বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের দুটি গুরুত্বপূর্ণ জেলা ফেনী ও নোয়াখালীর মধ্যে সংযোগ স্থাপনের প্রধান মাধ্যম হলো মূসাপুর ক্লোজার। এটি একাধারে একটি পানি নিয়ন্ত্রণ প্রকল্প, অন্যদিকে একটি জনগুরুত্বপূর্ণ সড়ক সেতু। তবে প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমের আগে এই ক্লোজারটি পুনঃনির্মাণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। চলতি বছরও তার ব্যতিক্রম নয়। তবে এবার আগেভাগেই শুরু হয়েছে পুনঃনির্মাণ কার্যক্রম, যা জনমনে আশার সঞ্চার করেছে। এই প্রবন্ধে আলোচনা করব মূসাপুর ক্লোজারের গুরুত্ব, সমস্যাবলি, চলমান নির্মাণকাজ এবং এর ভবিষ্যৎ প্রভাব সম্পর্কে।
মূসাপুর ক্লোজার : মূসাপুর ক্লোজার ফেনী নদীর ওপর অবস্থিত একটি পানি নিয়ন্ত্রণ বাঁধ, যা সোনাগাজী উপজেলার মূসাপুর ইউনিয়নের সঙ্গে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার চরএলাহী ইউনিয়নের সংযোগ ঘটায়। এটি স্থানীয় কৃষি, মৎস্য, যোগাযোগ এবং অর্থনীতির ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে। এছাড়াও এটি ফেনী নদীর লবণাক্ত পানি প্রবেশ প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সাধারণত ক্লোজারটি সড়ক হিসেবে ব্যবহার হয়ে থাকে। প্রতিদিন কয়েক হাজার যানবাহন এবং সাধারণ মানুষ এই পথ ব্যবহার করেন। ফলে এর রক্ষণাবেক্ষণ অত্যন্ত জরুরি।
বর্ষার আগের চ্যালেঞ্জ : প্রতিবছর বর্ষার আগে ফেনী নদীতে পানিপ্রবাহ বেড়ে যায় এবং মূসাপুর ক্লোজার মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়ে। তীব্র স্রোত, পলি জমে থাকা এবং বাঁধের পুরোনো কাঠামো ধসে যাওয়ার ফলে যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। তখন যাতায়াতের জন্য নৌপথই একমাত্র ভরসা হয়ে দাঁড়ায়, যা সময়সাপেক্ষ, ব্যয়বহুল এবং অনিরাপদ। চলতি বছর জানুয়ারি মাসে শেষবারের মতো পুরোনো কাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিছু অংশ ধসে পড়ে এবং হঠাৎ করে এলাকাবাসী যানবাহন চলাচল বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়। এই অভিজ্ঞতা থেকেই বর্ষার আগেই সম্পূর্ণ পুনঃনির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়।
পুনঃনির্মাণ কার্যক্রম, অগ্রগতি ও বাস্তবতা : ২০২৫ সালের মার্চ মাসে পানি উন্নয়ন বোর্ড এবং স্থানীয় প্রশাসনের যৌথ উদ্যোগে ক্লোজারটির পূর্ণ সংস্কার কাজ শুরু হয়। প্রায় ৩০ কোটি টাকা বাজেটের এই প্রকল্পে কাজ করছেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রকৌশল বিভাগ, স্থানীয় ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান এবং ইউনিয়ন পরিষদের প্রতিনিধিরা।
প্রকল্পের আওতায় নিচের বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত : পুরোনো বাঁধ অপসারণ ও মজবুত কংক্রিট স্ল্যাব স্থাপন, ড্রেনেজব্যবস্থা আধুনিকীকরণ, উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন বন্যা নিয়ন্ত্রণ গেট স্থাপন, আধুনিক এলইডি লাইটিং ও নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা, গতি নিয়ন্ত্রণের জন্য স্পিড ব্রেকার ও সাইনবোর্ড স্থাপন, প্রথম মাসে মাটি কাটা, স্ল্যাব ফাউন্ডেশন এবং স্টিলের কাঠামো প্রস্তুত হয়। এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে এসে ৬০ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। বর্ষা মৌসুম (জুনের শুরু) আসার আগেই ১০০ শতাংশ কাজ শেষ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।
জনগণের প্রত্যাশা ও মতামত : স্থানীয় কৃষকরা বলেন, ‘ক্লোজার ঠিক থাকলে আমাদের জমিতে পানি বেশি থাকে না। বর্ষায় যদি এটি ধসে পড়ে, ফসল ডুবে যায়। এবার আগেভাগে কাজ শুরু হওয়ায় আমরা খুবই আশাবাদী।’ একইভাবে ব্যবসায়ীরা বলেন, ‘আগে যখন সেতু ভেঙে যেত, তখন নৌকায় মালামাল পাঠাতে হতো। খরচ অনেক বেড়ে যেত। এবার যদি কাজটা ঠিকমতো শেষ হয়, তাহলে ব্যবসায় অনেক সুবিধা হবে।’ তবে অনেকে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন ঠিকাদারি কাজের মান নিয়ে। অতীতে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহারের অভিযোগ ছিল। তবে স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, প্রতিটি ধাপ পর্যবেক্ষণে রাখা হচ্ছে এবং মানসম্পন্ন নির্মাণকাজের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে।
সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব : মূসাপুর ক্লোজার শুধু একটি সেতু নয়; এটি এই অঞ্চলের প্রাণরেখা। এর মেরামত ও পূর্ণ নির্মাণের ফলে নিম্নলিখিত ইতিবাচক প্রভাব প্রত্যাশিত : দ্রুত যোগাযোগ নিশ্চিত হবে, ফলে পণ্য পরিবহন ব্যয় কমে যাবে। জরুরি স্বাস্থ্যসেবা পাওয়া সহজ হবে ফেনী সদর হাসপাতালে যাওয়া সময় বাঁচবে। বিদ্যালয়গামী শিক্ষার্থীদের যাতায়াতে সুবিধা হবে। সামাজিক যোগাযোগ ও পারস্পরিক সহযোগিতা বাড়বে দুই জেলার মানুষের মধ্যে। কৃষি ও মাছচাষের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট পানি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে, ফলে উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে।
দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার প্রয়োজনীয়তা : যদিও এ বছর ক্লোজারটির পুনঃনির্মাণ কাজ চলছে, ভবিষ্যতে এমন সমস্যা এড়াতে চাইলে স্থায়ী সমাধানের দিকে নজর দিতে হবে। যেমন: পাকা আরসিসি সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা, বার্ষিক মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য আলাদা তহবিল গঠন, ডিজিটাল মনিটরিং সিস্টেম চালু, স্থানীয়দের প্রশিক্ষণ দিয়ে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন, পানি উন্নয়ন বোর্ড এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, ভবিষ্যতে এই অঞ্চলকে ঘিরে একটি ‘মাল্টিফাংশনাল ক্লোজার প্রকল্প’ হাতে নেওয়া হবে, যাতে বন্যা নিয়ন্ত্রণ, বিদ্যুৎ উৎপাদন ও পর্যটন সুবিধা যুক্ত হয়।
পরিশেষে বলতে চাই, মূসাপুর ক্লোজারের পুনঃনির্মাণ কাজ বর্ষা মৌসুমের পূর্বে সম্পন্ন করার উদ্যোগ নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। এটি শুধু একটি কাঠামোগত উন্নয়ন নয়, বরং দুই জেলার লাখো মানুষের জীবনমান, অর্থনীতি এবং নিরাপত্তার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত একটি প্রয়াস। নির্মাণকাজ যথাসময়ে ও যথাযথ মানে শেষ হলে এটি হবে স্থানীয় উন্নয়নের এক যুগান্তকারী উদাহরণ। তবে, দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা এবং রক্ষণাবেক্ষণের দিকেও নজর দিতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে আর কখনো সেতু ধসের আতঙ্কে না থাকতে হয়।