সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এক অস্বস্তিকর প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। দেশের প্রশাসনিক প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়কে বারবার টার্গেট করা হচ্ছে। এই গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রটিই বারবার হামলার শিকার হচ্ছে। এই প্রবণতা শুধু রাষ্ট্রীয় অবকাঠামোর প্রতি এক ধরনের অবজ্ঞাই নয়, বরং এটি সুপরিকল্পিতভাবে দেশের স্থিতিশীলতা বিনষ্ট করার ষড়যন্ত্রেরই অংশ। গণঅব্যুত্থানে পালিয়ে যাওয়া স্বৈরাচার হাসিনা সরকারকে আবার ফিরিয়ে আনার প্রয়াস মাত্র।
কখনও রিকশা-ভ্যানচালক, কখনও শিক্ষার্থী আবার কখনও চাকরিচ্যুত বিডিয়ার সদস্য কিংবা পেশাজীবীদের নামে শুরু হওয়া এসব আন্দোলনের আড়ালে বারবার এই রাষ্ট্রীয় কেন্দ্রটিকে লক্ষ্যবস্তু করা হচ্ছে। এগুলো মনে হতে পারে জনসম্পৃক্ত দাবি দাওয়া। কিন্তু গভীরে গিয়ে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এই হামলাগুলোর পেছনে রয়েছে একটি সুগভীর রাজনৈতিক উদ্দেশ্য। যা নিছক প্রতিবাদ নয়, বরং গভীর রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রেরই অংশ। বর্তমান গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ব্যাহত করে আবারও স্বৈরাচারী শক্তিকে ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনার চেষ্টা।
এই হামলাগুলোর নেপথ্যে রয়েছে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য। সরকারবিরোধী একটি সংগঠিত চক্র দীর্ঘদিন ধরেই এমন অস্থিরতা তৈরির অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তারা জানে, সরাসরি সরকার পতনের মতো জনসমর্থন তাদের নেই। তাই তারা প্রশাসনিক দুর্বলতা তৈরি করেই সুবিধা নিতে চায়। সচিবালয়কে টার্গেট করার মাধ্যমে তারা চায় সরকারের প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ ও সক্ষমতা নিয়ে জনগণের মধ্যে সন্দেহ ও ভীতি সৃষ্টি করতে। এতে একদিকে জনমনে সরকারের প্রতি অনাস্থা তৈরি হয়, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক মহলেও দেশের স্থিতিশীলতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে।
আরেকটি বড় কারণ হলো, সচিবালয়ের ভেতরে বিপুল পরিমাণ গোপন নথি, নীতিমালার খসড়া ও চলমান প্রশাসনিক পরিকল্পনা থাকে যা রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক স্বার্থের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। কোনো হামলার সময় যদি এসব তথ্য বিনষ্ট বা বাইরে ছড়িয়ে দেওয়া যায়, তাহলে তা সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলার পাশাপাশি জাতীয় নিরাপত্তাকেও হুমকির মুখে ফেলতে পারে। অনেকেই বিশ্বাস করে, এসব হামলা শুধু প্রতীকী আঘাত নয়, বরং তা রাষ্ট্রের হৃৎপিণ্ডে সরাসরি ছুরি চালানোর সমান- যার পেছনে দেশি-বিদেশি স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর মদদও থাকতে পারে।
সাম্প্রতিক সময়ে সচিবালয়ে যেসব হামলা সংঘটিত হয়েছে, তা শুধু প্রতিবাদ বা ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ নয়, বরং পরিকল্পিত রাজনৈতিক কৌশল। জাতীয় গণমাধ্যমগুলোতে প্রকাশিত বিভিন্ন খবরের সূত্রে দেখা গেছে-২০২৪ সালের মাঝামাঝি সময় কিছু পরিবহন শ্রমিক সংগঠনের নাম ব্যবহার করে একটি দল সচিবালয় চত্বরে প্রবেশ করে। তারা শুধু স্লোগান দিয়েই থেমে থাকেনি; গুরুত্বপূর্ণ ভবনের কাচ ভেঙে ফেলে, নিরাপত্তা চৌকিতে অগ্নিসংযোগ করে এবং সরকারি দপ্তরের নথিপত্র নষ্ট করে। একই বছরের শেষের দিকে, শিক্ষার্থীদের একটি অংশের আন্দোলনের আড়ালে কিছু মুখোশধারী ব্যক্তি ঢুকে পড়ে সচিবালয়ে হামলা চালায়। পরবর্তীতে গোয়েন্দা সংস্থার তদন্তে উঠে আসে- এই হামলাকারীদের অনেকেই রাজনীতি সংশ্লিষ্ট এবং সরকারবিরোধী অপতৎপরতায় লিপ্ত। ২০২৫ সালের শুরুতে, একটি পেশাজীবী সংগঠনের ব্যানারে বিক্ষোভের নামে সচিবালয় চত্বরে ফের হামলার ঘটনা ঘটে। এবার হামলাকারীরা শুধু ভবন ভাঙচুরেই থেমে থাকেনি, গুলি পর্যন্ত চালায়- যা ছিল নজিরবিহীন।
যারা সচিবালয়ে হামলা চালায়, তারা শুধু একটি দপ্তর নয়, বরং পুরো রাষ্ট্রব্যবস্থার ওপর আঘাত হানতে চায়। সচিবালয় হলো প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের কেন্দ্রবিন্দু। এটি অচল হলে রাষ্ট্রযন্ত্র কার্যত থেমে যাবে। আর এটাই চায় একটি চিহ্নিত গোষ্ঠী- যারা বর্তমান গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে সাবেক স্বৈরাচারী শাসককে ফিরিয়ে আনতে চায়।
এই সরকারবিরোধীরা জনসাধারণের অসন্তোষকে পুঁজি করে, কখনও সত্য-মিথ্যার মিশেলে উত্তেজনা সৃষ্টি করে এবং পরে সেখান থেকে সৃষ্ট জনজোয়ারকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করে। তাদের লক্ষ্য স্পষ্ট- রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে একটি অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করা, যেন তারা সুযোগ পায় পুনরায় ক্ষমতায় ফিরে আসার। সচিবালয়ের ভেতরে দেখলাম, ‘বারবার দরকার, শেখ হাসিনা সরকার’ স্লোগান দিতেও ওরা কার্পণ্য করেনি। অথচ গণতন্ত্রকামী এক ঝাঁক আপামর জনসাধারণের জীবনের বিনিময়ে ওই স্বৈরাচার সরকারকে বিতাড়ন করা হয়েছিল।
সচিবালয়ে হামলার আড়ালে রয়েছে একটি সুগঠিত রাজনৈতিক কূটকৌশল। এই গোষ্ঠী চায় দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টি করে জনগণের মধ্যে সরকারবিরোধী মনোভাব জাগিয়ে তুলতে। তারা সচেতনভাবে গুজব ছড়ায়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে উত্তেজনা তৈরি করে এবং তারপর সেই জনমতকে রাজনৈতিকভাবে কাজে লাগাতে চায়।
তাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো- অস্থিতিশীলতার সুযোগ নিয়ে সাবেক স্বৈরাচারী সরকার বা তাদের প্রতিনিধিদের আবার ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনা। তারা জানে, প্রশাসনের কেন্দ্র যদি বিপর্যস্ত হয়, তাহলে পুরো রাষ্ট্রযন্ত্রই দুর্বল হয়ে পড়বে। আর এই দুর্বলতার সুযোগেই তারা ফায়দা লুটবে।
সচিবালয়ের মতো সর্বোচ্চ নিরাপত্তা বলয়ের অভ্যন্তরে একের পর এক হামলা সংঘটিত হওয়া গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কার্যকারিতা নিয়েও বড় প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। হামলাগুলো যেভাবে সংগঠিত হয়েছে- তা স্পষ্ট করে যে, হামলাকারীরা দীর্ঘদিন ধরে পরিকল্পনা করেছে এবং তারা জানত কোথায় কোন ঘাটতি রয়েছে। অথচ সময়মতো গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ, আগাম সতর্কতা ও পর্যাপ্ত প্রস্তুতি থাকলে এ ধরনের হামলা রোধ করা সম্ভব হতো। এতে বোঝা যায়, আমাদের গোয়েন্দা ব্যবস্থায় একটি স্পষ্ট দুর্বলতা রয়েছে- নতুন ধরনের ষড়যন্ত্র শনাক্তে সক্ষমতা, মাঠপর্যায়ের তথ্য যাচাই এবং ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় নজরদারির ঘাটতি রয়েছে। এই ব্যর্থতা শুধু সচিবালয়ের নিরাপত্তাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে না, বরং গোটা রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থার প্রতি জনগণের আস্থাকে নড়বড়ে করে তোলে। এখন সময় এসেছে গোয়েন্দা তৎপরতার ধরন, সক্ষমতা এবং কৌশলগত কাঠামো নতুন করে পুনর্মূল্যায়নের।
এই পরিস্থিতিতে দেশের সচেতন নাগরিক সমাজ, নিরাপত্তা বাহিনী ও রাজনৈতিক নেতৃত্বকে সতর্ক ও দায়িত্বশীল হতে হবে। সরকারকে তথ্যপ্রযুক্তি ও গোয়েন্দা নজরদারি আরও জোরদার করতে হবে। সচিবালয় ও এর আশপাশে নিরাপত্তা বেষ্টনী এমনভাবে গড়ে তুলতে হবে, যাতে যে কোনো ধরনের অনুপ্রবেশ আগেই রোধ করা যায়। একইসঙ্গে, সাধারণ মানুষের অসন্তোষ বা প্রকৃত দাবি-দাওয়াকে গুরুত্ব দিয়ে সমাধানের উদ্যোগ নিতে হবে, যাতে সরকারবিরোধী শক্তিগুলো এদের ব্যবহার করে অরাজকতা সৃষ্টি করতে না পারে। সত্যিকারের জনদাবিকে গুরুত্ব দিয়ে সেগুলোর সমাধানে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে, যেন আন্দোলনের নামে কেউ সুযোগ নিতে না পারে। জনগণকেও সচেতন হতে হবে- কারা প্রকৃত আন্দোলনকারী, আর কারা ষড়যন্ত্রকারী।
সচিবালয়ে বারবার এই আক্রমণ একটি নিছক বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয় বরং এটি একটি সুগঠিত ষড়যন্ত্রের অংশ। আমাদের স্বাধীনতা, উন্নয়ন ও গণতন্ত্রের ভিত্তির উপর আঘাত। যারা বারবার এই কেন্দ্রকে টার্গেট করছে, তারা চায় দেশে এক ধরনের নৈরাজ্য সৃষ্টি হোক যার সুযোগে তারা আবার ক্ষমতায় ফেরার স্বপ্নে মশগুল। যারা রাষ্ট্রযন্ত্রকে ধ্বংস করে ফায়দা লুটতে চায়, তাদের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক ও আইনিপন্থায় প্রতিরোধ গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি। অন্যথায়, আমাদের অর্জিত উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতা ধূলিসাৎ হতে সময় লাগবে না। এখনই সময় রাষ্ট্র, সরকার এবং জনগণ মিলে এই ষড়যন্ত্রের দাঁতভাঙা জবাব দেওয়ার। এটি শুধু একটি দপ্তর নয়, এটি রাষ্ট্রের হৃদস্পন্দন এই হৃদয়ে আঘাত মানেই জাতির অস্তিত্বের ওপর আঘাত। এটি একটি জাতির অঙ্গীকার- সেই অঙ্গীকার রক্ষায় আমাদের সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।
লেখক : সাংবাদিক, লন্ডন, যুক্তরাজ্য