রমজানের প্রতিটি মুহূর্তই মূল্যবান। আখেরাতের সদাই করার শ্রেষ্ঠ সময় রমজান। তাকে যথাযথভাবে কাজে লাগানোই মুমিনের কাজ। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য আমরা রোজা রাখি, তারাবি নামাজ আদায় করি, সাহরি ও ইফতার করে থাকি। এর পাশাপাশি তাহাজ্জুদ নামাজেরও বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। তাহাজ্জুদ, রাতের নামাজ বা কিয়ামুল লাইল নামেও পরিচিত। ইসলাম ধর্ম অনুসারীদের জন্য একটি ঐচ্ছিক ইবাদত। এটা বাধ্যতামূলক পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের অন্তর্ভুক্ত নয়। নবী মুহাম্মদ (সা.) নিয়মিত তাহাজ্জুদের সালাত আদায় করতেন এবং তার সাহাবিদের এটা পালনে উৎসাহিত করতেন। আর শরিয়তের পরিভাষায় রাত দ্বিপ্রহরে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের আশায় যে নামাজ আদায় করা হয় তা ‘সালাতুত তাহাজ্জুদ’ বা তাহাজ্জুদ নামাজ। রহমতের মাস পবিত্র রমজান মাস। আর রহমতের সময় হলো তাহাজ্জুদের সময়। বছরের বিশেষ রাতগুলোতে সূর্যাস্তের পরে আল্লাহতাআলা প্রথম আসমানে নেমে আসেন। এ ছাড়াও প্রতি রাতে তাহাজ্জুদের সময়ে আল্লাহতায়ালা প্রথম আসমানে এসে বান্দাদের ফরিয়াদ শোনেন। রমজান ছাড়া অন্যান্য মাসে অনেকেরই শেষ রাতে ওঠা হয় না। তাই তাহাজ্জুদ পড়া কঠিন হয়। কিন্তু রমজান মাসে সাহরি আদায়ের জন্য আমরা সবাই উঠি। আর সেহরির সময়ই হলো তাহাজ্জুদের সময়। রমজানে তাহাজ্জুদ আদায় করা খুব সহজ। তাহাজ্জুদ দুই দুই রাকাত করে ১২ রাকাত বা আরও কম বা বেশিও পড়া যায়। পবিত্র মাহে রমজানে নফলের সওয়াব ফরজের সমান, ফরজের সওয়াব সত্তর গুণ। তাছাড়া, বুখারি ও মুসলিম শরিফে তাহাজ্জুদ সম্পর্কে নবী করিম (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি নিয়তের সঙ্গে সওয়াবের আশায় মাহে রমজানের রোজা পালন করে, তার বিগত জীবনের গুনাহ মাফ করে দেয়া হয়। আর যে ব্যক্তি ইমান ও সওয়াবের আশায় মাহে রমজানের রাতে কিয়াম করে, তার বিগত দিনের গুনাহ মাফ করে দেয়া হয়। যে ব্যক্তি ইমান ও সওয়াবের আশায় লাইলাতুল কদরে কিয়াম বা রাত জেগে ইবাদত করে, তার বিগত জীবনের গুনাহ মাফ করে দেয়া হয়। মাহে রমজানে তাহাজ্জুদ নামাজ আদায়কালে কোরআনের আয়াত বেশি বেশি তিলাওয়াত করা ভালো। যদি দীর্ঘ সুরা মুখস্থ থাকে, তাহলে তাহাজ্জুদ নামাজে দীর্ঘ সুরা তিলাওয়াত করা উত্তম। তাহাজ্জুদ নামাজের ফজিলত সব নফল ইবাদতের চেয়ে অধিক। এটি আল্লাহর কাছে অতি প্রিয়। এ জন্য আল্লাহতায়ালা রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ওপর এ নামাজ ফরজ করে দিয়েছিলেন। রোজাদার ব্যক্তি যদি তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন, আল্লাহ তার পাপ মাফ করে দেন। নবী করীম (সা.) তাহাজ্জুদ সব সময় পড়তেন। তাই এটি সুন্নত, অতিরিক্ত হিসেবে নফল। মুসলিম শরীফের ৪০৫নং হাদিসে আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণিত নবী কারিম (সা.) বলেন, ফরজ নামাজের পর উত্তম নামাজ হলো রাতের তাহাজ্জুদ। রাসুলুল্লাহ (সা.) সময়ে তাহাজ্জুদের জন্য আজান দেয়া হতো। এখনো এই নিয়ম মক্কা শরিফ ও মদিনা শরিফে প্রচলিত আছে। তাহাজ্জুদ নামাজ কুপ্রবৃত্তি দমনে অত্যন্ত কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। এ নামাজ মন ও মননকে নির্মল করে। ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই রাতে ঘুম থেকে ওঠা মনকে দমিত করার জন্য অধিক কার্যকর। ওই সময়ে পাঠ করা (কোরআন তেলাওয়াত বা জিকির) একেবারে যথার্থ।’ (সুরা মুজ্জাম্মিল, আয়াত : ০৬) তাহাজ্জুদ নামাজ হলো পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের পর শ্রেষ্ঠ নামাজ। মহানবী (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘রমজানের পর সর্বশ্রেষ্ঠ রোজা হলো আল্লাহর মাস মহররমের রোজা। আর ফরজ নামাজের পর সর্বশ্রেষ্ঠ নামাজ হলো রাতের (তাহাজ্জুদের) নামাজ।’ (মুসলিম, হাদিস : ১১৬৩)। আবদুল্লাহ ইবনু আমর ইবনু আ’স (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বললেন- হে আবদুল্লাহ! তুমি অমুক ব্যক্তির মতো হয়ো না, সে রাত জেগে ইবাদাত করত, পরে রাত জেগে ইবাদাত করা ছেড়ে দিয়েছে। (বুখারি, হাদিস : ১১৫২) তাহাজ্জুদ একাকী পড়াই উত্তম। জামাতে পড়া অনেক মুজতাহিদ ফকিহ মকরুহ বলেছেন। তাই অন্য সব সুন্নত ও নফলের মতো তাহাজ্জুদ নামাজের সুরা কিরাত নিম্ন স্বরে পড়তে হয়। সেইসঙ্গে এর জন্য কোনো ইকামতেরও প্রয়োজন হয় না। পরিশেষে বলতে চাই, তাহাজ্জুদ’ শব্দের অর্থ কষ্ট-ক্লেশ, শ্রমণ্ডপরিশ্রম। সন্ধ্যারাতে ঘুমিয়ে মধ্যরাতের পর শয্যাত্যাগ করাকে তাহাজ্জুত বলা হয়। তাহাজ্জুদ নামাজের সময় রাতের দুই-তৃতীয়াংশ অতিবাহিত হওয়ার পর থেকে তথা রাত দুইটার পর থেকে ফজরের ওয়াক্ত আরম্ভ হওয়ার আগপর্যন্ত। সাহরির সময় শেষ হলে তথা ফজরের ওয়াক্ত শুরু হলে তাহাজ্জুদের ওয়াক্ত শেষ হয়। তাই তাহাজ্জুতের আগে ঘুমানো এবং ঘুম থেকে উঠে তাহাজ্জুদ পড়া উত্তম। প্রিয় নবীজি (সা.) প্রতি রাতেই তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করতেন। তাই এটি সুন্নত, অতিরিক্ত হিসেবে নফল। নবীজি (সা.)-এর জন্য এটি অতিরিক্ত দায়িত্ব ছিল। পাঁচ ওয়াক্ত নির্ধারিত নফলের মধ্যে তাহাজ্জুদ সর্বোৎকৃষ্ট আমল। মাহে রমজানের জুমার গুরুত্ব: তারই মাঝে রমজানের জুমার দিনগুলো আরো বিশেষ মহিমান্বিত। এমনিতেই বলা আছে, জুমার দিন গরিবের হজের দিন, পবিত্র ও পূণ্যের দিন। আজ রমজানের অন্য দিনের চেয়ে সব মসজিদে জুমার নামাজ আদায় করতে মুসল্লিরা ধর্মীয় ভাবগাম্বির্য ও আবেগ পরিপূর্ণ। পবিত্র রমজানের আজ ষষ্ঠ দিন জুমার নামাজ শেষে মহান রাব্বুল আলামীনের দরবারে দেশ ও জাতির কল্যাণসহ বিশ্ব মুসলিম উম্মার শান্তি কামনায় বিশেষ মোনাজাত করা হবে। রমজানের ফজিলত ও গুরুত্ব বোঝাতে মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনের সুরা বাকারার ৮৫ নম্বর আয়াতে ঘোষণা করেন ‘রমজান হলো এ মাস, যে মাসে আমি কোরআন অবতীর্ণ করেছি’। এ মাসকে বরকত-রহমত-মাগফেরাতের মাস বলা হয়। এ মাসে রয়েছে শবে কদরের মতো বরকতময় রাত, যা উম্মতে মোহাম্মদীর জন্য আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং যা অন্য কোনো নবীর উম্মতের ভাগ্যে জোটেনি। শবে কদরের ফজিলত সম্পর্কে স্বয়ং আল্লাহর ঘোষণা হলো ‘লাইলাতুল কাদরি খাইরুম মীন আলফী শাহরিন’ অর্থাৎ শবে কদরের এক রাত হাজার মাস থেকে শ্রেষ্ঠ। রমজানের গুরুত্বপূর্ণ ফজিলত হলো সব মাস রোজা রাখা ফরজ। প্রতিটি রোজায় মহান আল্লাহ পাক অসংখ্য মানুষকে ক্ষমা করেন এবং জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিয়ে জান্নাতের তালিকাভুক্ত করেন। তাই এ মাসকে বরকত-রহমত-মাগফেরাতের মাস বলা হয়। এ মাসে জান্নাতের দরজাসমূহ উন্মুক্ত করা হয়, জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করা হয় এবং শয়তানদের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করা হয়। আর এ কাজগুলো রমজানের প্রতি রাতেই সংঘটিত হয় এবং শেষ রমজান পর্যন্ত এর ধারাবাহিকতা বিদ্যমান থাকে। এ হাদিস থেকে প্রমাণিত হলো যে, জান্নাত-জাহান্নাম আল্লাহর সৃষ্ট দুইটি বস্তু, যার দরজাগুলো প্রকৃত অর্থেই খোলা কিংবা বন্ধ করা হয়। রমজানে জুমার ফজিলত: পবিত্র মাহে রমজান অফুরন্ত ফজিলতের মাস। রমজান মাসে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজসহ তারাবি, তাহাজ্জুদ, সুন্নত ও নফল নামাজ আদায়ের গুরুত্ব অনেক বেশি। আর রমজান মাসে জুমাবার মুসলমানদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। ইসলামের দৃষ্টিতে দিনটি অনেক বরকতময় ও তাৎপর্যপূর্ণ। আল্লাহ এ দিনকে অন্য দিনের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন। পবিত্র রমজানের জুমার দিন হওয়ায় এর ফজিলত আরো অনেকগুণ বেশি। পবিত্র কোরআন ও হাদিসে জুমার দিনের বহু ফজিলত বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা এ দিনের প্রতি গুরুত্ব দিয়ে কোরআনে ইরশাদ করেন, ‘মুমিনগণ! জুমার দিনে যখন নামাজের আজান দেয়া হয়, তখন তোমরা আল্লাহর ইবাদতের জন্য দ্রুত যাও এবং বেচাকেনা বন্ধ কর। এটা তোমাদের জন্য উত্তম, যদি তোমরা বোঝ।’ সূরা জুমুআ: ০৯ হাদিসে বলা হয়েছে, আব্দুল্লাহ্ ইবনে ইউসুফ (রা.) ও আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি জুমার দিন জানাবত (ফরজ) গোসলের মতো গোসল করে সালাতের জন্য আগমণ করে, সে যেন একটি উট কুরবানি করল। যে ব্যক্তি দ্বিতীয় পর্যায়ে আগমণ করে, সে যেন একটি গাভী কুরবানি করল। যে ব্যক্তি তৃতীয় পর্যায়ে আগমণ করে, সে যেন একটি শিং বিশিষ্ট দুম্বা কুরবানি করল। চতুর্থ পর্যায়ে যে আগমণ করে সে যেন একটি মুরগি কুরবানি করল। পঞ্চম পর্যায়ে যে আগমণ করল, সে যেন একটি ডিম কুরবানি করল। পরে ইমাম যখন খুতবা প্রদানের জন্য বের হয় তখন ফেরেশতাগণ জিকির শোনার জন্য হাজির হয়ে থাকেন। ইসলামি শরিয়তের বিধানে জুমার দিনের মাহাত্ম্য সীমাহীন। এ দিন মানব জাতির আদি পিতা হজরত আদমের (আ.) দেহের বিভিন্ন অংশ সংযোজিত বা জমা করা হয়েছিল বলেই দিনটির নাম জুমা রাখা হয়েছে। জুমার দিনকে আল্লাহ তায়ালা সীমাহীন বরকত দ্বারা সমৃদ্ধ করেছেন। এটি সপ্তাহের সেরা দিন। হাদিস শরিফের বর্ণনা অনুযায়ী, এ বরকতময় দিনটি আল্লাহ তায়ালা বিশেষভাবে উম্মতে মুহাম্মদিকে (সা.) দান করেছেন। নবী করিম (সা.) ইরশাদ করেন, সর্বাপেক্ষা উত্তম ও বরকতময় দিন হচ্ছে জুমার দিন। এ পবিত্র দিনে হজরত আদমকে (আ.) সৃষ্টি করা হয়েছিল এবং এ দিনে তাকে জান্নাতে প্রবেশ করানো হয়। (মুসলিম শরিফ) এছাড়াও হাদিস শরিফে জুমার দিনকে সাপ্তাহিক ঈদের দিন বলে ঘোষণা করা হয়েছে। বলা হয়েছে, জুমা তোমাদের পারস্পরিক দেখা সাক্ষাত ও সাপ্তাহিক ঈদের দিন। তাই এ দিনটি রোজার জন্য নির্ধারিত করা সমীচীন নয়। জুমার আগের রাত্রিটিও বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। হাদিস শরিফে বলা হয়েছে, জুমার পূর্ববর্তী রাতে বনি আদমের সব আমল মহান আল্লাহ তায়ালার দরবারে পেশ করা হয়। (বুখারি, আহমদ) তাই জুমার দিনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য বিবেচনা করে প্রতিটি মুসলিমের উচিত দিনটিকে কাজে লাগানো। দিনটিতে মহান আল্লাহর ইবাদত করা এবং প্রার্থনায় নিজের ও সমগ্র মানবতার জন্য কল্যাণ-সৌভাগ্য ও উন্নতির দোয়া করা উচিত। আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে মাহে রমজানে যথাযথভাবে রাতের শেষ প্রহরে তাহাজ্জুদ নামাজ ও জুমার নামাজ আদায় করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি