ঢাকা শুক্রবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ২০ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

সময় সচেতনতা : বাঙালির ঘড়ির কাঁটা কি পিছিয়ে

মো. শামীম মিয়া
সময় সচেতনতা : বাঙালির ঘড়ির কাঁটা কি পিছিয়ে

‘সময় কারও জন্য অপেক্ষা করে না’- এই আপ্তবাক্যটি আমরা সকলেই জানি; কিন্তু কয়জনেই বা তা মেনে চলি? সময়ের মূল্য যারা বোঝে না, তাদের জীবন এক পর্যায়ে দাঁড়িয়ে পড়ে- অচল, স্থবির, আর সেখান থেকে উত্তরণও কঠিন হয়ে যায়। দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের বাঙালি সমাজে সময়জ্ঞান যেন একটি বিলাসিতা, প্রয়োজনীয় কোনো গুণ নয়। শৈশব থেকে আমাদের শিক্ষা দেওয়া হয়, ‘সময়মতো স্কুলে যাওয়া শেখো’, ‘পড়ার সময় পড়া, খেলার সময় খেলা’- কিন্তু বাস্তব জীবনে এসে দেখা যায় ঠিক তার উল্টো চিত্র।

অফিসে বস আসেন এক ঘণ্টা দেরিতে, কর্মীরা ঢোকেন আরও পরে। কোনো মিটিংয়ের সময় নির্ধারণ করা হয় বেলা ১১টা, অথচ কেউ পৌঁছান ১১:৪৫-এ, কেউ ১২টায়। এতে সময়ের অপচয় হয়, কাজের গতি হারায়, আর উন্নয়নের চাকা থমকে দাঁড়ায়। বাঙালির সময়জ্ঞানহীনতা সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে গণপরিবহনে। রেলের সময়সূচি যেন শুধু বোর্ডে টাঙানোর জন্য, বাস্তবে তার কোনো মূল্য নেই। এক ঘণ্টা দেরি, দুই ঘণ্টা লেট, এমনকি কখনো কখনো ট্রেনই বাতিল হয়ে যায়!

দূরপাল্লার বাসও সময়মতো ছাড়ে না, ফলে যাত্রীদের পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। কেউ হয়তো সময় ধরে কোনো জরুরি সাক্ষাতে যাচ্ছিলেন - সব ধূলিসাৎ। অথচ পৃথিবীর অনেক দেশে সময় নির্ভুলতা একটি সাংস্কৃতিক গুণ, সেখানে ট্রেন বা বাস নির্দিষ্ট মিনিটে স্টেশনে পৌঁছায় এবং ছাড়ে।

ব্যক্তি পর্যায়ে সময়জ্ঞানহীনতা আরও বিপর্যয়কর। অনেকেই আজকের কাজ আগামীকালের জন্য ফেলে রাখেন, যা কাল পরশুর ওপর চাপ তৈরি করে। ফলাফল- কাজ জমে পাহাড়, মানসিক চাপ বাড়ে, গুণগত মান কমে যায়। ছাত্রছাত্রীরা পরীক্ষার আগ মুহূর্তে পড়াশোনার ঝাঁপ খোলেন, কর্মজীবীরা শেষ তারিখে রিপোর্ট জমা দেন, ফলে উন্নয়নের গতির বদলে তৈরি হয় বিশৃঙ্খলা। অথচ সময়ের কাজ সময়ে শেষ করলে চাপ কমে, উৎপাদনশীলতা বাড়ে, জীবন হয়ে ওঠে গোছানো। আমরা যদি অতীত ইতিহাস দেখি, দেখি বিশ্বে যারা সফল, তারা সময়ের মূল্য দিতে শিখেছে। জাপান, জার্মানি, সুইজারল্যান্ড- সব দেশই সময়কে মেরুদণ্ড বানিয়ে সমাজ গড়েছে। তারা জানে সময় মানেই অর্থ, সময় মানেই উন্নয়ন।

আমাদের দেশে সময় যেন ‘আছে সময়’ মনোভাবের শিকার। কেউ বলেন, “একটু দেরি হলে ক্ষতি কী?” এই সামান্য দেরিই আসলে সামগ্রিকভাবে জাতীয় ক্ষতির রূপ নেয়। শিক্ষাব্যবস্থায় সময়জ্ঞান গড়ে তোলার দায়িত্ব সবচেয়ে বেশি। কিন্তু আমাদের বহু বিদ্যালয়েই শিক্ষকরা নির্ধারিত সময়ের পর আসেন, ক্লাস শুরু হয় দেরিতে, পরীক্ষার সময়সূচি মানা হয় না। শিক্ষার্থীদের মাঝে সময়ের গুরুত্ব ছড়িয়ে দিতে হলে শিক্ষক-অভিভাবক উভয়কে হতে হবে সময়ানুগ। শিশুদের অভ্যাস তৈরি করতে হবে ঘড়ি ধরে চলার, সময়ের ব্যবস্থাপনায় দক্ষ হওয়ার। কেননা, শিশুরাই আগামী দিনের রাষ্ট্রপ্রধান, প্রকৌশলী, চিকিৎসক, শিক্ষক- যদি তারা সময়জ্ঞান না শেখে, তবে ভবিষ্যৎও অন্ধকার।

ধর্মীয় মূল্যবোধেও সময়ের প্রতি শ্রদ্ধার শিক্ষা আছে। ইসলামে বলা হয়েছে, ‘পাঁচটি জিনিসকে পাঁচটির পূর্বে গুরুত্ব দাও’-এর একটি হলো ‘ফাঁকা সময়কে ব্যস্ততার পূর্বে মূল্য দাও’। প্রতিটি নামাজ নির্দিষ্ট সময়ে আদায়ের নির্দেশ, যার মাধ্যমে মানুষকে সময় মেনে চলার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। হিন্দুধর্মে ‘মুহূর্ত’ বা শুভ সময়কে গুরুত্ব দেওয়া হয়, যা সময়ের প্রতি দায়িত্ববোধ গড়ে তোলে। খ্রিষ্টধর্মেও বলা হয়েছে- There is a time for everything - প্রতিটি কাজের জন্যই সময় নির্ধারিত। তাই ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেও সময় হলো সুশৃঙ্খল জীবনের অপরিহার্য অংশ। প্রযুক্তিনির্ভর এই যুগে সময়জ্ঞান অর্জন আগের চেয়ে সহজ। ডিজিটাল ক্যালেন্ডার, রিমাইন্ডার, টাইমণ্ডম্যানেজমেন্ট অ্যাপ- সবকিছুই হাতের মুঠোয়। তবু আমরা ব্যর্থ সময়কে গুরুত্ব দিতে। প্রযুক্তিকে শুধু সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার না করে সময়ের নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারলে, সেটি বরং বিভ্রান্তি ও সময় অপচয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

সঠিকভাবে প্রযুক্তি ব্যবহারে সময় সচেতনতা বৃদ্ধি করা সম্ভব- শর্ত শুধু সদিচ্ছা। সময়জ্ঞান শুধু ব্যক্তিগত নয়, এটি সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় বিষয়। এক কর্মকর্তা সময়মতো ফাইলে সই না করলে নাগরিক দুর্ভোগ বাড়ে। এক চিকিৎসক সময়মতো হাসপাতালে না পৌঁছালে এক রোগীর জীবন হুমকিতে পড়ে। শিক্ষকের দেরি মানে ছাত্রের ভবিষ্যৎ পিছিয়ে পড়া।

একটি সমাজ কতটা সময় সচেতন, তা দিয়েই মাপা যায় তার উন্নয়নের সক্ষমতা। তবে আশার কথা, ধীরে ধীরে সময় সচেতনতার গুরুত্ব মানুষ বুঝতে শুরু করেছে। কর্পোরেট অফিসগুলোতে সময়ানুবর্তিতা এখন একটি মূল্যায়নের মাপকাঠি, অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ঘড়ি ধরে ক্লাস চলছে।

কিন্তু এটি হতে হবে একটি জাতিগত রীতি। ঘড়ির কাঁটায় জীবন বাঁধতে হবে, তবেই উন্নত জাতি হিসেবে গড়ে ওঠা সম্ভব। অতএব, সময়ের গুরুত্ব বোঝা এবং তা জীবনে প্রয়োগ করা এখন সময়ের দাবি।

সময়ের পেছনে নয়, সময়ের সঙ্গে চলুন। কারণ সময়কে অবহেলা মানেই জীবনকে অবহেলা। আর বাঙালিকে বুঝতে হবে- সময় যাকে ধরে রাখতে পারে, সে-ই পারে ভবিষ্যৎকে গড়ে তুলতে।

প্রাবন্ধিক ও শিক্ষার্থী ফুলছড়ি সরকারি কলেজ

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত