ঢাকা শনিবার, ২১ জুন ২০২৫, ৭ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

আইনশৃঙ্খলা পুনরুদ্ধারে মনোযোগী হতে হবে

অগ্রাধিকার তালিকায় রাখতে হবে অর্থনীতিকেও
আইনশৃঙ্খলা পুনরুদ্ধারে মনোযোগী হতে হবে

রাজ্বধানীসহ সারা দেশে ডাকাতি, ছিনতাই, রাহাজানি, সন্ত্রাস, অস্ত্রবাজি, দখলবাজি, চাঁদাবাজি, খুন, ধর্ষণ ইত্যাদি দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। মানুষের জান-মাল-ইজ্জতের মারাত্মক অনিরাপত্তা দেখা দিয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে দেশের, বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা ধর্ষণ, নারী নির্যাতন এবং ছিনতাই, ডাকাতি ও অন্যান্য অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বন্ধ ও সবার জ্বন্য নিরাপত্তা নিশ্চিতের দাবিতে সমাবেশ, বিক্ষোভ, মশাল মিছিল ইত্যাদি কর্মসূচি পালন করেছে। তাদের এ দাবি ও কর্মসূচির ন্যায্যতা প্রশ্নাতীত।

মানুষের কাছে জান-মাল ও ইজ্জতের নিরাপত্তা সব কিছুর ওপরে। আমরা লক্ষ্য করছি, এসব নিরাপত্তা দ্রুত উধাও হয়ে যাচ্ছে। গত শুক্রবার ঝিনাইদহের শৈলকুপায় তিনজ্বনকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। নিহতরা নিষিদ্ধঘোষিত পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কারা তাদের হত্যা করেছে, তার হদিস মেলেনি। এ রকম হত্যার শিকার হচ্ছে অনেকেই। হত্যাকারী খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। অন্যদিকে জ্বমিজ্বমার বিরোধ, দখলবাজি, চাঁদাবাজি ইত্যাদির সূত্র ধরে অনেকে হতাহত হচ্ছে। রাজ্বনৈতিক দলের আন্তঃবিরোধ পর্যন্ত হতাহতের কারণ হচ্ছে। রাজ্বধানীসহ সারা দেশে ছিনতাই, রাহাজানির যেন প্রতিযোগিতা চলছে। গত রোববার রাতে রাজ্বধানীর বনশ্রীতে এক স্বর্ণ ব্যবসায়ীকে কুপিয়ে ও গুলি করে ২০০ ভরি স্বর্ণ ও টাকা ছিনিয়ে নিয়ে গেছে দুর্বৃত্তরা। মোহাম্মদপুরে পৃথক ছিনতাইয়ে এক দম্পতি ও দুই যুবকের সর্বস্ব লুট হয়েছে। ওই এলাকায় ছিনতাই নয়, ডাকাত আতঙ্কও বিরাজ্ব করছে। খবরে প্রকাশ, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মতো গুরুত্বপূর্ণ ও মহাব্যস্ত মহাসড়কে রাত নামলেই ডাকাত-আতঙ্ক নেমে আসে।

প্রায়ই এ মহাসড়কে ডাকাতি হয়। দেশের অন্যান্য সড়ক-মহাসড়কেরও একই হাল। গত শনিবার নওগাঁয় রাস্তায় গাছ ফেলে ভয়াবহ ডাকাতি হয়েছে। ডাকাতদল একটি বাস ও একটি মাইক্রো ঠেকিয়ে যাত্রীদের সবকিছু লুটে নিয়ে গেছে। ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে সেই বাস, ডাকাতির কথা অনেকেরই মনে জাগরুক রয়েছে, যাতে ডাকাদল যাত্রীদের মালামাল ও টাকা-পয়সা লুট ছাড়াও একজ্বন নারীর শ্লীলতাহানি করে। এ ঘটনা পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হলে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। এরইমধ্যে ডাকাত ও ধর্ষকদের তিনজ্বনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। দখলবাজি-চাঁদাবাজির ঘটনাও দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের সময় সন্ত্রাস, দখলবাজি, চাঁদবাজি ইত্যাদিতে মানুষ অতিষ্ট হয়ে পড়লেও করার কিছু ছিল না। সরকার ও সরকারিদলের পৃষ্টপোষকতা ছিল এ সবের পেছনে। মানুষ ছিল অসহায় ও জিম্মি। ফ্যাসিবাদী শাসনের অবসানের পর এটাই প্রধান গণপ্রত্যাশা ছিল, দখলবাজি, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস ইত্যাদি অপরাধের অবসান হবে। কিন্তু তা হয়নি। বরং ক্ষেত্রবিশেষে বেড়েছে।

অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রধান উপদেষ্টা শুরুতেই জানিয়েছিলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান কাজ্ব হবে আইনশৃঙ্খলার উন্নয়ন ও নাগরিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ডিসি সম্মেলনেও তিনি তার পূর্বকথার পুনরুক্তি করেছেন। বলেছেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখন এক নম্বর বিবেচ্য বিষয়। এখানে যেন আমরা বিফল না হই। অত্যন্ত পরিতাপজ্বনক হলেও বলতে হচ্ছে, আমরা যেন বিফলই হতে যাচ্ছি। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লে. জে. মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বিভিন্ন সময় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নে তার দায়িত্বের কথা আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। তবে কার্যক্ষেত্রে তার কথার প্রতিফলন কমই দেখা গেছে। তার হাত শক্তিশালী করার জ্বন্য একজ্বন সহকারীও তিনি পেয়েছেন।

তা সত্ত্বেও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। তিনি এখনো পুলিশকে পুরোপুরি কার্যকর করতে পারেননি। পুলিশ ট্রমায় আক্রান্ত অথবা দায়িত্ব পালনে অনীহ। পুলিশের সক্রিয় ভূমিকা ছাড়া আইনশৃঙ্খলার কাঙ্ক্ষিত উন্নতি কখনোই আশা করা যায় না। পুলিশের দায়িত্ব কতকটা সেনাবাহিনীর ওপর চাপানো হয়েছে। তাতেও সেভাবে সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। এটা অস্বীকার করা যাবে না, পুলিশের মধ্যে এখনো পতিত স্বৈরাচারের নিয়োগ করা লোকজ্বন আছে, অন্যত্রও আছে। তারা অন্তর্বর্তী সরকার সফল হোক, সেটা চাইছে না। অন্যদিকে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগসহ যুবলীগ, আওয়ামী লীগ ইত্যাদির লোকজ্বন খোড়ল থেকে মুখ বের করতে শুরু করেছে। তারা দেশকে অস্থিতিশীল করার জ্বন্য নানা অপকর্ম করছে।

এটা পর্যবেক্ষকরা যেমন জানে, সরকারের তা না জানার কথা নয়। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা গত রোববার দিবাগত রাত ৩টার সময় তার বাসভবনে এক জ্বরুরি সংবাদ সম্মেলন ডাকেন। অতীতে এরকম সংবাদ সম্মেলনের নজির আছে কি না, তথ্যাভিজ্ঞ মহল বলতে পারবে। তিনি ওই সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন, আওয়ামী লীগের দোসররা দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে। এটা কোনো অবস্থায় সরকার করতে দেবে না। শুধু এই বার্তাটুকু দেয়ার জ্বন্যই কি রাত ৩টায় বেনজির সংবাদ সম্মেলনের আয়োজ্বন? এর আদৌ কি প্রয়োজ্বন ছিল? এখানে বিশেষভাবে বলা দরকার, শিক্ষার্থীরা স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবি করেছে। এ প্রসঙ্গে তার বক্তব্য জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, তারা আমার যে কারণে পদত্যাগ করতে বলে, ওই কারণগুলো যদি উন্নতি করে দিতে পারি, তাহলে তো পদত্যাগের প্রশ্ন ওঠে না। পর্যবেক্ষকদের জিজ্ঞাসা : যদি তিনি না পারেন?

আসলে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা একটা চ্যালেঞ্জ নিয়েছেন। এ চ্যালেঞ্জে বিফল হওয়া তার ও সরকারের জ্বন্য বিপর্যয়কর হতে বাধ্য। এক্ষেত্রে ব্যর্থ হওয়ার অবকাশও নেই। সফল হতে হলে প্রয়োজ্বনীয় উদ্যোগ ও অধিক ফলপ্রসূ কার্যব্যবস্থা নিতে হবে। অনেকেরই জানা, ৭ ফেব্রুয়ারি গাজীপুরে সাবেক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের বাসভবনে তার অনুসারীদের হামলায় ১৫-১৬ জ্বন শিক্ষার্থী আহত হয়।

এর পরিপ্রেক্ষিতে ৮ ফেব্রুয়ারি রাত থেকে অপারেশন ডেভিল হান্ট পরিচালনার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। সেই থেকে এ পর্যন্ত ৮-৯ হাজার ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কিন্তু এত অভিযান ও গ্রেপ্তারের পরও আইনশৃঙ্খলার উন্নতি হয়নি। বরং অবনতিই হয়েছে। কেন অভিযান সফল হচ্ছে না, সেটা ভেবে দেখতে হবে। যেহেতু আইনশৃঙ্খলা এক নম্বর অগ্রাধিকার, সুতরাং যে কোনো মূল্যে ও ব্যবস্থায় তা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। পর্যবেক্ষকদের মতে, সরকারের দ্বিতীয় অগ্রাধিকার, অর্থনীতি পুনরুদ্ধার ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি। এ ক্ষেত্রেও সরকার কোনো আশাবাদ জাগাতে পারেনি। প্রায় ভেঙে পড়া অর্থনীতি কোনো রকমে ঠেক দিয়ে খাঁড়া রাখা হয়েছে।

আগামীতে অবস্থা বেগতিক হয়ে উঠতে পারে। উৎপাদন, ব্যবসা-বাণিজ্য নানারকম ঝুঁকিতে পড়েছে। শিল্প-কারখানা বন্ধ হয়ে হাজার হাজার শ্রমিক-কর্মী বেকার হয়ে পড়েছে। ওদিকে দিন দিন বেকারের সংখ্যা ক্রমণ্ডবর্ধমান। এর মধ্যে উচ্চ শিক্ষিত বেকারের সংখ্যাও বিপুল- মোট বেকারের অন্তত সাড়ে ৩১ শতাংশ। কোনো নতুন কর্মসংস্থান নেই। বিনিয়োগ না হলে কর্মসংস্থান কীভাবে হবে? এত ব্যাপক বেকারত্ব দূর করার ব্যবস্থা না করে নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণ করা কী সম্ভব? আইনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা যথাযথভাবে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব? সরকারকে অর্থনীতি, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে জ্বরুরি জোরালো পদক্ষেপ নিতে হবে। সংস্কার, নির্বাচন ইত্যাদি তো আছেই। এসবের মাধ্যমে নতুন রাজ্বনৈতিক বন্দোবস্ত গড়ে তুলতে হবে। এর পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলার উন্নতি ও অর্থনীতির বিকাশও নিশ্চিত করতে হবে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত