সমাজের প্রতিটি স্তরে প্রবীণদের কথা আলোচিত হলেও, প্রবীণ নারীদের বিশেষ চাহিদা ও সমস্যাগুলো প্রায়ই উপেক্ষিত থেকে যায়। নারী যখন শৈশব, যৌবন বা মধ্যবয়সে থাকেন, তখন পরিবারের, সমাজের, এমনকি রাষ্ট্রেরও নানা দিক থেকে তার প্রতি কিছুটা হলেও মনোযোগ থাকে। কিন্তু বয়স বাড়ার সাথে সাথে এই মনোযোগ যেন কমতে থাকে। আমাদের সমাজ, পরিবার, স্বাস্থ্যসেবা এবং অর্থনৈতিক পরিস্থিতির দিকে গভীরভাবে নজর দিলে উঠে আসবে প্রবীণ নারীরা এই সমাজে কতটা অসহায়।
প্রবীণ নারীরা জীবনের দীর্ঘসময় পার করে যখন বার্ধক্যে পৌঁছান, তখন তাদের বিভিন্ন ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। শারীরিক দুর্বলতা, একাকিত্ব, আর্থিক অনিশ্চয়তা, পারিবারিক অবহেলা এবং সামাজিক অবজ্ঞার মতো চ্যালেঞ্জ তাদের প্রতিদিনের বাস্তবতা হয়ে দাঁড়ায়। বিশেষ করে যারা বিধবা হন বা সন্তানদের কাছ থেকে দূরে থাকেন, তাদের জীবন হয়ে ওঠে বিভীষিকাময়।
তাছাড়া আমাদের সমাজে প্রবীণ নারীদের জন্য বিশেষ কোনো সামাজিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। সরকারি কিছু ভাতা বা সাহায্য থাকলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। অনেক সময় তারা ন্যূনতম অধিকার থেকেও বঞ্চিত হন। সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিও প্রবীণ নারীদের গুরুত্ব কমিয়ে দেয়, যেন তারা আর সমাজের জন্য তেমন মূল্যবান নন। জাতিসংঘের এক পরিসংখ্যান অনুসারে, ৬০ বছরের বেশি বয়সীদের মধ্যে প্রায় ৫৪ শতাংশ নারী, এবং ৮০ বছরের বেশি বয়সীদের মধ্যে এই সংখ্যা ৬২ শতাংশ। এই সংখ্যাগুলো স্পষ্টতই দেখায় যে প্রবীণ জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ নারী; কিন্তু সমাজ কি তাদের জন্য যথেষ্ট উদ্যোগ নিচ্ছে?
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, প্রবীণ নারীদের মধ্যে ৪৬ শতাংশ বিভিন্ন ধরনের দীর্ঘস্থায়ী শারীরিক সমস্যায় ভুগছেন, বিশেষ করে বাত, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ এবং মানসিক অবসাদ। বাংলাদেশেও প্রবীণ নারীদের জন্য বিশেষায়িত স্বাস্থ্যসেবা প্রায় অনুপস্থিত। সরকারি হাসপাতালে প্রবীণদের জন্য কিছু সুবিধা থাকলেও, তা পর্যাপ্ত নয়। বিশ্বব্যাংকের ২০২১ সালের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বাংলাদেশে ৬০ বছরের বেশি বয়সী নারীদের ৭০ শতাংশ কোনো না কোনো আর্থিক অনিরাপত্তার মধ্যে বাস করেন। বিশেষত গ্রামাঞ্চলে বসবাসকারী প্রবীণ নারীরা বিধবা হওয়ার পর প্রায়ই নিঃসঙ্গতা ও দারিদ্র্যের শিকার হন।
পারিবারিক কাঠামোর পরিবর্তনের ফলে আজকাল যৌথ পরিবারের সংখ্যা কমে আসছে, যা প্রবীণ নারীদের জন্য এক বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আগে যেখানে পরিবারের বয়স্ক নারীরা সিদ্ধান্ত গ্রহণে ভূমিকা রাখতেন, এখন তাদের অনেকেই পরিবারের মূলধারার বাইরে চলে গেছেন। জাতীয় প্রবীণ নীতিমালা অনুযায়ী প্রবীণদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কথা বলা হলেও, বাস্তবে প্রবীণ নারীদের জন্য তেমন কার্যকর উদ্যোগ দেখা যায় না। পেনশন বা সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীতে প্রবীণ নারীদের অন্তর্ভুক্তির হার পুরুষদের তুলনায় কম। ২০১৯ সালের সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, প্রবীণ ভাতাভোগীদের মধ্যে মাত্র ৩০% নারী, যেখানে নারীদের সংখ্যা অনেক বেশি হওয়া উচিত ছিল।
শহুরে প্রবীণ নারীরা যেমন একাকিত্ব ও মানসিক অবসাদে ভুগছেন, তেমনি গ্রামাঞ্চলের নারীরা দারিদ্র্য ও শারীরিক অবহেলার শিকার। ‘হেল্পএজ ইন্টারন্যাশনাল’-এর গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে প্রবীণ নারীদের মধ্যে ৬৫ শতাংশ কোনো না কোনোভাবে পরিবারের ওপর নির্ভরশীল; কিন্তু তাদের প্রতি পরিবারের মনোভাব সবসময় ইতিবাচক নয়। অনেক প্রবীণ নারী শেষ বয়সে অবহেলা ও দুর্ব্যবহারের শিকার হন, যা মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন।
এ সমস্যা সমাধানে আমাদের করণীয় রয়েছে অনেক কিছু। প্রবীণ নারীদের জন্য বিশেষায়িত স্বাস্থ্যসেবা, মানসিক সুস্থতার উদ্যোগ, সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রমে তাদের জন্য বরাদ্দ বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। পরিবার ও সমাজকেও দায়িত্ব নিতে হবে, যাতে প্রবীণ নারীরা শেষ বয়সে অবহেলিত না হন। আমাদের মনে রাখতে হবে, আজ যারা প্রবীণ, কাল আমরাও তাদের জায়গায় থাকব। প্রবীণ নারীদের কথা ভাবা মানে আসলে নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়েই ভাবা।
সরকারের উচিত এই মানুষদের নিয়ে আলাদা করে ভাবার। প্রবীণ নারীদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের জন্য ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। পরিবার ও সমাজের মধ্যে প্রবীণ নারীদের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। প্রবীণ নারীদের জন্য বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা, নিয়মিত চেকআপ এবং মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা নিশ্চিত করতে হবে। শুধু তাই নয়, প্রবীণ নারীদের জন্য বিশেষ ভাতা, কর্মসংস্থান ও পেনশন সুবিধার ব্যবস্থা করা দরকার। আমাদের যাদের পরিবারে প্রবীণ নারী রয়েছেন, আমাদের উচিত তাদের গুরুত্ব দেয়া, তাদের প্রতি যত্নশীল হওয়া। এছাড়া প্রবীণ নারীদের জন্য সামাজিক যোগাযোগ বৃদ্ধি, সাংস্কৃতিক কার্যক্রম ও বিনোদনের সুযোগ তৈরি করা যেতে পারে।
পরিশেষে বলতে চাই, প্রবীণ নারীদের অবহেলা করলে শুধু তারাই ক্ষতিগ্রস্ত হন না, পুরো সমাজই একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশের অভিভাবকত্ব ও অভিজ্ঞতা হারায়। প্রবীণ নারীদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করা এবং তাদের জীবনমান উন্নত করার জন্য পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। প্রবীণ নারীদের প্রতি যত্নশীল হওয়া আমাদের মানবিক দায়িত্ব, যা সমাজের সার্বিক উন্নতির জন্যও অপরিহার্য।