ঢাকা শনিবার, ২১ জুন ২০২৫, ৭ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

প্রাঞ্জ্বল জীবনের জ্বন্য পরোক্ষ ধূমপান প্রতিরোধ করি

মো. তাহমিদ রহমান
প্রাঞ্জ্বল জীবনের জ্বন্য পরোক্ষ ধূমপান প্রতিরোধ করি

সুস্থ জ্বনগোষ্ঠী এবং সমৃদ্ধ দেশ গঠনের জ্বন্য প্রয়োজ্বন স্বাস্থ্যকর পরিবেশ। পরিবেশ ও স্বাস্থ্যের মধ্যে সম্পর্কটা অত্যন্ত নিবিড়। পৃথিবীর সৃষ্টিলগ্ন থেকে মানুষ পরিবেশকে নানাভাবে ব্যবহার করেছে। যার ফলে প্রাকৃতিক পরিবেশের সঙ্গে গড়ে উঠেছে মানব সৃষ্ট পরিবেশ। এই পরিবেশেই আছে আমাদের জীবন ধারনের নানা উপাদান। আবার এই পরিবেশেই থাকতে পারে হাজার রোগের উপকরণ। এরকম একটি ভয়ংকর উপাদান হলো ধূমপান থেকে নির্গত ধোঁয়া। সিগারেটের ধোঁয়ায় প্রাণসার সৃষ্টিকারী মিউটাজেন থাকে। যা মানুষের মুখ, শ্বাসনালি এবং ফুসফুসে ক্যান্সার সৃষ্টি করে। ধূমপানে সিগারেটের নিকোটিনসহ ৫৬টি বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ বিরাজ্বমান। ধূমপান বহু জীবনঘাতী রোগের প্রত্যক্ষ কারণ। যখন কেউ নিজে সরাসরি ধূমপান না করেও অন্যের ধূমপান থেকে নির্গত ধোঁয়া শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে গ্রহণ করে, সেটিকেই পরোক্ষ ধূমপান বলা হয়ে থাকে। পরোক্ষ ধূমপান আরও বেশি ক্ষতিকর। কিন্তু ধূমপায়ীরা পরোক্ষ ধূমপান যে মানব শরীরের জ্বন্য ঝুঁকিপূর্ণ সেটা মাথাতেই রাখতে চায় না। স্বাস্থ্য সুরক্ষা ফাউন্ডেশনের সমীক্ষা অনুযায়ী বর্তমানে দেশের ৩৫ শতাংশের বেশি মানুষ তামাক ব্যবহার করছে। তবে এ সংখ্যার চেয়েও আরও বেশি আশঙ্কাজ্বনক পরোক্ষ ধূমপানের হার। বর্তমানে বাংলাদেশে ধূমপান না করেও বিভিন্ন পাবলিক প্লেস ও পাবলিক পরিবহনে প্রতিনিয়ত পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হচ্ছেন প্রায় ৩ কোটি ৮৪ লাখ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ। পরোক্ষ ধূমপানের হার এভাবে বেড়ে যাওয়ার পেছনে অন্যতম প্রধান কারণ অসচেতনতা এবং আইনের বাস্তবায়নহীনতা। প্রাপ্তবয়স্ক বাংলাদেশি নাগরিকদের ওপর করা সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় দেখা যায় পরোক্ষ ধূমপানের মাধ্যমে বাড়ির অন্যান্যদের ক্ষতি হওয়ার বিভিন্ন কারণ সম্পর্কে তাদের জ্ঞানের অপ্রতুলতাই মূলত দায়ী। যারা ধূমপান করেন তারা শুধু নিজেদের ক্ষতি করেন তা নয়, পাশাপাশি আশপাশে যারা থাকে বিশেষত শিশুদের ক্ষতি করে থাকেন। কারণ পরোক্ষ ধূমপানের ক্ষেত্রে শিশুরা বড়দের চেয়ে অনেক বেশি ঝুঁকিতে থাকে। শিশুদের ওপর পরোক্ষ ধূমপানের প্রধান ক্ষতিকর দিকগুলো হলো, কানের সংক্রমণ, অতি ঘন ঘন ও তীব্র এ্যাজ্বমা অ্যাটাক এবং শ্বাসতন্ত্রের নিচের অংশে সংক্রমণ। এর বাইরেও যেসব শিশু পরোক্ষ ধূমপানের মুখোমুখি হয়, তারা পরবর্তীতে শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ, বিপাক প্রক্রিয়ার রোগ, বন্ধ্যাত্বসহ প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে নিয়মিত ধূমপায়ী হবার ঝুঁকিতে থাকে। ধোঁয়াযুক্ত ও ধোঁয়াবিহীন তামাকের কারণে সৃষ্ট বিভিন্ন অসংক্রামক রোগ ধীরে ধীরে মানুষকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে। ইউনিয়ন সমীক্ষা বলছে ১৩ থেকে ১৫ বছর বয়সেই বাংলাদেশি শিশুদের ৪২ শতাংশ বাড়িতে পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হয়। বাংলাদেশে মোট মৃত্যুর ৭১ শতাংশই অসংক্রামক রোগের কারণে ঘটছে। প্রতিরোধ যোগ্য এই মৃত্যুর অন্যতম কারণ তামাকজাত পণ্যের ব্যবহার। কেবল তামাকজ্বনিত পণ্য ব্যবহারের কারণেই বছরে ১ লাখ ৬১ হাজার ২৫৩ জ্বন মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে। পঙ্গুত্ববরণ করে বছরে প্রায় ৪ লাখ মানুষ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ক্যান্সারবিষয়ক গবেষণা সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যান্সার (আইএআরসির) তথ্য অনুসারে পরোক্ষ ধূমপানের কারণে বিশ্বজুড়ে ফুসফুস ক্যান্সার আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। আইএআরসি জানিয়েছে, অধূমপায়ীদের মধ্যে ফুসফুস ক্যান্সারকে এখন বিশ্বে ক্যান্সারে মৃত্যুর পঞ্চম প্রধান কারণ বলেই মনে করা হচ্ছে। গবেষকরা ফুসফুস ক্যান্সারের প্রধান চারটি উপধরনে মানুষের আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা জানতে পেরেছেন। ফুসফুস ক্যানসারের চারটি প্রধান উপধরন হলো অ্যাডেনোকার্সিনোমা, স্কুয়ামাওয়াস সেল কার্সিনোমা, স্মল সেল কার্সিনোমা ও লার্জ সেল কার্সিনোমা। আইএআরসি এর প্রতিবেদন অনুযায়ী অধূমপায়ীরা এ ক্যান্সারেই বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন। বিশ্বব্যাপী পুরুষ এবং নারী উভয়ের মধ্যেই এই ক্যান্সার প্রকট হয়ে উঠছে। গত কয়েক দশকের তুলনায় সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের দেশে উন্মুক্ত স্থানে ধূমপানের আধিক্য চোখে পড়ছে। এর কারণ হিসেবে বলা যায় পৃথিবীতে সর্বনিম্ন দামের সিগারেট লভ্যতার দেশগুলোর মাঝে বাংলাদেশ অন্যতম, যেখানে প্রায় প্রত্যেকেই সিগারেট এবং স্থানীয়ভাবে প্রস্তুতকৃত ফিল্টার বিহীন সিগারেট বা বিড়ি কিনতে সক্ষম। ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০০৫-এর ২(চ) ধারা অনুসারে জ্বনপরিসরে বা উন্মুক্ত স্থানে যেমন- শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান; সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি অফিস; গ্রন্থাগার, লিফট, হাসপাতাল ও ক্লিনিক, আদালত, বিমানবন্দর, সমুদ্রবন্দর, নৌবন্দর, রেলওয়ে স্টেশন, বাস টার্মিনাল, প্রেক্ষাগৃহ, প্রদর্শনী কেন্দ্র, থিয়েটার হল, বিপণিবিতান, রেস্টুরেন্ট, পাবলিক টয়লেট, শিশুপার্ক, মেলা বা পাবলিক পরিবহনে আরোহণের জ্বন্য যাত্রীদের অপেক্ষার জ্বন্য নির্দিষ্ট সারি, জ্বনসাধারণের সম্মিলিত ব্যবহারের স্থানে ধূমপান নিষিদ্ধ। এমন স্থানে ধূমপান করলে অনধিক ৩০০ টাকা জ্বরিমানা করার বিধান আছে। একই ব্যক্তি দ্বিতীয়বার একই অপরাধ করলে তিনি দ্বিগুণ হারে দণ্ডিত হবেন। অপ্রিয় হলেও সত্য ধূমপান নিয়ন্ত্রণে যে আইন আছে তা কখনোই প্রয়োগ হতে দেখা যায় না। সিগারেট ও বিড়ির উপর কর বৃদ্ধি করেও ধূমপান হ্রাস করা যায়নি। বরঞ্চ শহরের যেখানে-সেখানে লোকসমাগমের জায়গায় সিগারেটের দোকান, ভ্রাম্যমাণ দোকানে ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য সহজ্বলভ্য হওয়ায় দিনদিন ধূমপায়ীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে ফলশ্রুতিতে অধূমপায়ীরা অধিক হারে পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হচ্ছে। পরোক্ষ ধূমপান থেকে অধূমপায়ী ব্যক্তিদের রক্ষার জ্বন্য ব্যাপক জ্বনসচেতনতা বাড়ানো প্রয়োজ্বন। কাগজে-কলমে ‘সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ’-এর মাধ্যমে ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। পরোক্ষ ধূমপানের ক্ষতি থেকে অধূমপায়ী নাগরিকদের রক্ষা করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ঝটিকা অভিযান পরিচালনা করতে হবে। তাহলে সাধারণ জ্বনগণও সহজে উন্মুক্ত ও জ্বনসমাগম স্থানে ধূমপানের বিরুদ্ধে সহজেই প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারবে। জ্বনস্বাস্থ্য রক্ষায় তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন ও সময়োপযোগী করা দরকার। তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধনের উদ্যোগ গ্রহণ করলে তামাক কোম্পানি এবং তাদের পরিচালিত বিভিন্ন সংগঠন আইন সংশোধনের বিরোধিতা করবে এবং বলার চেষ্টা করবে আইন সংশোধন হলে সরকার বিপুল পরিমাণ রাজ্বস্ব হারাবে তারপরও সরকারকে রাজ্বস্ব আহরণের চেয়ে জ্বনস্বাস্থ্যকে বেশি অগ্রাধিকার দিতে হবে। রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে মাথায় রাখতে হবে তামাক কোম্পানিগুলো বছরে যে পরিমাণ রাজ্বস্ব দেয় তামাকজ্বনিত বিভিন্ন রোগের চিকিৎসায় তারচেয়ে প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকারও বেশি ব্যয় হয়। অধূমপায়ীদের সুরক্ষা প্রদান এবং নতুন প্রজ্বন্মকে তামাকের ক্ষতিকর দিক থেকে বাঁচাতে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বিদ্যমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধনের যে নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে আশা করি তা দ্রুতই বাস্তবায়ন করবে। বিষয়টির ভয়াবহতা বিবেচনায় আইন প্রণয়নের পাশাপাশি জ্বনগণকেও যত্রতত্র ধূমপানের বিরুদ্ধে সামাজিকভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।

লেখক: প্রভাষক

(তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ)

নূরুল আমিন মজুমদার ডিগ্রি কলেজ্ব,

লাকসাম, কুমিল্লা

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত