ঢাকা সোমবার, ১৯ মে ২০২৫, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

বাস ও রিকশা ঢাকার রাস্তায় যানজটের মূল কারণ

মো. জাহিদ হোসেন
বাস ও রিকশা ঢাকার রাস্তায় যানজটের মূল কারণ

ঢাকা বাংলাদেশের রাজধানী হিসেবে সবচেয়ে জনবহুল শহর। প্রতিদিন লাখ লাখ মানুষ এখানে কাজের উদ্দেশ্যে আসা-যাওয়া করে। কিন্তু তারা দিনশেষে ফিরে যান অসহ্য ট্রাফিক জ্যামের দুঃখ নিয়ে।

প্রতিদিন গড়ে ১৫০০-২০০০ মানুষ ঢাকায় আসেন জীবিকার খোঁজে। এর ফলে যানজট একটি নিত্যদিনের সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঢাকার রাস্তাগুলো পরিকল্পনাহীনভাবে গড়ে উঠেছে, যা যানজটের একটি কারণ। গড়ে একজন মানুষ দিনে ২-৩ ঘণ্টা যানজটে আটকে থাকেন। অফিস, স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল কোথাও সময়মতো পৌঁছানো কঠিন। বিশেষজ্ঞদের মতে, যানজটের কারণে প্রতি বছর দেশের ৩-৫ বিলিয়ন ডলার ক্ষতি হয়।

এছাড়া কর্মঘণ্টা ও জ্বালানির অপচয় হয় বিশাল হারে। দীর্ঘসময় গাড়িতে বসে থাকার কারণে ক্লান্তি, অবসাদ এবং স্ট্রেস বেড়ে যায়। যানজটের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো বাস ও রিকশার অসংগঠিত চলাচল। একটি দেশের প্রত্যেকটি সেক্টরে আইন-কানুন প্রয়োজন হয়। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ এদেশের আইন-কানুনের ধারে কাছে তো নাই, তারা আইন অমান্য করাকে অভ্যাসে পরিণত করেছে। যেখানে শিক্ষিতরাই আইন মানতে নারাজ, সেখানে বাস ও রিকশা চালকদের থেকে আসা করাটাও বোকামি। আর এই আইন মান্য না করাটাই, আজ ঢাকা শহরের জন্য অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ঢাকায় প্রায় ৩৫-৪০টিরও বেশি বাস কোম্পানি আছে, যেগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। একাধিক বাস একই রুটে প্রতিযোগিতামূলকভাবে চলে, ফলে রাস্তায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। নির্ধারিত স্টপেজে না থেমে যত্রতত্র যাত্রী উঠানো-নামানো এমনভাবে চলছে যেন এটি কোনো দোষই নয়। বাসের নির্ধারিত স্টপেজগুলো এখন প্রায় খালিই পড়ে থাকে, স্টপেজ হিসেবে চালকরা রাস্তাকেই বেছে নিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। আর তাদের কিউ কিছু বললেও শুরু হয় ঝগড়া, বাস মাঝ রাস্তায় রেখেই ঝগড়ায় নেমে পড়তে দেখা যায়। অনেক বাস পুরাতন ও রক্ষণাবেক্ষণহীন, যা ধীরগতিতে চলে এবং রাস্তায় অকেজো হয়ে পড়ে দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি করে।

পুরোনো ও খারাপ বাস পরিবেশ দূষণ করে ও যাত্রীদের ঝুঁকিতে ফেলে। এছাড়াও অবৈধ পার্কিং (বাস, প্রাইভেট কার, ট্রাক) রাস্তায় স্থান দখল করে রাখে। অনেক পুরোনো এলাকায় (পুরান ঢাকা, মগবাজার, কলাবাগান) এখনও সরু গলি ও ভাঙা রাস্তার কারণে যান চলাচলে সমস্যা তৈরি করে।

প্রায় সারা বছর গ্যাস, পানি, ফাইবার অপটিক ক্যাবল বসানো ও মেরামতের জন্য খোঁড়াখুঁড়ি চলে। অনেক স্থানে খোঁড়াখুঁড়ির পর রাস্তা ঠিকমতো মেরামত করা হয় না, ফলে গর্ত ও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে থাকে। সঠিক নালা ও ড্রেনেজ ব্যবস্থা না থাকায় বর্ষায় অনেক রাস্তায় পানি জমে। মালিবাগ, শেওড়াপাড়া, রামপুরা, পুরান ঢাকার কিছু অংশে একটু বৃষ্টি হলেই হাঁটু পানিতে রাস্তা ডুবে যায়। মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ও বিআরটি প্রকল্পের জন্য অনেক রাস্তা এখন সংকুচিত বা আংশিক বন্ধ। উত্তরা, মিরপুর, ফার্মগেট, কারওয়ান বাজার অঞ্চলে এখন ব্যাপক যানজট তৈরি হচ্ছে। মহাখালির মতো ব্যস্ততম রাস্তায় করা হয়েছে বাসস্ট্যান্ড, আর সেখানে বাসগুলো অর্ধেক, মাঝে মাঝে পুরোটাই রাস্তা দখল করে নেয়।

যা তীব্র যানজট ও মানুষের ভোগান্তির কারণ হয়ে দাড়ায়। এছাড়াও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা ফুটপাত তো দখল করেই, রাস্তার একাংশ চলে যায় তাদের দখলে। ফুটপাত দখল হয়ে গেলে মানুষ রাস্তায় হাঁটে, এতে যান চলাচলে সমস্যা হয়। বিভিন্ন যায়গায় ফুটওভার ব্রিজ থাকলেও সেটা ব্যবহার না করে ঝুঁকিপূর্ণভাবেই রাস্তা পারাপার হতে দেখা যায় অনেককেই।

আর তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থাও নেওয়া হয় না। ঢাকায় আনুমানিক বৈধ রিকশা সংখ্যা প্রায় ১ লক্ষ, অবৈধ রিকশার সংখ্যা প্রায় ৫-৬ লাখ বা তারও বেশি। সরকারিভাবে নতুন রিকশা লাইসেন্স দেওয়া অনেক বছর আগেই বন্ধ হয়ে গেলেও, প্রশাসনের নজরদারি দুর্বল থাকায় রিকশার সংখ্যা বেড়েই চলেছে। এসব রিকশা সড়কে ধীরগতির কারণে যান চলাচলে সমস্যা সৃষ্টি করে। আধুনিক, দ্রুতগতির শহরের ধারণার সঙ্গে রিকশা-নির্ভরতা খাপ খায় না। রিকশা, ভ্যান, ঠেলাগাড়ি ইত্যাদি মূল রাস্তায় ঢুকে যানবাহনের গতি কমিয়ে দেয়। রিকশাগুলো যাত্রাবাড়ী, গুলিস্তান ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় অবাধে দাঁড়িয়ে থাকায় এসব জায়গায় বাস, ট্রাক চলাচলে বিঘ্ন ঘটে। ফলে এই জায়গাগুলোতে প্রতিনিয়ত যানজট লেগেই থাকে। রিকশা চালকরা ট্রাফিক আইন না মানায় অনেক সময় সংকট সৃষ্টি হয়।

আইন ভাঙার জন্য জরিমানা বা শাস্তি কার্যকরভাবে হয় না। বিভিন্ন ব্যস্ততম সড়কেও দেখা যায় রিকশাগুলো উল্টো রাস্তায় চলাচল করে। বাসগুলো হয়তো সরকারের অধীনে কিংবা এক ছাতার নিচে এনে একক কোম্পানির অধীনে অথবা এক রুটে এক কোম্পানির অধীনে চললে, বাস চালকদের মধ্যে প্রতিযোগিতা থাকে না এবং শৃঙ্খলা বজায় থাকে। বাসস্ট্যান্ড রাস্তায় না করে, আলাদা জায়গা করলে বিভিন্ন জায়গায় রাস্তার যানজট অনেকটাই কমে আসবে। প্রতিটি প্রধান সড়কে বাসের জন্য আলাদা লেন চালু করলে সাধারণ যানবাহনের চলাচল বাধাগ্রস্ত হবে না। রাস্তায় ফুটপাতগুলোর উপর কঠোর আইন প্রয়োগ করে হকারমুক্ত ফুটপাত নিশ্চিত করা অত্যাবশ্যক।

রিকশার লাইসেন্স প্রক্রিয়া কঠোর করা এবং নির্দিষ্ট এলাকায় রিকশা চলাচলের অনুমতি দেওয়া উচিত। বাস ও রিকশা চালকদের ট্রাফিক আইন মেনে চলার জন্য জরিমানা ও লাইসেন্স বাতিলের মতো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। রিকশার বিকল্প হিসেবে, বিশেষ করে শিক্ষার্থী ও অফিসগামীদের জন্য বাইসাইকেল সিস্টেম চালু করা যেতে পারে। ঢাকা শহরের ভেতরে ৫-১০ কিলোমিটার দূরত্বে এটি সবচেয়ে কার্যকর হবে। কম খরচে, দ্রুত এবং স্বাস্থ্যকর বিকল্প। সেক্ষেত্রে যদি আলাদা সাইকেল লেন তৈরি করা হয়, তবে রিকশার অনেকটা চাহিদা পূরণ করতে পারে। তবে রিকশা শুধু একটি পরিবহন নয়, এটি অর্থনৈতিক জীবিকার উৎসও বটে। তাই বিকল্পের পাশাপাশি রিকশাচালকদের পুনঃপ্রশিক্ষণ, নতুন পেশার ব্যবস্থা এবং ধাপে ধাপে রিকশা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। আর সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, আইনের কড়া নজরদারি। কিন্তু আমরা প্রতিনিয়ত দেখতে পাই, আইনশৃঙ্খলা কর্মীরা বিশৃঙ্খলা দেখেও নিরবতা পালন করে।

ট্রাফিক পুলিশের উপস্থিতি থাকলেও সংখ্যায় কম হওয়ায়, অনেক সময় যান নিয়ন্ত্রণ করা দুষ্কর হয়ে যায় যানবাহনের বিশৃঙ্খলার কারণে। আবার কখনও সামান্য ঘুষের বিনিময়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। আর বিপ্লবোত্তর এই সময় সাধারণ মানুষ পুলিশকে অগ্রাহ্য করে। তারা পুলিশকে তো মানেই না, উল্টো পুলিশের সঙ্গে তর্কে জড়াতেও দেখা যায়। সব ধরনের বিশৃঙ্খলার মূল কারণ হচ্ছে আইনের অপারগতা। আইনকে হতে হবে আরও কঠোর ও দুর্নীতিমুক্ত।

লেখক : গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত