প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ২৭ মার্চ, ২০২৫
আর্থিক অনিয়ম নৈতিক সংকটের সংকীর্ণ রূপ। সাধারণত অনিয়ম-দুর্নীতি বলতে দেশের মানুষ আর্থিক কেলেঙ্কারি তথা ঘুষ, দুর্নীতিকে বোঝে। অথচ আর্থিক অনিয়ম শুরু করার আগে দুর্নীতিবাজকে দুর্নীতির চেইনের মধ্যে প্রবেশ করতে হয়। দুর্নীতিবাজদের প্রধান অস্ত্র হচ্ছে মিথ্যা বলে স্বার্থ হাসিল করা। চরিত্রবানের মুখোশে চরিত্রহীন হওয়া। মানুষকে দেয়া প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করা। আমানতের খেয়ানত করা। তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন না করা। যখন পচন দেহ ও মনের সর্বব্যাপী হয় তথা অনিয়মের শেষ ধাপে গিয়ে অর্থ গ্রহণ করে বা অর্থ তছরুপ করে। একজন ঘুষ গ্রহণ করে- এটা তার অন্যায়ের একমাত্র ধাপ নয়। আরও অনেকগুলো অন্যায় সে একই সাথে অথবা ধারাবাহিকভাবে সংঘটিত করছে। চূড়ান্ত ধাপে গিয়ে সে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে। কোথা থেকে অনিয়মের শুরু হলো? গোটা একটা প্রজন্মের অনেকেই যাতে চাকরিতে বেশি সময় থাকতে পারে, সেজন্য তাদের প্রকৃত জন্মসাল আড়াল করে ব্যক্তিভেদে মাস-বছর পিছিয়ে দেয়া হলো! যদিও এই অপরাধের জন্য ব্যক্তি দায়ী নন কিন্তু ব্যক্তির পূর্বতনরা অপরাধের যে বীজ বপন করে গেলেন এবার তা শাখা-প্রশাখায় বাড়বে! স্কুল-কলেজ জীবনে যে শিক্ষার্থী আলাদা সুযোগ পেয়ে, নকল করে কিংবা যোগ্যতার চেয়ে পরীক্ষায় বেশি নম্বর পেয়ে শিক্ষা জীবন শেষ করেছে সে আর কোনোদিন অনিয়ম-দুর্নীতি ত্যাগ করতে পারবে? ঘুষ দিয়ে যারা চাকরি পেয়েছে, সুপারিশে যারা সফল হয়েছে তাদের থেকে সমাজ এবং রাষ্ট্র নৈতিকতা আশা করে? চাটুকারিতা করে যারা বাড়তি সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করে তারা প্রকৃতপক্ষে ভালো মানুষের সহমর্মিতা ও ভালোবাসা কোনোদিন পাবে? বেতনের থেকে যাদের সম্পদ বহুগুণ বেড়েছে তারা নিজেরাই শুধু আর্থিক অনিয়ম করেনি কিংবা করে সামলাতেও পারেনি বরং বিশাল একটি চক্রের মধ্যে সে সামান্য একটি গুটি। তিনিও কারো দ্বারা ব্যবহৃত হয়েছে আবার সেও কাউকে ব্যবহার করে আর্থিক স্বার্থ হাসিল করেছে।
এই যাত্রায় কারো অধিকার হরণ করতে হয়েছে, কারো হক আটকাতে হয়েছে, কারো আইল ঠেলতে হয়েছে, কাউকে ঠকাতে হয়েছে, কারো সম্পদ দখল করতে হয়েছে কিংবা কোনো অসহায়ের দীর্ঘশ্বাসের কান্নার অভিশাপ বহন করতে হয়েছে। কেউ কিংবা কতিপয় ঘুষ গ্রহণ করে- এটা অপরাধ চক্রের অতি সামান্য অংশ। বরং যে প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ক্ষমতাশালীরা দানব হয়ে ওঠে, চাকরিজীবীগণ প্রভু হয়ে ওঠে- সেই গোটা প্রক্রিয়াটাকেই অপরাধের আতুর ঘর হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। আমরা সেই প্রজন্মের অংশ যাদের নিজেদের বাবার পকেট থেকে দুই টাকা নেয়ার সময় হাত কাঁপত। অথচ সেই সোনালি প্রজন্মের সদস্যরাই দুই হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করে দিয়েও গর্বের সাথে দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে। কোটি কোটি টাকা তছরুপ করার মতোই কারো নাগরিক অধিকার হরণ করা বা ভোটাধিকার বঞ্চিত করাও গুরুতর অন্যায়। অথচ বছরের পর বছর সেই অপরাধের লালন হয়েছে। কেউ কেউ সেটার পৃষ্ঠপোষক ও অংশ হয়েছে। দায়িত্বশীলরা স্ব স্বার্থের কাছে বিবেক-বুদ্ধি বিক্রি করে অপরাধের চাদর বিছাতে সাহায্য করেছে। বিচারহীনতার সংস্কৃতি, লুটপাট-দখলের সংস্কৃতি, বানানো ইতিহাস নিয়ে গৌরব ও মাতমের সংস্কৃতি, বিরোধী পক্ষকে পঙ্গু করে দেয়ার সংস্কৃতি কিংবা আমরাই সেরা ও সঠিক হয়ে ওঠার মনোভাব জাতিগতভাবেই আমাদের পঙ্গু করেছে। গড়ে তুলেছে নৈতিক মেরুদণ্ডহীন দানব হিসেবে। ব্যক্তির অনিয়ম, অন্যায় এবং দুর্নীতির জন্য সর্বক্ষেত্রে কেবল ব্যক্তিই এককভাবে দায়ী নয় বরং পারিপার্শ্বিকতাও দায়ী। অসুস্থ চর্চার কারণে কখনও কখনও অন্যায় সহ্য করতে বাধ্য হতে হয়। অন্যায়ের সাথে আপস করেছে সে সংখ্যাটাও নেহায়েত কম নয়। গোটা সিস্টেম যখন দুর্নীতিগ্রস্ত তখন দুই-চারজনের উজানের বিপরীতে দাঁড়িয়ে লড়াই করে টিকে থাকা খুব সহজ নয়। মানুষ স্বভাবতই সংক্রমিত মনোভাবের। খারাপের দ্বারা সে দ্রুত সংক্রমিত হয়। আশপাশে কিছু মানুষ থাকে যারা চাটুকারিতা করে ভালো থাকে, অনিয়ম করে প্রভাবশালী হয় এবং দুর্নীতি করে দাতা সাজে! এরা যখন সমাজের ভালোদের সামনে দাপট দেখায়, সমাজের পরিবেশকে নাভিশ্বাস করে তোলে তখন ভালোরাও তাদের ভালোত্বকে জীবন ধারণের ভুল পদ্ধতি ভাবতে থাকে! নিরীহ গোছের মানুষেরাই সবচেয়ে বেশি লাঞ্ছিত ও বঞ্চিত হন। শুধু আর্থিক অনিয়ম নয় বরং সংস্কার করতে হবে সার্বিকভাবে। পাহারা দিয়ে ঘুষ-দুর্নীতি থেকে দুই চারজনকে সাময়িকভাবে বিরত রাখা যাবে বটে তবে সুযোগ পেলে তারা আবারও অন্যায় করবে। কু স্বভাব আড়াল করা মোটেই সহজ নয়। কাজেই নৈতিক মানুষ গড়া ছাড়া অপরাধ কমানোর সাধ্য কারো নেই। বিশ্বস্ত থাকা, অন্যায় না করা কিংবা দায়িত্ববান হওয়া- এসব যাতে ব্যক্তির বিবেক থেকে উৎকলিত হয়- সেই পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। কঠোর হয়ে শুধু ঘুষ গ্রহণ বন্ধ করলে হবে না বরং সুদ-ঘুষ যে চরম মাত্রার অপরাধ তা বোঝার মানসিকতা তৈরি করতে হবে। সমাজের অন্য সব অন্যায়-অপরাধের হার কমলে আর্থিক দুর্নীতিও কমে আসবে। কমতে বাধ্য হবে। মানুষ যখন অনিয়ম করবে না তখন অনিয়ম থেকে রক্ষা পেতে কারো দ্বারস্থও হবে না। পেশাগত উৎকর্ষ এবং সামষ্টিক নিরাপত্তা জোরদার করতে হবে। যারা অন্যায় করে, অপরাধে জড়ায়- এই সংখ্যাটি সব সময় কম থাকে। তবে ভালোদের গুটিয়ে থাকা স্বভাবের কারণে মন্দদের দাপট বেশি থাকে। সব ক্ষেত্রের অন্যায় রুখে দেয়ার জন্য সামাজিক জাগরণ খুব রকমের প্রয়োজন। চূড়ান্ত দুর্নীতি তথা আর্থিক অনিয়ম প্রবেশের পূর্বের সকল ধাপগুলো বন্ধ করে দিতে হবে। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার জন্য প্রযুক্তিনির্ভরতা সন্তোষজনক সমাধানের উপায় হতে পারে। ব্যক্তির সাথে ব্যক্তির যোগাযোগ যত কমানো যাবে অনিয়ম-দুর্নীতি তত কমবে। আমাদের দেশে এমন সামান্য ব্যাপারেও আর্থিক লেনদেন করতে বাধ্য হতে হয় যা উন্নত দেশসমূহের লোকেরা শুনলে হাসবে। অথচ নৈমিত্তিক রুটিন মেনেই সেসব হচ্ছে। এখন সময় রুখে দাঁড়াবার এবং রুখে দেয়ার। অন্যায়, অনিয়ম? আর না, আর না।