প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ০৫ এপ্রিল, ২০২৫
বাংলাদেশের অন্যতম বড় সামাজিক সমস্যা হচ্ছে কুসংস্কার, কুপ্রথা ও গোড়ামী। বাংলাদেশের একটি বড় সংখ্যক জনগোষ্ঠীর মধ্যে রয়েছে নানা ধরনের কুসংস্কার ও কুপ্রথা। এছাড়াও নানা ধরনের সামাজিক ও ধর্মীয় গোড়ামী বিদ্যমান। বাংলাদেশে যে পরিমাণ কুসংস্কার ও গোড়ামী চালু রয়েছে তা কোনো ধর্মই করতে বলেনি। অথচ, ধর্মের দোহাই দিয়ে সমাজপতি আর ধর্মব্যবসায়ীরা নানা ধরনের গোড়ামী ও কুসংস্কার টিকিয়ে রেখেছে। একসময় এ দেশে নানা ধরনের কুসংস্কার ও কুপ্রথা ছিল। হিন্দুসমাজে সবচেয়ে বেশি কুসংস্কার প্রচলিত রয়েছে। হিন্দুধর্মে সতীদাহ প্রথার রীতি ছিল খুবই মারাত্মক। কোনো হিন্দু মারা গেলে তার স্ত্রীকে জীবন্ত পুড়িয়ে ফেলা হতো। অথচ, হিন্দুদের কোনো ধর্মপ্রন্থেই এসব রীতির কথা বলা হয়নি। সমাজপতি আর ধর্মব্যবসায়ীরা যোগসাজশ করে যুগের পর যুগ এসব কুসংস্কার ও প্রথা টিকিয়ে রেখে নারীদের শোষণ করেছে। হিন্দুধর্মের ধর্মব্যবসায়ীরা তাদের ধর্মগ্রন্থে বিভিন্ন পূজা করার উল্লেখ না থাকার পরেও দিনের পর দিন নতুন নতুন পূজা আবিষ্কার করেছে। পূজার জন্য সাধারণ মানুষের দেয়া খাবার মূর্তিগুলো না খেলেও ধর্মব্যবসায়ীদের পেট ঠিকই ভরে যায়। সাধারণ মানুষ সংস্কৃত ভাষা না জানায় ধর্মব্যবসায়ীরা নিজেদের সুবিধামতো অনুবাদ করে দেয়। পূজার জন্য হিন্দুদের দান করা টাকা-পয়সা পুরোহিতরা ভোগ করে। প্রচলিত সেসব কুসংস্কারের বেশিরভাগেরই কোনো ধর্মীয় ভিত্তি নেই। হিন্দু ধর্মালম্বীরাই সবচেয়ে কম ধর্মগ্রন্থ পড়ে ও অনুবাদ জানে। যার ফলে একশ্রেণির লোক অর্থ শোষণের জন্য ধর্মব্যবসাকে হাতিয়ার হিসেবে নিয়েছে। বৌদ্ধ ধর্মেও রয়েছে নানা ধরনের কুসংস্কার ও কুপ্রথা। বৌদ্ধধর্মেও সাধারণ মানুষের অর্থ শোষণের জন্য ধর্মব্যবসায়ীরা নিজেদের মতো করে ধর্মকে সাজিয়েছে। বৌদ্ধদের ধর্মগ্রন্থের কোথাও মূর্তিপূজার কথা উল্লেখ নেই। বৌদ্ধধর্মের প্রবক্তা গৌতমবুদ্ধ কখনওই মূর্তিপূজা করতে বলেননি। কিন্তু, তিনি মারা যাওয়ার পর ধর্মব্যবসায়ীরা গৌতম বুদ্ধের মূর্তি বানিয়ে পূজা শুরু করল।
মানুষ খাবার, ফলমূল, টাকা-পয়সা এসবকিছু মূর্তির কাছে দিয়ে আসতে শুরু করল। আর এসবকিছু ধর্মব্যবসায়ীরা ভোগ করতে থাকে। খ্রিষ্টান ধর্মেও একই ঘটনা ঘটেছে। তারা ধর্মগ্রন্থের পরিবর্তে ধর্মব্যবসায়ীদের অনুসরণ করতে শুরু করে। ফলে তারা সঠিক ধর্মচর্চা থেকে অনেক দূরে চলে গেছে। ইসলাম ধর্মকেও পুঁজি করে নানা ধরনের কুসংস্কার, কুপ্রথা, গোড়ামী ও ধর্মব্যবসা শুরু হয়েছে। মাজারের ব্যবসা ও পীর মুরিদী ব্যবসার মাধ্যমে ধর্মব্যবসায়ীরা সবচেয়ে বেশি অর্থলোপাট করছে। ইসলাম ধর্মে কবরকে উঁচু করে ঢালাই করার মাধ্যমে গম্বুজ করতে সম্পূর্ণ নিষেধ করা হয়েছে। সহীহ মুসলিম হাদিস গ্রন্থে ইসলামের নবি ও রাসুল মুহাম্মদ (সা.) সব মূর্তি ও উঁচু কবরকে মাটির সঙ্গে সমান করে মিশিয়ে দিতে নির্দেশ দিয়েছেন। অথচ, বর্তমানে অনেক ধর্মব্যবসায়ীরাই কবরকে ঢালাই করে মাজারের ব্যবসা করছে। ইসলাম ধর্মে কোনো ব্যক্তির অন্ধ অনুসরণ করতে নিষেধ করা হয়েছে। কুরআনের অনুবাদ না জানা থাকার কারণে অনেক মানুষ তাদের টাকা-পয়সা, গরু-ছাগল তার পীরের কাছে দিয়ে দিচ্ছে। অনেকেই অনেক কিছু পাবার আশায়, ইচ্ছা পূরণ, মনবাসনা পূরণ, পুত্রসন্তান লাভ প্রভৃতি এসবকিছুর জন্য মাজার ও পীরদের কাছে অর্থসম্পত্তি দিয়ে আসে। অথচ এসবকিছু দেয়ার মালিক একমাত্র আল্লাহ। এছাড়াও নানা ধরনের তাবিজের ব্যবসা, মিলাদ পড়ানো, খতম পড়ানো, চল্লিশা করা, কুলখানি করা, চুক্তিভিত্তিক বক্তা ভাড়া, নামাজের শেষে বা অনুষ্ঠানে সম্মিলিত মোনাজাত, কবিরাজি ইত্যাদির কথা কুরআন ও হাদিসগ্রন্থের কোথাও উল্লেখ নেই। মানুষ মারা যাওয়ার পর এদেশের মানুষেরা দুঃখভরা মন নিয়ে না থেকে দুদিন পরেই কুলখানির নামে খাওয়া-দাওয়ার উৎসবে মেতে ওঠে। চল্লিশ দিন পর শকুনের দল আবার খাওয়া-দাওয়া করতে চলে আসে। বিভিন্ন হাদিসগ্রন্থে তাবিজ ব্যবহার করাকে শিরক হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। তাবিজ ব্যবহারের পক্ষে কোনো হাদিস নেই।
স্বেচ্ছায় হাদিয়া দেয়া ব্যতীত চুক্তি বা টাকার বিনিময়ে ইসলাম প্রচার করা সম্পূর্ণ নাজায়েজ। তবে ইমাম ও মুয়াজ্জিনদের বেতন নেয়াকে জায়েজ বলা হয়েছে। আরবি শব্দ মিলাদের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে জন্ম দেয়া। নতুন বাড়িঘর, দোকান ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান উদ্বোধনে মিলাদের আয়োজন করা হয়। এসব মিলাদের কথা হাদিসের কোথাও করতে বলা হয়নি। নামাজের শেষে যে সম্মিলিত মোনাজাত করা হয় তা নবি (সা.) কিংবা সাহাবা-সাহাবি তাদের কেউই করেননি। নবি (সা.), সাহাবা- সাহাবি ও পরবর্তী তিন যুগেও যে ইবাদত করা হয়নি সেটা। স্পষ্ট বিদাত। এছাড়াও মঙ্গলকামনায় যেভাবে খতম করে বেড়ানো হয় তা নবি (সা.) ও সাহাবা-সাহাবিদের যুগে কেউ করেনি। কবিরাজির মাধ্যমেও চলছে নানা ধরনের ভণ্ডামি ও অর্থলোপাটের ঘটনা। ইসলাম ধর্ম মতে আল্লাহ ব্যতীত অন্য কেউই ভবিষ্যৎ বলে দিতে পারে না। কিন্তু, তান্ত্রিক কবিরাজরা মিথ্যা ভবিষ্যৎ বলে সমাধানের উপায় আছে বলে মানুষের লক্ষ-কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। অনেকের মধ্যে মাযহাব গোড়ামী রয়েছে। এই গোড়ামীর কারণে অনেকেই সহীহ হাদিসকে অস্বীকার করে মাযহাবের মাসআলার অন্ধ অনুসরণ করে। কুসংস্কার, কুপ্রথা ও গোড়ামী দূর করতে হলে সঠিক ধর্মীয় শিক্ষার প্রয়োজন। সরকারকে বিভিন্ন ধর্মীয় গ্রন্থের অনুবাদের কপি প্রত্যেক উপাসনালয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। এছাড়াও ধর্মগ্রন্থগুলোর অনুবাদের কপি লাইব্রেরিতে বিক্রির ব্যবস্থা করতে হবে। ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের মাঝে কুসংস্কার, কুপ্রথা ও গোড়ামী দূর করতে হলে রাষ্ট্রীয়ভাবে সালাফী মানহাজের প্রচার ও প্রসার ঘটাতে হবে। ইসলামের আকিদা, তরিকাগুলোর মধ্যে সালাফি মানহাজ হচ্ছে সবচেয়ে আধুনিক ও বিশুদ্ধ। ইসলাম হচ্ছে আদি, মধ্য, আধুনিক সবযুগের জন্য একটি বিজ্ঞানসম্মত ধর্ম। কিন্তু, মানুষ শুধু কুরআন ও সহীহ হাদিস না মেনে পীর, ইমাম কিংবা মাযহাবের অন্বানুসরণ করায় ইসলাম থেকে দূরে চলে গেছে। ফলে গোড়ামীর জন্ম হয়েছে। সালাফী মানহাজ অনুযায়ী কুরআন ও সহীহ হাদিসের বাহিরে কাউকে মানার সুযোগ নেই।