ঢাকা সোমবার, ২৮ জুলাই ২০২৫, ১৩ শ্রাবণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

শরিয়াহ ও গণতন্ত্র : উপমহাদেশের রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব

এমএ হোসাইন
শরিয়াহ ও গণতন্ত্র : উপমহাদেশের রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব

ভারতীয় উপমহাদেশে রাজনৈতিক ইসলামী দলগুলোর বাস্তবতা নিয়ে বিতর্ক নতুন কিছু নয়। উপমহাদেশের মুসলিম সমাজে শরিয়াহভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার দাবি শতাব্দী ধরে শোনা যাচ্ছে, কিন্তু বাস্তব প্রয়োগে এটি সবসময়ই অস্পষ্ট থেকে গেছে। কারণ, ইসলামের নামে রাজনীতি করা দলগুলো প্রায়শই শরিয়াহর প্রকৃত কাঠামো ও বাস্তবায়নপদ্ধতি স্পষ্টভাবে তুলে ধরতে ব্যর্থ হয়েছে, কিংবা ইচ্ছাকৃতভাবে সাধারণ মানুষের সামনে তা অস্পষ্ট রেখেছে। ফলস্বরূপ, শরিয়াহ আজ উপমহাদেশে একদিকে রাজনৈতিক স্লোগান, অন্যদিকে ভোটের রাজনীতিতে জনমত প্রভাবিত করার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

শরিয়া আইন মূলত আল কোরআন ও যার উপর এই কিতাব নাজিল হয়েছিল সেই নবী মোহাম্মদ মোস্তফা (সা.) এর নির্দেশিত পন্থায় সমগ্র মানবজাতির জন্য ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয়, আন্তর্জাতিক ও ধর্মীয় অনুশাসন পদ্ধতি। এই পদ্ধতি কেবল শুধু মুসলমানদের জন্য নয় বরং তা ইসলামিক রাষ্ট্রের অমুসলিমদেরও জন্য প্রযোজ্য যেখানে অমুসলিমদের ধর্মীয় স্বাধীনতা, জানমাল, এবং তাদের সম্মানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: ‘যে ব্যক্তি কোনো মু’আহিদ (চুক্তিবদ্ধ অমুসলিম/জিম্মি) এর প্রতি জুলুম করবে, অথবা তার অধিকার হরণ করবে, অথবা তার সাধ্যের অতিরিক্ত কিছু চাপিয়ে দেবে, অথবা তার কাছ থেকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু নেবে আমি কিয়ামতের দিন তার বিরোধী হব।’-(সুনান আবু দাউদ, হাদিস ৩০৫২)

অনেকেই শরিয়াহ শাসনব্যবস্থাকে একদলীয় একনায়কতন্ত্রের সঙ্গে তুলনা করেন। কিন্তু এটি একদলীয় স্বৈরতন্ত্র নয়, বরং ন্যায়ের ওপর প্রতিষ্ঠিত শাসনব্যবস্থা যেখানে শাসক সাধারণ নাগরিকের কাছে সরাসরি জবাবদিহি করতে বাধ্য। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর যুগ ও তার পরবর্তীতে খুলাফায়ে রাশিদিনের সময়ে একজন সাধারণ বেদুইনও শাসকের কাছে সরাসরি প্রশ্ন তুলতে পারতেন, কোনো আমলাতান্ত্রিক দেয়ালের আড়ালে থেকে নয়। কিন্তু আজকের গণতান্ত্রিক বা অন্যান্য রাষ্ট্র ব্যবস্থায় একজন সাধারণ নাগরিক কি রাষ্ট্রপ্রধানের কাছে সরাসরি জবাবদিহি চাইতে পারে? পারে না।

শরিয়াহ শাসনব্যবস্থা মূলত ক্ষমতার উৎসকে আল্লাহর বিধান দ্বারা সীমাবদ্ধ করে দেয়, সংখ্যাগরিষ্ঠতার মতামত কিংবা শাসকের খেয়াল-খুশির কোনো মূল্য নেই। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর যদি তুমি পৃথিবীতে অধিকাংশ মানুষের কথা মেনে চলো, তবে তারা তোমাকে আল্লাহর পথ থেকে বিপথে নিয়ে যাবে। তারা তো কেবল অনুমান ও ধারণার অনুসরণ করে এবং তারা তো শুধু মিথ্যা বলে।’ (আনআম -১১৬)। রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব মুসলিম ও অমুসলিম সবার কল্যাণ শরিয়াহ মোতাবেক নিশ্চিত করা। জনগণ নিজ মতামতের ভিত্তিতে সরকার গঠন নয়, কেবল শরিয়াহর প্রতি আনুগত্যে বাধ্য। যদি রাষ্ট্রপ্রধান ইসলামী আইনবিরোধী কিছু করেন, জনগণ তা মানবে না এবং শূরার সদস্যরা যারা শরিয়াহ বিষয়ে পারদর্শী তাকে অপসারণের পদক্ষেপ নিতে পারবেন। গণতান্ত্রিক সংসদ সদস্যদের মতো শূরা সদস্যরা আইন প্রণয়ন করে না; তারা শুধু রাষ্ট্রপ্রধানকে শরীয়াহ মোতাবেক পরামর্শ দেয়। রাষ্ট্রপ্রধান নিজেও একজন উচ্চতর ফকিহ হবেন এবং প্রয়োজনে যোগ্য ব্যক্তিদের শূরায় অন্তর্ভুক্ত করতে পারবেন। শূরা সদস্যরা মূলত জনগণের সঙ্গে সংযুক্ত বিপ্লবী মুসলমান সমাজের প্রতিনিধি। রাষ্ট্রপ্রধান মৃত্যুবরণ করলে, অক্ষম হলে বা বিচারকের মাধ্যমে তাকে অপসারিত হলে নতুন নিয়োগ হবে। এভাবেই শরিয়াহ শাসনে ন্যায়, কল্যাণ ও জবাবদিহি নিশ্চিত হয়।

তাহলে মুসলিম রাষ্ট্রগুলো কেন শরিয়াহ থেকে সরে গেল? এর উত্তর ইতিহাসে লুকিয়ে আছে। খুলাফায়ে রাশিদিনের পর খেলাফতের পতন ঘটে ক্ষমতার লোভ, বংশানুক্রমিক শাসন ও ইসলামী আদর্শ থেকে বিচ্যুতির কারণে। তাছাড়া, উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ মুসলিম বিশ্বকে শুধু অর্থনৈতিকভাবে নয়, আদর্শগতভাবেও দুর্বল করে দেয়। ষোড়শ শতকে ইউরোপীয় খ্রিস্টান সাম্রাজ্যবাদ খেলাফতকে দুর্বল করে, আর উনবিংশ শতকে সমাজতন্ত্র-গণতন্ত্রের প্রভাবে শরীয়াহ আইনে অযোগ্য মুসলিম শাসকেরা শরিয়াহর বিপক্ষে অবস্থান নেয়। যদিও ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে শরিয়াহ প্রতিষ্ঠার জন্য ব্যক্তি কেন্দ্রিক কিছু প্রচেষ্টা হয়েছিল। পরবর্তীতে, ব্রিটিশরা মুসলমানদের বিভক্ত করে গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে প্রলুব্ধ করে সেই আন্দোলন ভিন্ন পথে প্রবাহিত করে। আজকের ইসলামী দলগুলোর ভ্রান্তিও সেই ইতিহাসেরই পুনরাবৃত্তি।

আজ যারা উপমহাদেশে শরিয়াহ প্রতিষ্ঠার কথা বলেন, তাদের পদ্ধতিও ইসলামী আদর্শের বিপরীত। গণতান্ত্রিক নির্বাচনে অংশ নিয়ে শরিয়াহ প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার আসলে ইসলামী দৃষ্টিতে ভ্রান্ত মতবাদ। ইসলামে আইন প্রণয়নের ক্ষমতা শুধু আল্লাহর, সংখ্যাগরিষ্ঠের নয়। তাই গণতান্ত্রিক সংসদকে মজলিসে শূরা বলার কোনো সুযোগ নেই। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন তা দিয়ে বিচার করে না, তারাই কাফির।’- (সূরা মায়েদা, আয়াত ৪৪) অথবা ‘কোনো মুমিন পুরুষ বা নারী যখন আল্লাহ ও তার রাসূল কোনো বিষয়ে ফয়সালা করে দেন, তখন তাদের আর কোনো বিকল্প মতামতের অধিকার নেই।’- (সূরা আহযাব, আয়াত ৩৬)।

বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের ইসলামী দলগুলো মূলত ভোটের রাজনীতিতে শরিয়াহকে ব্যবহার করছে। উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামী ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত দলের ন্যূনতম পদে নির্বাচনের ক্ষেত্রে সুদে জড়িত ব্যক্তি, সুদে ব্যাংক ঋণ নেওয়া ব্যক্তি, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আইন পেশায় যুক্ত ব্যক্তি, দাড়ি মুড়ানো, টাখনুর নিচে কাপড় পরা, পর্দাশিথিল পরিবার বা টেলিভিশন থাকা পরিবারের ব্যক্তিকে অযোগ্য ঘোষণা করত। অথচ আজ দলটি ইসলামিক আদর্শ থেকে দূরে সরে একটি প্রচলিত গণতান্ত্রিক দল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। দুঃখজনকভাবে তারা হয় বুঝে বা না বুঝে শরিয়া প্রতিষ্ঠার কথা বলে, সেটিও আবার গণতান্ত্রিক ধারায়। আজ বাংলাদেশে পরিসংখ্যানগতভাবে জামায়াতের সদস্যদের আইন পেশায় উল্লেখযোগ্য শক্তিশালী অবস্থান দেখা যায়।

বাংলাদেশের তথাকথিত অন্যান্য রাজনৈতিক ইসলামী দলগুলোর অবস্থাও একই। ভারতের অল ইন্ডিয়া মজলিসে ইত্তেহাদুল মুসলিমিন, ইন্ডিয়ান ইউনিয়ন মুসলিম লীগ বা পাকিস্তানের জামায়াতে ইসলামী কিংবা জমিয়াতে উলামায়ে ইসলামও একই পথে গণতন্ত্রের ভেতরে থেকে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবি। এই রাজনৈতিক দলগুলো সাধারণ মুসলমানদের ভোট টানতে ইসলামের নাম ব্যবহার করে এবং গণতান্ত্রিক নির্বাচনে অংশ নেয়।

ইতিহাস প্রমাণ করে, ইসলামিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা কেবল বিপ্লবের মাধ্যমেই সম্ভব। রাসুলুল্লাহ (সা.) মক্কায় ১৩ বছর আদর্শিক সংগ্রামের পর মদিনায় নতুন সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। প্রথম খলিফা হজরত আবু বকরের একক স্বীদ্ধান্তে হজরত উমর (রা.) বা উসমান (রা.) ক্ষমতায় আসেন শূরার সম্মতিতে, কোনো গণতান্ত্রিক ভোটাভুটিতে নয়। উপমহাদেশের বাস্তব উদাহরণ হলো পাকিস্তান ১৯৪৭ সালে বিপ্লব ছাড়া শরিয়াহভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল, কিন্তু তা সফল হয়নি এবং তাতে সুন্নাহর প্রতিফলনও ছিলো না।

ইসলামে রাষ্ট্রপ্রধান হতে হলে ফকিহ হতে হবে অর্থাৎ ইসলামী আইন সম্পর্কে উচ্চতর জ্ঞান থাকতে হবে। কিন্তু আজকের রাজনৈতিক ইসলামী দলগুলোর নেতৃত্বে কতজন প্রকৃত মুফতি বা ফিকাহবিদ আছেন? প্রায় নেই বললেই চলে। তাদের কাঠামো পশ্চিমা গণতান্ত্রিক দলগুলোর মতো কেন্দ্রীয় কমিটি, আঞ্চলিক কমিটি, নির্বাচনি প্রচারণা সবই আমদানি করা পদ্ধতি। ফলে তারা ক্ষমতায় গেলেও ইসলামী শরিয়াহর সঙ্গে তাদের কোনো বাস্তব সম্পৃক্ততা বা সক্ষমতা থাকতে পারে না। অন্যদিকে যেসব ইসলামিক সংগঠন বিপ্লবের মাধ্যমে শরিয়াহ প্রতিষ্ঠার কথা বলে, তাদেরও প্রয়োজনীয় যোগ্য জনশক্তি ও সাংগঠনিক কাঠামো নেই। রাসুলুল্লাহ (সা.) মক্কায় ১৩ বছর ধরে আদর্শিক ভিত্তি তৈরি করেছিলেন; আজকের ইসলামী আন্দোলনগুলো কি সেই প্রস্তুতি নিচ্ছে? না, তারা বরং ভোটব্যাংকের রাজনীতিতে মগ্ন।

উপমহাদেশে পাকিস্তানে আংশিক অঞ্চল নিয়ে শরিয়াহ আইন প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা তুলনামূলক বেশি। আফগান সীমান্তবর্তী অঞ্চলে শরিয়াহভিত্তিক প্রশাসনিক কাঠামো গঠনের চেষ্টা হচ্ছে, কিন্তু ঐক্যের অভাবে পূর্ণাঙ্গ রূপ নিতে পারেছে না।

বাংলাদেশ বা ভারতে এরকম সম্ভাবনা আরও কম, কারণ সমাজ কাঠামো ও রাজনৈতিক বাস্তবতা মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও আদর্শিকভাবে বিভ্রান্ত। তাহলে উপমহাদেশে শরিয়াহ প্রতিষ্ঠার বাস্তবতা কী? অসম্ভব নয়, তবে আপাতত তা সম্ভব হচ্ছে না কারণ মুসলমানদের প্রস্তুতি নেই, নেতৃত্বে নেই যোগ্য ফকিহ, বৃহত্তর দলগুলোর আন্দোলনে নেই সুন্নাহভিত্তিক বিপ্লবী দিকনির্দেশনা। আর যে দলগুলো সুন্নাহ অনুযায়ী চেষ্টা করছে, তাদের রয়েছে যোগ্য জনবলের সংকট। তবে প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকলে একদিন বিপ্লবী প্রজন্মের মধ্য থেকে প্রকৃত নেতৃত্ব আসতে পারে। পাকিস্তান হয়তো আংশিক অঞ্চল থেকে শুরু করবে, তারপর ধীরে ধীরে বিস্তৃত হবে।

কিন্তু একটি বিষয় পরিষ্কার গণতান্ত্রিক পথ ধরে শরিয়াহ প্রতিষ্ঠার পদ্ধতি একটি অনৈসলামিক ও ভ্রান্ত ধারণা। যতদিন মুসলমানরা আদর্শিকভাবে প্রস্তুত না হবে, নেতৃত্বে প্রকৃত ইসলামী স্কলারদের জায়গা না হবে, ততদিন উপমহাদেশে শরিয়াহ প্রতিষ্ঠা কেবল রাজনৈতিক স্লোগান হয়েই থাকবে। ইসলামের নাম ব্যবহার করে গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে লাভবান হওয়া দলগুলো জনগণকে বিভ্রান্তই করতে পারবে, কিন্তু তারা কখনও রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ন্যায়ভিত্তিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে পারবে না। ইসলামী শরিয়াহ কোনো দলীয় ক্ষমতার খেলা নয়; এটি আল্লাহর বিধানমতে কল্যাণ ও ন্যায়ের রাষ্ট্রব্যবস্থা। এর প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন আদর্শিক বিপ্লব, সঠিক নেতৃত্ব ও মুসলিম উম্মাহর প্রস্তুতি যা এখনও উপমহাদেশে অনুপস্থিত।

লেখক : রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত