ঢাকা শুক্রবার, ২১ মার্চ ২০২৫, ৭ চৈত্র ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

ছোট্ট আছিয়ার অপরাধ কী ছিল

আজহার মাহমুদ
ছোট্ট আছিয়ার অপরাধ কী ছিল

৮ বছরের একটা শিশু কি বুঝে সে পুরুষ না-কি নারী? তার শরীরও কি বিপরীত লিঙ্গের মানুষকে আকর্ষণ করতে পারে! অথচ এই বয়সের একটা শিশুকে তিনজন মিলে পালাক্রমে ধর্ষণ করে। তাও আবার অন্য কেউ না, নিজের বোনের শ্বশুর, স্বামী ও দেবর। মাগুরায় ৮ বছরের শিশু আছিয়া বড় বোনের বাড়িতে বেড়াতে এসে এমন নিশৃংসতার শিকার হয়। ঘটনাটি গত ৬ মার্চ বৃহস্পতিবার ঘটে।

অপরাধীরা ধর্ষণ করেই ক্ষান্ত হয়নি, চেষ্টা করেছে তাকে হত্যা করারও। ধর্ষণের সময় কোন ধরনের পাশবিক নির্যাতন করা হয়েছে সেটা ডাক্তারের রিপোর্ট দেখলে বুঝতে পারবেন। ডাক্তারদের ভাষ্যমতে, সৃষ্টিকর্তা চেয়েছেন বলেই এই শিশুটি বেঁচে আছেন। তার উপর যে অমানবিক নির্যাতন হয়েছে, সেখান থেকে জীবিত ফেরা অলৌকিক ঘটনা। বর্তমানে শিশুটি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আশঙ্কাজনক অবস্থায় আইসিইউতে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে। এ ঘটনায় সিনেমার নায়ক থেকে শুরু করে অনেক তারকা ক্রিকেটার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিচার চেয়েছেন, নিন্দা জানিয়েছেন। এছাড়া ঢাবি, রাবি, ইবি, শাবিপ্রবি শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ মিছিল করেছেন। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানে ক্লাস বর্জনও করা হয়েছে। এরইমধ্যে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর যৌথ অভিযানে গ্রেপ্তার করা হয়েছে শিশুটির বোনের স্বামী, শ্বশুর, শাশুড়ি ও ভাশুরকে। তবে একটা বিষয় বেশ ভয়ংকর এবং জঘণ্য লাগল। কতটা সাইকোপ্যাথ হলে, নিজের বাবাকে সাথে নিয়ে নিজের বউয়ের ছোট বোনকে কেউ ধর্ষণ করে! মানে এতটা অধঃপতন হয়েছে এদেশের মানুষের! তাও একটা মুসলিম অধ্যুষিত দেশে এমন ঘটনা! আছিয়ার বড় বোনের ভাষ্য অনুযায়ী, তার শ্বশুরের ধারা সেও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। বিষয়টি স্বামী সজিবকে তিনি জানিয়েছিলেন। কিন্তু কোনো প্রতিকার পাননি। পরে বাবার বাড়ি চলে যান। আর স্বামীর বাড়ি ফিরতে চাইছিলেন না। বাবা-মা বুঝিয়ে ছোট বোনকে সঙ্গে করে পাঠিয়ে দেন শ্বশুরবাড়ি। আর সেটাই বিপদ ডেকে আনল। এখানে আছিয়ার বাবা-মায়েরও দায় রয়েছে। এমন একটা নোংরা পরিবারে আবার নিজের দুই মেয়েকে পাঠানো মারাত্মক ভুল হয়েছে। সাথে সাথে বড় মেয়ের সাথে যা হয়েছে তার ব্যবস্থা নেয়া উচিত ছিলো। আসলে আছিয়ার বাবা-মা বুঝতে পারেনি ৮ বছরের একটা শিশুর সাথেও এমন হতে পারে! একটি শিশুর প্রতি এতটা সহিংসতা আর অমানবিকতা কীভাবে হয়! বিশ্বাস করতে মন চাইবে না কারোর। আপনাদের হয়তো রাজধানীর ডেমরার ঘটনটা মনে আছে। বাসার খাটের নিচ থেকে দুইটি শিশুর মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। লিপস্টিক দিয়ে সাজিয়ে দেয়ার নাম করে শিশু দুটিকে বাসায় ডেকে ধর্ষণ করতে চেয়েছে কিছু পশু। ব্যর্থ হয়ে শিশু দুটির একজনকে গলা টিপে এবং আরেকজনকে গলায় গামছা পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়। আবার আপনি যদি রাজধানীর তুরাগের ঘটনাটা মনে করেন, স্কুল থেকে ফেরার পথে ষষ্ঠ শ্রেণির এক ছাত্রীকে ধর্ষণের পর হত্যার চেষ্টা করে এক যুবক। শুধু কি তা-ই! আপনি অবাক হবেন, দুই বছর দশ দিনের শিশুকে যখন ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়। এমন ঘটনাও ঘটেছে ২০১৯ সালে রাজধানীর গেণ্ডারিয়ায়। প্রশ্ন হলো এটুকু একটা বাচ্ছার মাঝে কি পায় পশুরা? দিনের পর দিন এভাবে ছোট ছোট নিষ্পাপ শিশুদের সঙ্গে অন্যায় চলছে আর চলছে। এ বিষয়ে সমাজের এবং রাষ্ট্রের কঠোর ভূমিকা পালন করার কথা থাকলেও রাষ্ট্র এখনও কঠোর হতে পারছে না। কঠোর হলে এমন ঘটনা কিঞ্চিৎ হলেও কমতো বলে মনে করি। আছিয়ার ঘটনায় দায়ের করা মামলার বিচার ১৮০ দিনের মধ্যে শেষ করার নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। কিন্তু আমি মনে করি ১৮০ দিন, অনেকদিন। ৭ দিনে এই বিচার করতে হবে। সাথে সাথে এর বিচার হতে হবে। প্রকাশ্যে এই অপরাধের শাস্তি হতে হবে। জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরামের এ প্রতিবেদনে বলা হয়, গত সাড়ে ৩ বছরে ২২০৪ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়। এরমধ্যে ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত ৮ মাস পর্যন্ত ২২৪ জন কন্যাশিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে বেশ কিছু ঘটনা নিকটাত্মীয়ের মাধ্যমে সংঘটিত হয়েছে। হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির (এইচআরএসএস) তথ্য অনুসারে, ২০২০-২৪ সাল পর্যন্ত গত পাঁচ বছরে, বাংলাদেশে কমপক্ষে ৩ হাজার ৪৭১ জন মেয়ে শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। পরিসংখ্যান দেখে এটা অন্তত বুঝা যায়, আমাদের মধ্যে বিচারহীনতার সংস্কৃতি বিরাজ করছে। এ ধরনের ঘটনা বেড়ে যাওয়া সেটিরই প্রতিফলন।

গবেষণায় দেখা যায়, ঘরে ঘরে নিকটাত্মীয় কর্তৃক ধর্ষিত ও যৌন নিপীড়নের শিকার বেশি হয় শিশুরা। শিশু-কিশোরী ধর্ষণের ঘটনা বেশি ঘটে পরিবারে, নিকটাত্মীয় দ্বারা। এসব ঘটনার অনেক কিছুই প্রকাশ পায় না। একইভাবে শিক্ষিত মহল, মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্তের মধ্যেও অনেক দুর্ঘটনা রয়েছে, যা প্রকাশ পায় না।

অনেক আগে থেকেই এ ধরনের মারাত্মক অপরাধ সংঘটিত হয়ে এলেও সাম্প্রতিক সময়ে এ ধরনের ঘটনায় প্রধান নিয়ামকের ভূমিকায় রয়েছে পর্নোগ্রাফি। তথ্যপ্রযুক্তি বা ইন্টারনেটসহ মোবাইল ফোন, কম্পিউটার, ল্যাপটপ ইত্যাদিতে পর্নোছবি দেখার মাধ্যমে এই মানসিকতা তৈরি হয় অপরাধীর। চিকিৎসাবিজ্ঞান বলছে, একজন মানুষ যখন পর্নোগ্রাফি দেখে, তখন তার মস্তিষ্ক থেকে হরমোন নিঃসরণ হয়। যার মাধ্যমে ওই ব্যক্তি যৌনাচারে উৎসাহিত হয়। এ ধরনের মানুষ তখন যৌন আচরণ করার জন্য পশুর মতো হয়ে ওঠে। শুধু পর্নোগ্রাফি নয়, মাদকও আরেক নিয়ামক। এমনও অনেক মাদক রয়েছে, যা সেবন করলে সেবীকে যৌনতায় প্রবৃত্ত করে। কিছু কিছু নাটক, চলচ্চিত্রসহ বিশ্ব সংস্কৃতির বিভিন্ন উপাদান ধর্ষণে উৎসাহিত করে। এসব উপাদান বিশেষ করে নতুন প্রজন্মকে খুঁচে খুঁচে নষ্ট করছে। মেয়েরা ভোগের বস্তু এমন ধারণা তাদের মধ্যে প্রোথিত করছে। জাতীয়ভাবে আমাদের নিজস্ব পারিবারিক, সামাজিক, নৈতিক ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ রয়েছে। আমাদের সাংস্কৃতিক জীবনধারা অত্যন্ত মজবুত। কিন্তু বর্তমানে বিশ্ব সংস্কৃতির যে সুনামি চলছে, তা আমাদের পারিবারিক-সামাজিক-নৈতিক মূল্যবোধ ভেঙে চুরমার করে দিচ্ছে।

সাম্প্রতিক সময়ে ধর্ষণের ঘটনা বেড়ে যাওয়া, মূলত পারিবারিক ও সামাজিক প্রথা ও সংস্কার ধূলিসাৎ, সামাজিক ও নৈতিকতার চরম অবক্ষয়, তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহার বিশেষ করে ল্যাপটপ-কম্পিউটার-মোবাইল ফোন এবং ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা ও জবাবদিহিতাবিহীন ব্যবহারের সুযোগ, পর্নোগ্রাফির অবাধ বিস্তার। বিশ্ব সংস্কৃতির নেতিবাচক দিকের আগ্রাসনই ধর্ষণের ঘটনা বাড়িয়ে দিয়েছে। এ সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দুর্বল পারিবারিক বন্ধন, দুর্বল সামাজিক কাঠামো, অশিক্ষা, কুশিক্ষা, দারিদ্র্য, বিচারহীনতা। আরও রয়েছে স্থানীয় ও জাতীয় সংস্কৃতি চর্চার অভাব, সুষ্ঠু ও সুস্থ ধারার বিনোদনের অনুপস্থিতি, কিশোর-কিশোরীদের ক্রীড়া-কর্মকাণ্ডের অভাব ইত্যাদি। এর চেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে, সমাজে যতসংখ্যক ধর্ষণের ঘটনা আমরা শুনি, ততটার বিচারের খবর আমরা পাই না। গণমাধ্যমে এ ধরনের খবর তেমন একটা দেখা যায় না। বরং অনেক ক্ষেত্রে ধর্ষকরা শুধু পারই পায় না, পুরস্কৃতও হয়।

ধর্ষণ তথা যৌন নির্যাতন হ্রাসের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখতে পারে রাষ্ট্র। যদি ধর্ষকের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া যায়, তাহলে এ ঘটনা হ্রাসের পাশাপাশি বন্ধও হতে পারে। রাষ্ট্রের পাশাপাশি এ ক্ষেত্রে সমাজ এবং পরিবারও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। তাই সামাজিক ও জাতীয় জীবনে নৈতিক মূল্যবোধ সুগঠিত ও সুসংগঠিত করতে হবে। তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহার ও অশুভ বিস্তার ঠেকাতে হবে। বিশ্ব সংস্কৃতির নেতিবাচক উপাদানও নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। এসবের দায়িত্ব প্রধানত রাষ্ট্রের। আর রাষ্ট্রকে সাহায্য করতে হবে আমাদের। পাশাপাশি আমাদের পারিবারিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য লালন করতে হবে। তাহলেই আমরা এই ভয়াবহতা এবং অমানবিকতা থেকে রক্ষা পেতে পারি। সেইসাথে, আছিয়ার সাথে যে ঘটনা হয়েছে তার বিচার আরও দ্রুত করা উচিত। একটা ঘটনা নিয়ে এতো হইচই হওয়ার পরও সেই মামলার বিচার শেষ হতে যদি ছয় মাস লাগে, তাহলে বুঝতে হবে বাকি মামলাগুলোর কি অবস্থা! এমন বিচারব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে আমাদের। দ্রুত মামলা নিষ্পত্তি করতে হবে, দ্রুত বিচারের আওতায় আনতে হবে অপরাধীদের।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত