ঢাকা শনিবার, ২১ জুন ২০২৫, ৭ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

সমাজ্বকে যৌতুকমুক্ত করতে বেশি প্রয়োজ্বন পারিবারিক সচেতনতা

ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ
সমাজ্বকে যৌতুকমুক্ত করতে বেশি প্রয়োজ্বন পারিবারিক সচেতনতা

যৌতুক প্রথা ও নারী নির্যাতন বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সমস্যাগুলোর মধ্যে সর্বাধিক অমানবিক ও বেদনাদায়ক সমস্যা। যৌতুক হলো এক ধরনের দাবি সামাজিক মর্যাদা বা ‘স্ট্যাটাস’ বজায় রাখতে কেবল নিম্নবিত্ত বা মধ্যবিত্ত নয়, উচ্চ মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত পরিবারেও উপহারের নামে যৌতুক দেয়ার চল রয়েছে বাংলাদেশে? সমাজ্বকে যৌতুকমুক্ত করতে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজ্বন পারিবারিক সচেতনতা?শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্ত পরিবারে তথাকথিত যৌতুক প্রথা সাধারণত পরিলক্ষিত হয় না? কিন্তু অন্যভাবে কন্যার পরিবারকে চাপের মধ্যে রাখা হয়, যেটা যৌতুকের অন্তর্ভুক্ত? অনেকে মনে করেন নিজের মেয়ে সুখে থাকবে তাই ভালো করে বেশি বেশি জিনিস দিয়ে তাকে শ্বশুরবাড়ি পাঠানো হোক? কিন্তু তারা একটা জিনিস বুঝতে পারেন না যে, এই দেয়ার প্রবণতা অন্যপক্ষের চাওয়ার প্রবণতাকে আরো বাড়িয়ে দেয়? অর্থাৎ যৌতুক যে লোভ, সেই লোভকে আরো উসকে দেয়া হয়? কেননা আমাদের সমাজে ধরেই নেয়া হয় পুত্র সন্তান মানেই ধন-সম্পদ, পরিবারে অর্থ উপার্জ্বন বা অর্থ আনার লক্ষ্মী? সুতরাং তাকে দেখেই যেন মেয়ের বাপ-মা সবকিছু উজার করে দেবেন? অথবা কেউ দেবেন চাকরি, কেউ দেবেন সম্পত্তি?আজ্বকের বিষয় নিয়ে কলাম লিখেছেন বাংলাদেশের বিশিষ্ট গবেষক ও জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা ডা. এমএম মাজেদ তার কলামে লিখেন... যৌতুক বা পণ হলো কন্যার বিবাহে পিতামাতার সম্পত্তির হস্তান্তর প্রক্রিয়া। ‘যু’ ধাতু থেকে নিষ্পন্ন ‘যুত’ শব্দের অর্থ যুক্ত; বুৎপত্তিগত অর্থ হলো, পাত্র-পাত্রীর যুক্ত হওয়ার সময়ে অর্থাৎ বিয়ের সময় পাত্রীর জ্বন্য যা কিছু মূল্যবান সামগ্রী দেয়া হয়, তা যৌতুক। আর যৌতুক সাধারণত কনে মূল্য ও স্ত্রীধন সংশ্লিষ্ট ধারণার সঙ্গে সম্পূর্ণ বিপরীত। যদিও কনে মূল্য বা কনে সেবা বর বা তার পরিবার কর্তৃক কনের পিতামাতার নিকট পরিশোধিত হয়, কিন্তু কনের পরিবার কর্তৃক বর বা তার পরিবারকে প্রদত্ত হস্তান্তরিত সম্পদ হলো যৌতুক। অন্যভাবে, যৌতুক হলো নববধূর নির্দিষ্ট সম্পত্তি যা বিয়ের সময় বরের মালিকানা এবং নিয়ন্ত্রণে থাকে।

সাধারণ অর্থে যৌতুক বলতে বিয়ের সময় বরকে কনের অভিভাবক কর্তৃক প্রদেয় অর্থ বা মূল্যবান সামগ্রীকে বুঝায়। এছাড়া বর কনের আত্মীয়, অভ্যাগত অতিথিরা সাধারণত স্বেচ্ছায় নবদম্পতিকে দিয়ে থাকেন যা তারা তাদের নতুন সংসারে সুবিধামতো ব্যবহার করতে পারে। হিন্দু আইনে যৌতুককে নারীর সম্পত্তির উৎস বলা হয়। এতে তার নিরঙ্কুশ অধিকার স্বীকৃত। হিন্দু সমাজে নারীরা পুরুষদের মতো একইভাবে সম্পত্তির উত্তারিধকারী হতো না। তাই অনেক আগে থেকেই হিন্দু সমাজে নারীদের বিয়ের সময়ে যৌতুক দেবার প্রচলন ছিল। কালক্রমে তা বিয়ের পণ হিসাবে আভির্ভূত হয় যা একসময় কনে পক্ষের জ্বন্য এক কষ্টকর রীতি হয়ে দাঁড়ায়। ১৯৮০ সালের যৌতুক নিরোধক আইন অনুসারে ‘প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যদি কোনো পক্ষ অপর পক্ষকে বিয়ের আগে-পরে-চলাকালীন যে কোনো সময় যে কোনো সম্পদ বা মূল্যবান জামানত হস্তান্তর করে বা করতে সম্মত হয় সেটাই যৌতুক বলে বিবেচ্য হবে।’ তবে বিয়ের সাথে সরাসরি সম্পর্কিত নন এমন কেউ ৫০০ টাকা বা তার চেয়ে কম মূল্যমানের কোনো বস্তু উপহার হিসাবে কোনো পক্ষকে দিলে তা যৌতুক হিসাবে বিবেচিত হবে না। তবে বিয়ের শর্ত হিসাবে এই সমপরিমাণ কোনো কিছু আদান প্রদান করলে তা যৌতুক হিসাবে বিবেচিত হবে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ অনুসারে বিয়ে স্থির থাকার শর্ত হিসাবে বা বিয়ের পণ হিসাবে প্রদত্ত অর্থ বা প্রদান করা হবে এই মর্মে কোন শর্ত যে কোনো সম্পদকে যৌতুক হিসাবে বিবেচিত হবে। তবে মুসলিম সম্প্রদায়ের বিয়ের ক্ষেত্রে বিয়ের মোহরানা যৌতুক হিসাবে বিবেচিত হবে না। প্রচলিত আইনে যৌতুক দেয়া বা নেয়া উভয়ই শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসাবে বিবেচনা করা হয়েছে। অপরাধ প্রমাণিত হলে এক থেকে পাঁচ বছর পর্যন্ত জেল বা জ্বরিমানা অথবা উভয় দন্ড হতে পারে। যৌতুক দাবি করার জ্বন্যও একই সাজা হতে পারে। বাংলাদেশের সমাজে যৌতুকের জ্বন্য নারীর প্রতি অসম্মান ও অত্যাচারের অনেক ঘটনা ঘটে। এমনকি যৌতুকের দাবিতে স্বামী বা তার আত্মীয়-স্বজ্বনদের দ্বারা অত্যাচারের পর হত্যাকাণ্ডের ঘটনাও পরিলক্ষিত নয়। আর যারা নিচ্ছেন তারা একবারও কি ভেবে দেখেছেন যে, এই যৌতুক চাওয়াটা একেবারে ভিক্ষার পর্যায়ে পড়ে? একটা পরিবারে একজ্বন মেয়ে তো ঠিক ততটাই আদর যত্নে বড় হয়, যতটা একটা ছেলে? সেট যত্নের ধনকে আপনার হাতে যখন তুলে দেয়া হচ্ছে, আপনি তাকে আপনার পরিবারের সদস্য হিসেবে গ্রহণ করছেন, অর্থাৎ শর্তহীন ভালোবাসায় গ্রহণ করছেন তাকে? সেখানে ভিক্ষার দান থাকবে কেন?

কী আছে যৌতুকবিরোধী আইনে?

১৯৮০ সালে প্রথম যৌতুক নিরোধ আইন প্রণয়ন করা হয় যা সময়ের চাহিদার প্রতিফলনে ২০১৮ সালে নতুনভাবে যৌতুক নিরোধ আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। এই আইনে ২ ধারায় যৌতুকের সংজ্ঞা প্রদান করে ৩ ধারায় যৌতুকের শাস্তির বিধান করা হয়েছে। যদি বিয়ের কোনো পক্ষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বিবাহের অন্য কোনো পক্ষের নিকট কোনো যৌতুক দাবি করেন, তাহলে তা হবে আইনের অধীন একটি অপরাধ এবং সর্বোচ্চ শাস্তি পাঁচ বছর কারাদণ্ড, সর্বনিম্ন এক বছর কারাদণ্ড ও পঞ্চাশ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

এই আইনটির পাশাপাশি অপরাধটির গুরুত্ব বিবেচনায় নারী ও শিশুদের সুরক্ষায় প্রণিত ২০০৩ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (নির্যাতনমূলক শাস্তি) আইন ২০০০-এর ১১নং ধারায় যৌতুকের অপরাধের শাস্তির বিধান যুক্ত করা হয়। ২০০৩ সালে এই আইনটি সংশোধন করে যৌতুকের জ্বন্য হত্যার দায়ে মৃত্যুদণ্ড, হত্যার চেষ্টা চালানোর জ্বন্য যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও মারাত্মক জ্বখম করার দায়ে ১ থেকে ৩ বছরে কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। এই আইনটিতে যৌতুকের অপরাধের জ্বন্য সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান রাখা হলেও যথাযথ প্রয়োগ নেই। ফলে যৌতুক নামক এই অপসংস্কৃতি প্রতিনিয়ত বলীর শিকার হচ্ছে নারীরা। যা প্রতিরোধের জ্বন্য আইনের বাস্তবায়নসহ সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা দরকার

যৌতুক বন্ধে ১৯৮০ সালের ধারা নিয়ে হয় যৌতুক নিরোধ আইন? এটাতে কাজ্ব হলো না? এরপর ১৯৯৫ সালে হলো নারী ও শিশু নির্যাতন দমন বিশেষ বিধান আইন করা হলো? এ আইনে কঠিন শাস্তির বিধান রাখা হলো? শেষ পর্যন্ত এটাও ব্যর্থ হলো? সর্বশেষ ২০০০ সালে হলো নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন? এরপর এ বছর ‘যৌতুক নিরোধ আইন ২০১৭’-এর খসড়া নীতিগত অনুমোদন দেয়া হয়েছে মন্ত্রিসভায়? এর আওতায় কোনো নারীর স্বামী, শ্বশুর-শাশুড়ি, অভিভাবক, আত্মীয় বা স্বামীর পক্ষের অন্য যেকোনো ব্যক্তি যৌতুকের জ্বন্য কোনো নারীকে আত্মহত্যায় প্ররোচিত করলে মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন? যৌতুকের জ্বন্য মৃত্যু ঘটানোর চেষ্টা (প্ররোচিত করে) করলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, মারাত্মক জ্বখমের জ্বন্য যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড বা ন্যূনতম ১২ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা হবে?উক্ত আইনে যৌতুকের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, ‘যৌতুক বলিতে শরিয়ত মোতাবেক প্রদত্ত দেনমোহর বা মোহরানা বাদে, যেকোনো সম্পত্তি বা মূল্যবান জামানতকে বুঝাইবে, যাহা- ক. বিবাহের এক পক্ষ অন্য পক্ষকে, অথবা খ. বিবাহের কোনো এক পক্ষের পিতামাতা বা অন্য কেহ বিবাহের যে পক্ষকে বা অন্য কোনো ব্যক্তিকে বিবাহ মজ্বলিসে বা বিবাহের পূর্বে না পড়ে বিবাহের পণ রূপে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রদান করেন বা করিতে চুক্তিবদ্ধ হন।বাংলাদেশে দারিদ্র্যক্লিষ্ট জ্বনজীবনে যৌতুক প্রথা ও নারী নির্যাতন এক অসহনীয় অবস্থা সৃষ্টি করেছে। দেশে নারী নির্যাতনের মতো সমস্যা ব্যাপক ধারণ করার ক্ষেত্রে মুখ্য কারণ যৌতুক প্রথা। যৌতুক প্রথার সঙ্গে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে বিভিন্ন কারণ জ্বড়িত। এসব কারণের মধ্যে সামাজিক কুসংস্কার ও অন্ধ বিশ্বাস, সামাজিক প্রতিপত্তি ও প্রতিষ্ঠা লাভের মোহ, দারিদ্র্য, অজ্ঞতা, উচ্চাভিলাষী জীবনযাপনের বাসনা, পুরুষশাসিত সমাজে নারীদের নিম্ন আর্থসামাজিক মর্যাদা ও অসহায়ত্ব ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। দারিদ্র্য, বেকারত্ব, নারীদের নিম্নমর্যাদা ও অসহায়ত্ব, অজ্ঞতা, পুরুষদের কারও কারও বিকৃত মানসিকতা, অপসংস্কৃতির অনুপ্রবেশ, কতিপয় নারীর উশৃঙ্খল অশুভ প্রভাব ইত্যাদি নারী নির্যাতনের ক্ষেত্রে কাজ্ব করে।এ সমস্যা আমাদের সমাজে বহুদিন ধরে বিরাজ্ব করছে এবং বহু কারণের ফলে সৃষ্ট- কাজেই একদিনে বা একক উদ্যোগে এর সমাধান বা সচেতনতা সৃষ্টি করা সম্ভব নয়। এ সমস্যা সমাধানের জ্বন্য সর্বপ্রথম প্রয়োজ্বন আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন; অভিভাবক শ্রেণি, যুবক শ্রেণি এবং মহিলাসহ সকলে যাতে যৌতুক দেয়া বা নেয়া দুটোই অন্যায় এ মানসিকতার অধিকারী হয়

কী কী পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজ্বন?

যৌতুক একটি সামাজিক ব্যাধি শুধু নয়, মারণব্যাধির মতো আমাদের সমাজে আষ্টেপৃষ্ঠে জ্বড়িয়ে রয়েছে? যৌতুক যে দেয় এবং যৌতুক যে নেয় দুজ্বনেই সমান অপরাধী- এই আইনের মূল মন্ত্র জানলেও ক’জ্বন তা মানে? তাই শুধু আইন করে এ সমস্যা সমাধান সম্ভব নয়? এজ্বন্য প্রয়োজ্বন ঘর থেকে ঘরে আন্দোলন ছড়িয়ে দেয়া? এ ব্যাপারে সামাজিক ও রাজ্বনৈতিক সংগঠনগুলোর আরও নানা ধরনের পদক্ষেপ নেয়া উচিত? ধর্মীয় ও সামাজিক বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যৌতুক বিরোধী প্রচারণা চালানোর উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে? শিক্ষা মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে? পাঠ্যপুস্তকে যৌতুক বিরোধী বিষয় এবং যৌতুক সংক্রান্ত আইনগুলো অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে? মানবাধিকার সংগঠন ও এনজিওগুলো যৌতুক বিরোধী প্রচারণা চালাতে পারে? গণমাধ্যমে যৌতুকবিরোধী প্রচারাভিযানের ব্যবস্থা করা যেতে পারে?

নারীরা কেন যৌতুকের বলি হবে? কেন তাকে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে হবে? এ সমস্যার সমাধান রয়েছে প্রতিটি পরিবারের প্রতিটি ব্যক্তির সচেতন হয়ে ওঠার মধ্যেই? সবার মধ্যে যদি এই বোধ জ্বন্ম নেয় যে যৌতুক এক ধরনের ভিক্ষাবৃত্তি, এর মাধ্যমে কোনো সম্মান প্রাপ্তি হয় না, বরং নিজের সম্মানহানিই ঘটে- তাহলে হয়তো আমাদের সমাজ্ব থেকে একদিন এই ভয়াবহ অভিশাপ দূর হবে। ইদানীং হেভেন সিটি চট্টগ্রামে যৌতুক প্রথা সামাজিক ব্যাধিতে রূপ নিয়েছে। যৌতুক নিজ্বস্ব সংস্কৃতি ও ভয়াবহ ভাইরাসের মতো ছড়িয়ে পড়েছে। অন্যান্য জেলার তুলনায় চট্টগ্রাম জেলার যৌতুক নামক অপসংস্কৃতি ও নেতিবাচক দিকটা একটু বেশি। যৌতুক বলতে আমরা বুঝে থাকি, বর পক্ষ কনে পক্ষের কাছ থেকে বিয়ের আগে ও পরে মূল্যবান আসবাবপত্র, গাড়ি বাড়ি, জামানত দাবি করেন এবং কনে পক্ষও মূল্যবান আসবাবপত্র হস্তান্তর করে বা করতে সম্মত হয় সেটাই যৌতুক।

যৌতুক প্রথা শুরু হয় সনাতনকাল থেকে, নারীরা উত্তরাধিকার সূত্রে পুরুষদের কাছ থেকে সম্পত্তি লাভ করতে পারত না। সে সময় থেকে হিন্দু আইনে যৌতুক নারীর সম্পত্তির উৎস হিসেবে বিয়ে-শাদিতে যৌতুককে পণপ্রথা হিসেবে প্রচলণ করেন। বিশেষ করে বিয়ে-শাদিতে কনে পক্ষও বরপক্ষের কাছ থেকে অতিরিক্ত দেনমোহর দাবি করেন। যা ইসলামে শরিয়াহবিরোধী এই সুযোগে বরপক্ষও কনে পক্ষের কাছ থেকে বিয়ের যৌতুকসহ খাবারের মেনুও দাবি করেন। ওমুক ক্লাবে বিয়ের অনুষ্ঠান করতে হবে, চিংড়ি, রূপ চাঁদা, রুই কাতল মাছ, খাসি, গরু, মুরগি থাকতে হবে। অনেকটা ঢাকঢোল পিঠিয়ে হাতি পাদানো আর ঘোড়া লাদানোর মতো। দুই পক্ষের খাবার নিয়ে শুরু হয় ঝগড়াঝাটি; এরপর কত বিয়ে যে, খাবারের মেনু নিয়ে ভেঙে গেছে হিসেব নেই। এমনকি চট্টগ্রামে এক বিয়েবাড়িতে চিংড়ি মাছ দেয়নি বলে, বর স্টেজ্ব থেকে নেমে বিয়ে ভেঙ্গে দিয়ে, বরযাত্রীদের নিয়ে বাড়ি ফিরে যান। বরপক্ষ সবসময় যৌতুক নিয়ে বাড়াবাড়ি করেন। পথের ভিক্ষুকরা বোধহয় পয়সার জ্বন্য এমনটা করেন না। আর বিয়ের আগে দরকষাকষি ও যৌতুক নিয়ে বাড়াবাড়ির যেন শেষ নেই।

কনে পক্ষের দোষ ও আছে, আজ্বকাল মধ্যবিত্ত পরিবারের কনেপক্ষ, বরপক্ষের কাছ থেকে দেনমোহর দাবি করেন প্রয়োজ্বনতিরিক্তি ১০ থেকে ১৫ লক্ষ, উচ্চবিত্ত পরিবারে ২০ থেকে ৫০ লক্ষ টাকা। যা পরিশোধ করাও কষ্টসাধ্য। অনেকটা কনে পক্ষ যেন কোরবানি হাটে পশু ক্রয় করছেন। বরপক্ষও তখন কনেপক্ষকে ছাড় দেন না। অনুষ্ঠান হতে হবে আলিশান ক্লাবে, কয়েক হাজার বরযাত্রী খাওয়াতে হবে, অনেক বিত্তশালী পরিবার যৌতুককে নতুন নামকরণ করেছে ‘বরপক্ষকে কনে পক্ষ হতে গিফট’ বা উপহার প্রদান করা হয় যাতে মেয়ে শ্বশুর বাড়িতে দুধে ভাতে থাকেন। আজ্বকাল বিয়েতে দেখা যায়, ট্রাকভর্তি করে মেয়ের শ্বশুর বাড়িতে পাঠিয়ে দেন টয়লেটের বদনা, চপ্পল, সাবান, শ্যাম্পু, প্রসাধনী, টিস্যু, ন্যাপকিন থেকে শুরু করে ঘরের খাট-পালং, সোফা, কাঁথাবালিশ, হাঁড়িপাতিল, আসবাবপত্র এবং হেঁশেল ঘরের সব তৈজ্বসপত্রসহ আরও অনেককিছু।

উচ্চবিত্তদের অনেকে গাড়ি বাড়ি ফ্ল্যাট পর্যন্ত গিফট দিয়ে থাকেন। নিম্নশ্রেণির মেয়ের বিয়েতে দুই থেকে চার লক্ষ টাকা চাঁদা তুলে কন্যা পাত্রস্থ করেন অসহায় বাবা। আর আঁরার চাটগাঁইয়া অপসংস্কৃতি যুগ যুগ ধরে হয়ে আসছে; এজ্বন্য আমাদের কিছু লোভী ও মোড়ল শ্রেণির অভদ্র লোক দায়ী। আর একটা মেয়েকে তার বাবা কত কষ্ট করে লালন-পালন করে পড়ালেখা শেষ করে সারা জীবনের কষ্টার্জিত সঞ্চয় খরচ করে বিয়ে দেন। একটা মেয়ে যখন বিয়ের পর তার বাবা-মা, ভাইবোন ও নিজ্বভূমটা ছেড়ে শ্বশুরবাড়িতে যায়, সে তখন অনেকটা এতিমের মতো হয়ে যায়। সে ভাবে আমি যেখান থেকে পালকিতে চড়ে শ্বশুরবাড়িতে নেমেছি ঠিক সেখানে থেকে জীবনের শেষযাত্রায় খাটিয়াতে উঠব। শ্বশুরবাড়িতে এসে সে কত চড়াই-উতরাই পাড়ি দিয়ে ওই বাড়িকে আপন করে আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করে। একটা সময় শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে অসহায় হয়ে পড়েন। বিয়ের পর বরপক্ষের আত্মীয়-স্বজ্বন কনে পক্ষ থেকে কি দিয়েছে, নানারকম অযাচিত প্রশ্ন করে বিশেষ করে খাবার নিয়ে, এটা কেন দেয়নি, ওটা কেন পাঠায়নি, নতুন বউকে ছোট বিষয় নিয়ে খোঁটা দেন। বিয়ের প্রথমদিকে বেশিরভাগ নারীকে মানসিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়।

ঈদুল ফিতরে শ্বশুরবাড়িতে গিফট দিতে হবে, বাড়ির দাড়োয়ান, কাজের বুয়া থেকে শুরু করে আত্মীয়-স্বজ্বনের জ্বন্য নতুন জামাকাপড় দিতে হয়, কোরবানির ঈদে বড়ো গরু-ছাগল, ফলের মৌসুমে ফল, শীতের পিঠা, ধর্মীয় উৎসবে খানাপিনা। তাও আবার শ্বশুর-শাশুড়ির পছন্দমতো হতে হবে। একটু উনিশ বিশ হলে, শ্বশুর-শাশুড়ির বিষ বাক্য হজ্বম করতে হয়। নির্যাতন করে চৌদ্দগুষ্ঠি উদ্ধার করে ফেলে। আর কত অসহায় হয়ে পড়ে মায়ের জাতি নারী। কারও বা আদরের কন্যা, কারও বা বোন! সে কাউকে কিছু বুঝাতে পারে না। এমনকি তার জীবনসঙ্গীটাও বেঁকে বসে। তার পিঠ দেয়ালে ঠেকে যায়। আর একটু এদিক-ওদিক হলে শ্বশুরবাড়ি থেকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দেন। যৌতুকের টাকা দিতে না পারলে সে বাড়িতে প্রবেশ নিষেধ। শত অত্যাচার, মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন সহ্য করেও একটা মেয়ে শ্বশুরবাড়িতে থাকতে চায়। কতজ্বন শেষ পর্যন্ত টিকে থাকে। হায় রে যৌতুক! জানি না আর কত বোন, কত নারী যৌতুকের বলি হলে থামবে মৃত্যুর মিছিল। সম্প্রতি চট্টগ্রামের রাউজানে কোরবানি ঈদে ছাগল দিতে না পারায় জীবন দিতে হলো গৃহবধূকে। ফুলের মতো মিতুল নামের একটি মেয়েকে তার বাবা টাকা-পয়সা খরচ করে বিয়ে দেন, বিয়ের পর বরপক্ষ থেকে যা যা দাবি করেছে, সবকিছু দিয়েছেন, কোরবানির ঈদে গরু, ঈদুল ফিতরে পোশাক, ধর্মীয় উৎসবগুলোতে চট্টগ্রামের রীতিনীতি অনুযায়ী মিতুলের বাবার সাধ্যমতো সবকিছু দিয়েছেন। মিতুলের মেয়ের আকিকায় গরু, স্বর্ণের চেইন কত কিছুই না দেয়া হয়েছে। তারপরও যৌতুকের বলি হলো মিতুল। শাশুড়ি ও স্বামীর নির্যাতনের শিকার হয়ে আড়াই বছরের মাসুম শিশু আরিবাকে রেখে আত্মাহুতি দিলেন মিতুল। মিতুল ছিলেন একটি সংস্কৃতিমনা ও সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান। তাদের পরিবারের সামাজিক অবদানও রয়েছে।

যৌতুক প্রতিরোধে করতে কয়েকটি সুপারিশ-

১. যৌতুক লেনদেন একটি অভিশপ্ত প্রচলন এবং ঘৃণাজ্বনক প্রথা। এর বিরুদ্ধে গণসচেতনতা বাড়াতে জ্বনমত গড়ে তোলার লক্ষ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে ওয়াজ্ব, নসিহত, সভা, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, আলোচনা অনুষ্ঠান করে যৌতুক প্রতিরোধে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তোলা আবশ্যক। দুঃখজ্বনক হলেও সত্য যে, যৌতুকবিরোধী আইন থাকলেও তার বাস্তবায়ন নেই। তাই দেশের অসহায় নারীদের যৌতুকের নির্যাতন থেকে রক্ষা করা অপরিহার্য হয়ে পড়েছে।

২. যৌতুক দিয়ে বিয়ে সামাজিকভাবে বয়কট করতে হবে।

৩. দেশের সব মসজিদে জুমার খুৎবার আগে যৌতুক সম্পর্কে শরিয়তের বিধান ও হুকুম সম্পর্কে অবহিত করতে হবে।

৪. সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরিণত বয়সের ক্লাসগুলোতে ‘যৌতুক’ যে অত্যন্ত জ্বঘন্য ও অভিশপ্ত প্রথা সে বিষয়ে শিক্ষা প্রদান করতে হবে।

৫. গ্রামগঞ্জ্ব, পাড়া-মহল্লায় সর্বস্তরের সমাজ্বকর্মীদের নিয়ে ‘যৌতুক প্রতিরোধ কমিটি’ গঠন করতে হবে। শুধু তাই নয়, এর বাস্তবায়নের জ্বন্য মুরব্বিদের সচেতন ও শক্ত কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। যৌতুক দিয়ে বিয়ে-শাদিতে যারা জ্বড়িত তাদের সামাজিকভাবে বয়কট করতে হবে।

৬. যৌতুক আদায়ে যেসব পাষ- স্বামী স্ত্রীকে মারধর করে বা বাবার বাড়িতে টাকা বা অর্থ আনতে পাঠিয়ে দেয়, তাদের তাৎক্ষণিকভাবে পাকড়াও করে পুলিশে সোপর্দ করতে হবে।

৭. বিশেষ করে কাবিননামা ফরমে ‘যৌতুকের কোনো দাবি নেই’ মর্মে আদালতগ্রাহ্য হলফনামায় স্বাক্ষরদানের ধারা প্রবর্তনের দাবি সরকারের কাছে তুলে ধরতে হবে।

৮. দেশে অসংখ্য কন্যাদায়গ্রস্ত গরিব-দুঃখী, অসহায় বাবা-মার বিয়েযোগ্য কন্যাদায়গ্রস্ত পরিবার আছে, যারা অভাবের জ্বন্য বিয়ে সুসম্পন্ন করতে পারছে না। বিয়েযোগ্য এসব মেয়ের বিয়ের বিষয়ে দেশের ধনাঢ্য, বিত্তবান ও সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে।

৯. দেশের সব জাতীয় সংবাদপত্র, বেতার, টিভি এবং দেশি চ্যানেল মিডিয়াকে যৌতুক প্রতিরোধে যৌতুকবিরোধী টক শোর ব্যবস্থা করতে হবে। এসব টক শোতে আলেম, ওলামা, ইমাম, পীর-মাশায়েখদের দিয়ে যৌতুকের ভয়াবহ কুফল পরিণতির কথা জ্বনসমক্ষে তুলে ধরার ব্যবস্থা করতে হবে।

১০. যৌতুকবিহীন বিয়ে সম্পন্ন করতে দেশের সর্বত্র নিজ্ব নিজ্ব এলাকার গণ্যমান্য মুরব্বি, অভিভাবক মহল, ধনাঢ্য-বিত্তবান, আলেম, ওলামা, ইমাম ও কাজি সাহেবদের যৌতুক লেনদেন বন্ধ করার মনমানসিকতা তৈরি করতে হবে। মনে রাখবেন, বিয়ে-শাদি মানবজীবনের একটি পবিত্র কাজ্ব। অতএব আসুন, যৌতুক লেনদেন চিরতরে বিলুপ্ত করে নিজ্ব নিজ্ব ক্ষেত্রে মানবিক কর্তব্য পালনে সচেষ্ট হই। পরিশেষে বলতে চাই, বর্তমান প্রজ্বন্মদের কিশোর বয়স থেকে শপথ নেয়া উচিত- আমরা যৌতুক দিব না, যৌতুক নিবও না। আসুন যৌতুকের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ি তুলি। যৌতুককে না বলি। যারা যৌতুক দাবি করে তারা এই সমাজের ভয়ানক ভাইরাস, যৌতুক গ্রহিতারা সমাজের সবচেয়ে লোভী ভিক্ষুক, মিসকিন, আসুন ওদের সমাজে চিহ্নিত করে বয়কট করি।

লেখক: প্রতিষ্ঠাতা,জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি

সংগঠক, লেখক ও গবেষক

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত