ডোনাল্ড ট্রাম্প একসময় প্রচারণায় বলেছিলেন, তিনি নির্বাচিত হলে ইউক্রেন যুদ্ধ ২৪ ঘণ্টার মধ্যে থামিয়ে দেবেন। রাশিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের প্রক্সি যুদ্ধের ইতি টানার অঙ্গীকার করেছিলেন তিনি। কিন্তু জুলাইয়ের মাঝামাঝি এসে দেখা যাচ্ছে, শান্তির সেই প্রতিশ্রুতি এক নতুনরূপে উল্টো উত্তেজনা বাড়াচ্ছে। ন্যাটোর সেক্রেটারি মার্ক রুটের সঙ্গে হোয়াইট হাউসে এক যৌথ উপস্থিতিতে ট্রাম্প ঘোষণা করেছেন, রাশিয়াকে যুদ্ধবিরতিতে রাজি হওয়ার জন্য ৫০ দিনের সময় দেওয়া হচ্ছে। অন্যথায় রাশিয়ান পণ্যে আরোপিত হবে শতভাগ শুল্ক। একই সঙ্গে তিনি নিশ্চিত করেছেন, ইউক্রেনকে দেওয়া হবে যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি প্যাট্রিয়ট ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা- তবে এর খরচ বহন করবে ইউরোপ। ট্রাম্পের এই প্রস্তাব একদিকে শান্তির ইঙ্গিত, অন্যদিকে নিখুঁত চাপ প্রয়োগের কৌশল। কিন্তু মস্কোর দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টি এত সরল নয়।
রাশিয়া বহু আগেই জানিয়ে দিয়েছে, শুধু অস্ত্রবিরতির নামে ইউক্রেনকে পুনরায় সজ্জিত করার সুযোগ তারা দেবে না। তারা শান্তি চায়, তবে সেই শান্তি হতে হবে স্থায়ী, যেখানে পশ্চিমা দেশগুলো এই সংঘাতের মূল কারণগুলো সমাধান করবে- ন্যাটোর পূর্বমুখী সম্প্রসারণ, কিয়েভের ক্রমাগত অস্ত্রাগার বৃদ্ধি এবং ক্রিমিয়া ও দনবাস অঞ্চলের অবস্থান। মূল সমস্যাগুলো অমীমাংসিত রেখে যুদ্ধবিরতি মানে শুধু আরেকটি ধোঁকাবাজি- এ কথা কি অযৌক্তিক? ইতিহাস বলে, সমস্যার শিকড় অক্ষত রেখে যুদ্ধবিরতি শুধু সময় কিনে দেয়, সমাধান আনে না।
২০১৪-১৫ সালের মিনস্ক চুক্তির উদাহরণই ধরা যাক। পশ্চিমারা এটিকে শান্তির পথ হিসেবে দেখালেও বাস্তবে ইউক্রেন সেই চুক্তিকে কাজে লাগিয়েছিল সেনা পুনর্গঠন ও প্রতিরক্ষা জোরদার করার জন্য। মস্কোর দৃষ্টিতে ট্রাম্পের প্রস্তাবও একই রকম- চুক্তির আড়ালে নতুন করে পশ্চিমা পুনঃসজ্জা। তাহলে ট্রাম্প আসলে কী চাইছেন? প্রকৃত অর্থে শান্তি নয়, বরং এমন এক সাময়িক বিরতি যা পশ্চিমা প্রভাব বজায় রাখবে এবং মার্কিন অস্ত্রশিল্পকে নতুন মুনাফা এনে দেবে। যুক্তরাষ্ট্র অস্ত্র তৈরি করবে, ইউরোপ সেটির খরচ দেবে। ফলে একদিকে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি লাভবান হবে, অন্যদিকে স্থবির ইউরোপীয় অর্থনীতির উপর আরও চাপ পড়বে। যা ইউরোপকে মার্কিন নির্ভরশীলতা আরও বাড়িয়ে তুলবে। যদি সত্যিই ট্রাম্প স্থায়ী সমাধান চাইতেন, তবে রাশিয়ার নিরাপত্তা উদ্বেগ, ইউক্রেনের নিরপেক্ষতার প্রশ্ন এবং বিতর্কিত অঞ্চলগুলোর ভবিষ্যৎ নিয়ে সরাসরি আলোচনায় যেতেন। পরিবর্তে তিনি বেছে নিয়েছেন শাস্তিমূলক শুল্কের হুমকি যা ক্রেমলিনকে প্রভাবিত করার চেয়ে তার অবস্থান আরও কঠোর করবে।
ট্রাম্পের এই দ্বৈত কৌশলের ইতিহাস নতুন নয়। তিনি ইরানের ব্যাপারেও একই রকম পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। পারমাণবিক চুক্তি বাতিল করলেন, সর্বোচ্চ চাপের নিষেধাজ্ঞা দিলেন, তারপর বললেন ‘ভালো শর্তে’ আবার আলোচনায় ফিরবেন। ফল কী হলো? তেহরান তার আঞ্চলিক জোট আরও শক্ত করল, ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি এগিয়ে নিল এবং ডলারনির্ভরতা কমিয়ে মস্কো-বেইজিংয়ের দিকে ঝুঁকল। যুক্তরাষ্ট্রের চাপে ইরান নত হয়নি; বরং আরও বিকল্প পথ বের করে নিয়েছে।
রাশিয়ার ক্ষেত্রেও একই ফল হতে পারে। রাশিয়ার তেল ও গ্যাস কিনছে এমন দেশগুলোর- চীন, ভারত, ব্রাজিল- উপর যদি ট্রাম্প নতুন করে দ্বিতীয় পর্যায়ের শুল্ক চাপান, তবে বৈশ্বিক অর্থনীতির যে বিভাজন চলছে তা আরও গভীর হবে। পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার বাইরে থাকা এক নতুন বাণিজ্য নেটওয়ার্কে মস্কোর অবস্থান আরও মজবুত হবে। এমনকি রাশিয়ার বাজারও এই বাস্তবতা বুঝেছে। ট্রাম্পের ঘোষণা পর রাশিয়ার শেয়ারবাজার ২ শতাংশ বেড়েছে। কারণ বিনিয়োগকারীরা বুঝেছেন, লিন্ডসে গ্রাহামের প্রস্তাবিত ৫০০ শতাংশ শুল্কের ভয়াবহ হুমকি শেষ পর্যন্ত কমে দাঁড়িয়েছে প্রতীকী ১০০ শতাংশে। ফলে তাৎক্ষণিক উত্তেজনা না বাড়িয়ে বরং রাশিয়ার জন্য সময় কিনে দিল এই ৫০ দিনের সময়সীমা।
কিন্তু প্রতীকী পদক্ষেপেরও বিপদ আছে। যুদ্ধকে যখন শুধু দরকষাকষির হাতিয়ার বানানো হয়- একদিকে ইউরোপের উপর চাপ, অন্যদিকে মার্কিন অর্থনীতির লাভ- তখন ইউক্রেন আরও বড় পুতুলে পরিণত হলো। প্যাট্রিয়ট ক্ষেপণাস্ত্র ও নতুন অস্ত্র আসলে কিয়েভকে কিছুটা সাহস যোগাবে; কিন্তু যুদ্ধ থামাবে না; বরং ভোগান্তি দীর্ঘ করবে। অধিকন্তু, ইউরোপকে দিয়ে এই বিল মেটানো আসলে ইউরোপের উপর যুক্তরাষ্ট্রের নির্ভরতা আরও বাড়ানোর কৌশল। ট্রাম্প আগেও ন্যাটো ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের উপর তাদের ‘অতিরিক্ত নির্ভরতা’ নিয়ে সমালোচনা করেছেন। এবারও তিনি দেখাচ্ছেন, ইউরোপ দুর্বল; নিরাপত্তার জন্য তাকে যুক্তরাষ্ট্রের হাতেই ভরসা রাখতে হবে এবং এর বিনিময়ে খরচ করতে হবে।
রাশিয়ার দিকে তাকালে দেখা যায়, ট্রাম্প সমালোচকরা যেমন তীব্র ভাষায় আক্রমণের আশা করেছিল, তা তিনি করেননি। পুতিনকে যুদ্ধাপরাধী বলেননি, শাসন পরিবর্তনের ডাক দেননি, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রে রাশিয়ার সম্পদ বাজেয়াপ্ত করারও হুমকি দেননি। মস্কোকে এখনও ট্রাম্প চূড়ান্ত শত্রু নয়, বরং একজন দরকষাকষির প্রতিপক্ষ হিসেবে দেখেন। যাকে চাপ দিতে হবে; কিন্তু অপমান নয়। এখানেই এক ধরনের বাস্তবতা লুকিয়ে আছে। ওয়াশিংটনও জানে, রাশিয়াকে জোর করে দমন করা সম্ভব নয়। দুই বছরের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও তারা যুদ্ধকালীন অর্থনীতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়েছে, গ্লোবাল সাউথের সমর্থন ধরে রেখেছে। রাশিয়াকে কোণঠাসা করলে উল্টো সেটি বিপজ্জনক মাত্রায় বিস্ফোরিত হতে পারে যা ইউরোপ বা যুক্তরাষ্ট্র কেউই সামলাতে পারবে না।
উল্টো ক্রেমলিন জানে, সময় তাদের পক্ষে। ট্রাম্পের দেওয়া এই ৫০ দিনের সময়সীমা মিলে যাচ্ছে সেই গুঞ্জনের সঙ্গে যেখানে রাশিয়া আগামী দুই মাসে খেরসন, জাপোরিঝঝিয়া ও দনবাস অঞ্চলে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার বড় আক্রমণ চালাবে। সেপ্টেম্বরে এসে মস্কো আরও শক্ত অবস্থানে যেতে পারে। ফলে ট্রাম্পের হুমকি উল্টো রাশিয়াকে সামরিক অভিযান ত্বরান্বিত করতে উৎসাহিত করতে পারে।
ইতিহাস এখানেও শিক্ষা দেয়। ১৯৩৯ সালে ব্রিটেন ও ফ্রান্স যখন জার্মানিকে আল্টিমেটাম দিয়েছিল, ভেবেছিল চাপেই হিটলার থেমে যাবে। বরং সে আরও দৃঢ় হলো, আর ইউরোপ নিমজ্জিত হলো ভয়াবহ যুদ্ধে। প্রতিপক্ষের মূল কৌশলগত স্বার্থ উপেক্ষা করে দেওয়া আল্টিমেটাম খুব কম ক্ষেত্রেই সফল হয়। তাহলে ট্রাম্পের এই পদক্ষেপ কি শান্তির চেষ্টা? না, বরং এটি এক ধরনের কৌশলগত বিরতি, যা মার্কিন অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষার জন্য। তিনি ভোটারদের বলতে পারবেন, তিনি রাশিয়ার বিরুদ্ধে কঠোর। ন্যাটো মিত্রদের দেখাতে পারবেন, তিনি নিরাপত্তায় অঙ্গীকারবদ্ধ। আর অস্ত্রশিল্পকে নিশ্চয়তা দিতে পারবেন, নতুন অর্ডার আসছে। এক কথায়, সবাই খুশি- শুধু ইউক্রেনীয়রা ছাড়া, যারা এই খেলায় বলির পাঁঠা।
গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি দিক হলো- মার্কিন সাংবিধানিক মানদ-ের অবক্ষয়। ট্রাম্পকে যখন জিজ্ঞেস করা হলো, শুল্ক আরোপে কংগ্রেসের অনুমোদন দরকার কি না, তিনি বললেন, ‘আমার মনে হয় না আমাদের তাদের দরকার।’ ইরানের ওপর হামলার সময়ও তিনি একই যুক্তি দিয়েছিলেন। যুদ্ধ ও শান্তির প্রশ্নে নির্বাহী ক্ষমতার এই অবারিত সম্প্রসারণ এখন ওয়াশিংটনের দুই দলের কাছেই স্বাভাবিক হয়ে গেছে।
তাহলে আমরা কোথায় দাঁড়ালাম? দুই বছর ধরে এই যুদ্ধ যেমন এক অনিশ্চয়তার ধূসর এলাকায় আটকে আছে, ট্রাম্পের লেনদেনমুখী কৌশলও ঠিক তেমনই অস্থায়ী। এটি হয়তো সাময়িক উত্তেজনা কমাবে; কিন্তু স্থায়ী সমাধান আনবে না। এটি ন্যাটো ও মার্কিন অস্ত্রশিল্পকে সময় কিনে দেবে; কিন্তু মস্কোকে সমঝোতায় রাজি করাবে না; কিয়েভকে দেবে মিথ্যা আশার সান্ত¡না।
রাশিয়ার কাছে এই সংঘাত শুধু ভূখণ্ড নয়, ইউরোপীয় নিরাপত্তা কাঠামোর ভবিষ্যৎ। পশ্চিম যদি এই বাস্তবতা স্বীকার না করে, তবে কোনো শর্তসাপেক্ষ যুদ্ধবিরতি, শুল্ক কিংবা প্যাট্রিয়ট ক্ষেপণাস্ত্র- কিছুই সমাধান আনতে পারবে না। ট্রাম্পের ৫০ দিনের ‘জুয়া’ শান্তি আনার জন্য নয়; এটি সেই যুদ্ধের ব্যবস্থাপনার কৌশল, যেটি যুক্তরাষ্ট্র জিততে পারবে না এবং থামানোর সাহসও নেই।
লেখক : রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক