সম্প্রতি একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, দেশের শহরগুলোতে বিবাহ বিচ্ছেদের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। রাজধানী শহর ঢাকাতে মাসে গড়ে ৪০ থেকে ৫০টি ডিভোর্স কেস বিভিন্ন আদালতে জমা পড়ছে। পিছিয়ে নেই অন্যান্য শহরও। কেন এত বিবাহ বিচ্ছেদ?
সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, আজকের মেয়েরা-পুরুষের চেয়ে কোনও অংশে পিছিয়ে থাকতে চাইছে না। লেখাপড়া, কারিগরি শিক্ষা, প্রযুক্তিবিদ্যা সবক্ষেত্রে পুরুষের সমান সুযোগ পেয়ে তা কাজে লাগিয়ে নিজেরা স্বাবলম্বী হয়ে উঠছে। কর্মসুখ বহু মেয়ের বিয়ের প্রতি অনাগ্রহ সৃষ্টি করছে যেমন, তেমনই দেহেজ বা যৌতুক বা অন্যান্য সামগ্রী নিয়ে বাঁধছে বিরোধ। মেয়েরা যতই স্বাবলম্বী হোক না কেন, দেশের বহুস্থানে পাত্রের চাকরি অথবা ব্যবসার মানের উপর দহেজের পরিমাণ কতটা হবে, তা নির্ধরিত করা থাকে এবং এ পরিমাপ একজন বিসিএস অফিসার থেকে শুরু করে অফিসের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীর ক্ষেত্রে সমানভাবে প্রযোজ্য। শুধুমাত্র পদমর্যাদার পার্থক্য অনুযায়ী দহেজের পরিমাণ কম বা বেশি হয়। আগে মধ্যযুগীয় এ প্রথা মেয়েরা মুখ বুজে মেনে নিলেও এখন আর তারা মানতে চাইছে না। লোকলজ্জা, তথাকথিত সামাজিক সম্মান ইত্যাদি উপেক্ষা করে মেয়েরা নিচ্ছে আইনের আশ্রয়। নিজের অধিকার সুরক্ষিত করতে নিজেরাই আইনের মাধ্যমে ব্যবস্থা নিতে এগিয়ে আসছে।
সম্প্রতি বরিশালে একপাত্রের বর পণের মাত্রাতিরিক্ত দাবির কাছে মাথা না নুইয়ে বিয়ের মজলিস থেকে কনে উঠে গিয়ে খবরের শিরোনামে চলে এসেছেন। তাই বিয়ের সময় আশানুরূপ দানসামগ্রী অথবা যৌতুক না পেয়ে স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকদের অত্যাচার স্ত্রীরা অনেক সময় আগের মত মুখ বুজে মেনে নিচ্ছেন না। সন্তান না হলে তো কথাই নেই, সন্তান থাকলে তার হাত ধরে বেরিয়ে আসছে স্বামীর ঘর থেকে।
আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার কারণে পিতৃগৃহের পরিবর্তে একক নারীর সংসার ক্রমশ শহরগুলোতে বাড়ছে। শুধু এককভাবে থাকা নয়, আইনি লড়াইয়ে স্বামীটিকে নাস্তানাবুদ করতেও ছাড়ছে না এ প্রজন্মের স্বাবলম্বী নারী। শুধু কি মাত্রাতিরিক্ত দহেজ বা বর পণের দাবিতে বিবাহ বিচ্ছেদ বাড়ছে?
ঢাকা নিবাসী বিশিষ্ট সমাজসেবী ও শিক্ষিকা শারমীনের কথায়, আসলে অধিকাংশ পুরুষ যে যতই শিক্ষিত আধুনিক ও উদারমনা হোক, স্ত্রীর ব্যাপারে একটা সামন্ততান্ত্রিক রক্ষণশীল মনোভাব কাজ করে। রোজগারে বউদের টাকা-পয়সা খরচ করা অথবা কোথায় কীভাবে সেভিংসে রাখা হবে তার পূর্ণ অধিকার স্বামীরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভোগ করে আর রোজগারহীনতায় রোজগার যারা করে না তারা কষ্ট ভোগ করেন। ফলে, স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির অত্যাচার, অন্যায় আবদার মুখ বুজে মেনে নিতে বাধ্য হয়।
আজকের স্বাবলম্বী মেয়েরা শুধু নিজের পেশাতেই নয়, অর্জিত অর্থের উপরও অধিকার রাখতে চায়। ফলে বাধছে বিরোধ, যা অধিকাংশ ক্ষেক্ষত্রে বিবাহ বিচ্ছেদে গিয়ে শেষ হয়। আশে পাশে বান্ধবী অথবা পরিচিতজনের জাঁকজমকপূর্ণ রংচঙ্গে বিয়ের মোড়কের গন্ধ মিলিয়ে যেতে না যেতে ছাড়াছাড়ি হয়ে যাচ্ছে দু’জনে। এসব দেখতে দেখতে নিজেদের মধ্যে বিয়ের প্রতি একটা বিরূপ ধারণা গড়ে উঠছে। মানিয়ে নিয়ে চলতে পারবে কি না, এ ভয়ে তৈরি হচ্ছে বিয়ের প্রতি অনীহা। কারণ, মা নানী-দাদিদের মতো অকারণ দুঃখ, কষ্ট, অপমান দিন দিন সয়ে সংসার টিকিয়ে রাখতে তারা রাজি নয়। তাই তারা স্বাধীন একক জীবনে সন্তানের শখ মেটাচ্ছে অ্যাডাপ্ট করে।
স্থানে স্থানে যৌতুক নিয়ে অহরহ বধূ নির্যাতন, বধু হত্যা ঘটলেও দেশের কোন কোন অঞ্চলে এখনও দহেজ বা বরপণ বাবদ নির্ধারিত অর্থমূল্য গ্রহণের ঘটনা অনেক কম। তবে মফস্বল অঞ্চলে বিবাহ বিচ্ছেদ মামলা এখনও কমই বলা যেতে পারে। স্বাবলম্বী হলেও মেয়েরা তাদের সামাজিক, পারিবারিক ও কর্মস্থলের সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে চলার মানসিকতা তৈরি করে দেয়। তবে দরকার হলে আইনি সাহায্যে নিজের যোগ্য মর্যাদা ও প্রাপ্য আদায় করা যেতে পারে, এ বিষয়ে এখন কমবেশি ওয়েকিবহাল সব মেয়ে।
শুধুমাত্র স্বাবলম্বী মফস্ফলের মেয়েরা নয়, গ্রামাঞ্চলের মেয়েরাও এ ব্যাপারে পিছিয়ে নেই। মেয়েদের সহায়তা করতে হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। আগেকার দিনে যৌথ পরিবারের কর্তাব্যক্তিরা, মা, চাচি-ফুফু বা পাড়ার প্রবীণরা যে সামাজিক দায়িত্ব পালন করতেন আজকের একক পরিবারে তা অনুপস্থিত। তাই স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোর ভূমিকা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে।
অন্যদিকে ভয়ংকর বেকারের যুগে নিজেকে উপযুক্ত শিক্ষার মাধ্যমে কর্মজীবনে প্রতিষ্ঠিত করতে করতে একটি ছেলের বয়স ত্রিশের কোঠায় পৌঁছে যায়। বহু পরিশ্রমে প্রতিষ্ঠিত ছেলেটি চারদিকে সংসার ভাঙ্গার ঘটনা দেখে বিয়ের নামে আর অযথা ঝামেলা ঘাড়ে নিতে ভয় পাচ্ছে। একক জীবনকে সে শ্রেয় বলে মেনে নিচ্ছে। আগেকার দিনে যৌথ পরিবারে অনেক ভাইবোন, আত্মীয়স্বজনের মধ্যে মানুষ হতে হতে প্রাকৃতিক নিয়মে ছোট থেকে ছেলেমেয়েরা মেনে ও মানিয়ে চলতে এবং পরপরের সুখ-দুঃখের অংশীদার হতে শেখে, যা পরবর্তী জীবনে তাদের কাজে লাগে। ভালোবাসা, সহনশীলতা, দায়িত্ববোধ যা বৃহৎ পরিবারে থাকতে থাকতে এমনিতেই অর্জন করত, আজকের অণু পরিবারে তার কোনো বালাই নেই। সরে গিয়েছে সে বটবৃক্ষের ছায়া। তাই বিয়ের আগে প্রচুর মেলামেশা করে পরপরকে জানা বোঝার পালা শেষ করে বিয়ের পিঁড়িতে বসলেও দেখা যাচ্ছে সে বিয়ে বেশিদিন টিকছে না।
দুই প্রতিষ্ঠিত পাত্র-পাত্রী বিয়ের পিঁড়িতে যখন পরস্পরের হাতে হাত মেলায় তখন মনে হয় বড় ম্যাচ শুরু করার আগে দুই প্রতিপক্ষ হাত মেলাচ্ছে। যৌথজীবনের প্রথমদিন থেকে শুরু হয়ে যায় ইগো ক্ল্যাশ শুরু হয়ে যায় শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণে অলিখিত প্রতিযোগিতা। সংসার সুখের হয় শুধু রমণীর গুণেই নয়, পুরুষেরও গুণে।