পুলিশকে দলীয়করণের মধ্য দিয়ে পতিত স্বৈরাচার দেশকে পুলিশি রাষ্ট্রে পরিণত করেছিল। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গুলি চালিয়ে হাজার হাজার মানুষকে হতাহত করার পর থেকে পুলিশ বাহিনীর মনোবল এবং চেইন অব কমান্ড ভেঙে পড়েছিল। সে সুযোগে দেশে মব জাস্টিস বেড়ে যায়। সাত মাসেও পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যথাযথ সক্ষমতায় ফিরে আসেনি। অন্যদিকে পতিত স্বৈরাচার শেখ হাসিনা দিল্লিতে বসে প্রায়ই উস্কানিমূলক বক্তব্য ও দলীয় নেতাকর্মীদের রাজনৈতিক কর্মসূচির নির্দেশনা দিয়ে পরিস্থিতি উত্তপ্ত করে তুলছেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিস্ক্রিয়তা ও পতিত স্বৈরাচারের দোসরদের দেশকে অস্থিতিশীল করে তোলার গোপন এজেন্ডা প্রতিহত করতে মাঝে মধ্যেই ছাত্র-জনতাকে রাজপথে নেমে আসতে দেখা যাচ্ছে। এহেন বাস্তবতার সুযোগে এক শ্রেণির মানুষ চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই-রাহাজানিতে মেতে উঠেছে। আরেক শ্রেণির মানুষ মব জাস্টিস কিংবা আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে সংঘাতে লিপ্ত হয়ে পড়ছে। লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে, পরিকল্পিতভাবে মব জাস্টিস সৃষ্টি করে জননিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে অর্ন্তবর্তী সরকারের ব্যর্থতা প্রমাণের চেষ্টা করা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে দেশে-বিদেশে পালিয়ে থাকা পতিত স্বৈরাচারের দোসররা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একেকটি ঘটনাকে অতিরঞ্জিত করে প্রচার করছে। ঢাকায় বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় মানি এক্সচেঞ্জ করতে গেলে মব সৃষ্টি করে দুই ইরানি নাগরিককে মারধরের খবর গতকাল পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। এ থেকে বোঝা যায়, কথিত মব সৃষ্টিকারীরা পরিকল্পিতভাবে বিদেশি নাগরিকদের হেনস্তা করে অর্ন্তবর্তী সরকার তথা দেশের বদনাম রটানোর পথ বেঁছে নিয়েছে। গুলশান এলাকায় সাবেক জ্বালানি উপদেষ্টা এইচটি ইমামের ছেলে তানভির ইমামের কথিত বাসায় অবৈধ অর্থ, অস্ত্র এবং দুর্বৃত্তরা আশ্রয় নিয়েছে মর্মে গুজব তুলে স্থানীয় লোকজন মব সৃষ্টি করে বাসার দরজা ভেঙে তল্লাশি চালিয়েছে বলে খবর প্রকাশিত হয়েছে। জানা গেছে, বাসাটি আদৌ তানভিরের নয়।
রাজধানীর গুলশান-বসুন্ধরার মতো অভিজাত এলাকায় সাধারণ মানুষের এভাবে মব জাস্টিসের শিকার হওয়ার ঘটনা খুবই দুঃখজনক। ঢাকা থেকে সারা দেশে প্রায় প্রতিদিনই এমন ঘটনায় মানুষ হতাহত ও হেনস্তা হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিস্ক্রিয়তার সুযোগে ছাত্র-জনতার ছদ্মবেশে সুযোগ সন্ধানি দুষ্কৃতিকারি চক্র, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের উপর প্রভাব বিস্তার, প্রতিশোধ গ্রহণ এবং পতিত স্বৈরাচারের ছত্রছায়ায় বেড়ে ওঠা সন্ত্রাসিরা নিজ নিজ স্বার্থ সিদ্ধির উদ্দেশ্যে মব জাস্টিসের আশ্রয় নিচ্ছে। গত কয়েকদিনে শরিয়তপুরে ডাকাতি করে পালানোর সময় স্থানীয় জনতার প্রতিরোধের মুখে ডাকাতের গুলিতে ৯ জন আহত এবং জনতার পিটুনিতে ২ ডাকাতের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় আওয়ামী লীগ নেতা ও স্থানীয় চেয়ারম্যান বিচার-শালিসের কথা বলে স্থানীয় কয়েকজন জামায়াতকর্মীকে ডেকে এনে স্থানীয় মসজিদের মাইকে ডাকাত পড়েছে বলে ঘোষণা দিয়ে গণপিটুনিতে দুইজনকে হত্যা করেছে। পাবনার সুজানগরে ইউএনওর কক্ষে স্থানীয় জামায়াতের নায়েবে আমিরসহ চারজন স্থানীয় বিএনপি নেতাকর্মীর মারধরের শিকার হওয়ার খবর প্রকাশিত হয়েছে। একদিকে রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের নতুন প্রতিযোগিতা অন্যদিকে পেশাদার অপরাধি ও পতিত স্বৈরাচারের দোসর-সন্ত্রাসীদের অপতৎপরতা ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশের ব্যর্থতা সামগ্রিক পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলেছে। জননিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলার উন্নয়নে ছাত্র-জনতা ও স্বৈরাচারবিরোধী রাজনৈতিক জোটের শরিকদের মধ্যে ন্যূনতম সমঝোতা, সমন্বয় ও যথাযথ ভূমিকা পালনের বিকল্প নেই।
বিগত সরকারের আমলেও আইনশৃঙ্খলার অবনতি ও মব জাস্টিসের বিশৃঙ্খলা ও জননিরাপত্তায় হুমকি দেখা দিয়েছিল। চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম লক্ষ্য ছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও বিচার ব্যবস্থাকে দলীয়করণ থেকে মুক্ত করে জননিরাপত্তা নিশ্চিত করা। অর্ন্তবর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের ৭ মাস পরেও সাধারণ মানুষ মব জাস্টিসের শিকার হয়ে বেঘোরে প্রাণ হারানোর বাস্তবতা মেনে নেয়া যায় না। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত রিপোর্ট অনুসারে ৬ মাসে শতাধিক মানুষ মব জাস্টিসের শিকার হয়েছে। পুলিশের প্রতি এখনো মানুষের আস্থা ফিরে আসেনি। চলমান বিশৃঙ্খলা ও কথিত মব জাস্টিস মোকাবিলায় পুলিশের কার্যকর পদক্ষেপ, দলনিরপেক্ষ ভূমিকায় অপরাধিদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান পুলিশকে মানুষের আস্থার জায়গায় নিয়ে যেতে পারে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশ বিভাগ সে লক্ষ্যে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না। পুলিশের নিষ্ক্রিয়তার কারণে ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ার নিয়ে সারা দেশে সেনাবাহিনী মোতায়েন থাকা সত্ত্বেও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ও মব জাস্টিসের মতো দুর্বৃত্তপনা বেড়ে যাওয়ার বাস্তবতা সেনাবাহিনীর সদিচ্ছার প্রশ্নে সাধারণ মানুষকে সন্দিহান করে তুলছে। এটা বাহিনীর জন্য সুখকর বিষয় নয়। রাজনৈতিক পক্ষগুলোর মধ্যকার বিভেদণ্ডবৈরিতা, পারস্পরিক হানাহানি সমাজে বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি করছে। দেশের অর্থনীতি, বিনিয়োগ ও সামগ্রিক স্থিতিশীলতার উপরও বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি করছে। সবকিছুর ঊর্ধ্বে জননিরাপত্তা। এটা নিশ্চিত করতে না পারলে কোনো সংস্কার কিংবা রাজনৈতিক বন্দোবস্তের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা অর্জন করা সম্ভব নয়। এখানে কোনো রাজনীতি নেই। সরকারকে যে কোনো মূল্যে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ ও জননিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। একজন উপদেষ্টা জোর দিয়ে বলেছেন, মব জাস্টিস ও মোরাল পুলিশিংয়ের কোনো সুযোগ নেই। শুধু কথা বললেই হবে না, কাজের মধ্য দিয়ে সরকারকে তার সক্ষমতার প্রমাণ দিতে হবে। পতিত স্বৈরাচারের দোসরদের দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র, অপ-পপ্রচার, অপতৎপরতা মোকাবিলা করেই নতুন বাংলাদেশের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে এগিয়ে যেতে হবে। মব জাস্টিস ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে দ্রুত আইনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।