে একটা ডাক দিত। আর আম্মু মুখ বেঁকিয়ে বলতেন- এষ! এককালে আমনেই কামাই কইররা খাওয়াইলেন। আমি আর কী কল্লাম! মানে আম্মু বোঝাতে চাইতেন- মুরগিটি তার নিজের ভাষায়- বাচ্চাদের বলছে- আয় খাওন দিছি। খা বাছারা। এই ক অ ক অ ক অ আর কামাই মাতৃভাষার কী দারুণ, প্রকৃষ্ট উদাহরণ!
আমি মাসে একবার বিউটি পার্লারে যাই টুকটাক সেবা নিতে। অইখানে দুজন মারমা মেয়ে আছে। আমার কাজ করতে করতে ওরা নিজেদের ভাষায় কথা বলে। কথা বলতে বলতে হেসে লুটিয়ে পড়ে। আর আমি খুব অসহায় বোধ করি। কারণ ওই ভাষায় এবং অনুভূতিতে আমি বিন্দুমাত্র ও প্রবেশ করতে পারি না। অইটা তাদের নিজস্ব নদী। যে নদীতে তারা ডুবসাঁতার খেলে, জলকেলি করে। বর্তমান পৃথিবীতে ৭,০৯৯টি ভাষা প্রচলিত আছে। (তথ্য সূত্র: ইথনোলগ ২০তম সংস্করণ)। পৃথিবীতে বর্তমানে প্রায় পাঁচ হাজার আদিবাসী রয়েছে (তথ্যসূত্র-উইকিপিডিয়া)। এসব ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর রয়েছে নিজস্ব মাতৃভাষা এবং সংস্কৃতি। এই ভাষা এবং সংস্কৃতি পৃথিবীর বৈচিত্র্য এবং প্রাণপ্রাচুর্য। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে, বিশ্বায়নের প্রভাবে- প্রতিদিনই বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলোর ভাষা।
মাতৃভাষার আরেকটি রূপ আঞ্চলিক ভাষা। আঞ্চলিক ভাষার নিজস্ব শব্দ সম্ভার সাহিত্য এবং সংস্কৃতির এক বিপুল ঐশ্বর্যের ভাণ্ডার। প্রমিত ভাষা যেমন সার্বজনীন এবং বৈশ্বিক। তেমনি আঞ্চলিক ভাষা অঞ্চলভিত্তিক মানুষের নিজস্ব সংস্কৃতির স্মারক এবং সম্পদও বটে।
আসুন দেখে নিই প্রমিত ভাষা এবং বরিশালের আঞ্চলিক ভাষায় কয়েকটি শব্দ।
প্রমিত - আঞ্চলিক (বরিশাল)
কলসি- ঠিললা/গ্লাস- গেলেস/রান্নাঘর -ওস্যাঘর/রসে ভেজানো চিতই- ভিজাইন্না পিডা/সেমাই পিঠা- চুই পিডা/স্বামী- ভাতার/রিকশা- রিশকা/ মারবে- কেউন্নাইবে/মহিলা-মাগি এসব শব্দ আমাদের সাহিত্য এবং সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছে অনিবার্যভাবেই। মাতৃভাষা সেই ভাষা যে ভাষায় মানুষ ক্ষুধা লাগলে মায়ের কাছে খাবার চায়। শোকে-বিচ্ছেদে প্রাণ খুলে বিলাপ বা আহাজারি করে। নিজের অধরা মাধুরিকে স্বপ্নে অথবা কল্পনার রঙে সাজায়। আবার চরম বিরক্তি বা ক্ষোভে কাউকে গালি দিয়ে নিজের রাগ উপশম করে। মাতৃভাষা একটা শিশুর বিকাশের জন্য মায়ের মতোই এক অনিবার্য উপাদান। ভাষা হলো যোগাযোগের মাধ্যম। সেটা যেমন মানুষের জন্য প্রযোজ্য তেমনি অন্যান্য প্রাণির জন্যও এটি সত্য। মানুষের ভাষার সাথে অন্য প্রাণিদের যোগাযোগের ‘ভাষার’ একটা বড় পার্থক্য হলো ভাষার সাহায্যে মানুষ বিভিন্ন ধরনের বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে পারে, যা প্রাণিরা পারে না। যেমন- মৌমাছিদের নাচ কেবল মধু আহরণের সুবিধার জন্যই কাজে লাগে। আর উল্লুক জাতীয় বানরদের ভাষিক দক্ষতা অন্যান্য প্রাণীদের চেয়ে বেশি হলেও বিজ্ঞানীরা দেখেছেন যে সামগ্রিকভাবে তাদের ভাষা একটি দুই বছরের মনুষ্য শিশুর ভাষার চেয়ে উন্নত নয়। পৃথিবীর সব মানুষ মাতৃভাষায় তাদের শিক্ষা গ্রহণ থেকে শুরু করে কান্না অব্দি করতে পারুক স্বাচ্ছন্দ্যে।
সংরক্ষিত হোক সব আদিবাসী, আঞ্চলিক তথা মাতৃভাষা। পৃথিবীটা হয়ে উঠুক হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখের এক আনন্দাশ্রম।
লেখক: কবি ও কথাসাহিত্যিক