প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ০৩ আগস্ট, ২০২৫
কৃষি একটি শ্রমঘন পেশা। এ কারণে বাংলাদেশের কৃষি নির্ভর পরিবারগুলো ক্রমশ কৃষি ছেড়ে ভিন্ন পেশা বেছে নেওয়ার চেষ্টা করতো। কৃষকের ছেলে কৃষক হতে চাইতো না। চাকরি বা ব্যবসাসহ ভিন্ন পেশায় মনোনিবেশ করতো। কৃষকও নিজেও চাইতেন না নিজের সন্তানকে কৃষি পেশায় নিয়ে আসতে। অনেক ক্ষেত্রে পেশা হিসেবে কৃষির সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা ও কম সম্মানের বিষয়টি বিবেচ্য ছিল। কিন্তু দিন বদলের পালায় সেই গ্রহণযোগ্যতা ক্রমশ বাড়ছে। কেননা কৃষি এখন প্রযুক্তিবান্ধব ও আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় অধিক লাভজনক পেশা। কৃষিই সমৃদ্ধি এটা আবারও আমাদের সচেতন সমাজ উপলব্ধি করছেন। এটা ঠিক যে বাংলাদেশ একটি কৃষিপ্রধান দেশ, যেখানে জনসংখ্যার উল্লেখযোগ্য অংশ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষির ওপর নির্ভরশীল। এক সময় কৃষি ছিল মূলত খোরপোশের চাহিদা মেটানোর মাধ্যম। কৃষকরা নিজ পরিবারের খাদ্যসংস্থান নিশ্চিত করতেই কৃষিকাজ করতেন। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই চিত্র বদলে গেছে। এখন কৃষি শুধু পেটের দায় নয়, এটি হয়ে উঠেছে মুনাফাভিত্তিক ও বাজারমুখী বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড। খোরপোশের কৃষি মূলত কৃষক ও তার পরিবারের খাদ্য চাহিদা মেটানোর জন্য করা হতো, যেখানে জমির পরিমাণ যেমন কম ছিল তেমনি প্রযুক্তির ব্যবহারও ছিল সীমিত। খোরপোশের কৃষিতে কৃষক প্রধানত নিজের ও পরিবারের চাহিদা পূরণের জন্য ফসল উৎপাদন করতেন। এটি একটি প্রাচীন ও প্রচলিত কৃষি ব্যবস্থা যা এখনও বাংলাদেশের গ্রামীণ অনেক এলাকায় বিদ্যমান। এই ধরনের কৃষিতে সাধারণত পরিবারভিত্তিক শ্রম ব্যবহৃত হয়, আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার সীমিত থাকে এবং উৎপাদিত ফসল বা পণ্য বাজারে বিক্রির জন্য নয়, বরং নিজ পরিবারের ব্যবহারের জন্য রাখা হয়। অন্যদিকে, বাণিজ্যিক কৃষি হলো মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যে অধিক জমি ব্যবহার করে এবং আধুনিক প্রযুক্তি ও যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে ফসল উৎপাদন করা। সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের দেশের শিক্ষিত তরুণেরা বাণিজ্যিক কৃষিতে ঝুঁকছেন কেননা বাণিজ্যিক কৃষি এখন মূলত আগের তুলনায় অনেক বেশি জনপ্রিয় ও লাভজনক। বাজারে ফসল বিক্রি করে মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যে পরিচালিত বাণিজ্যিক কৃষিকে সামাজিকভাবে এখন বেশ সম্মানের চোখেই দেখা হয়। মোদ্দাকথা হলো, শিল্পায়নের যুগে প্রাচীন কৃষি পদ্ধতি এখন আর টেকসই নয়। কৃষিকে জনপ্রিয় ও লাভজনক করতে খোরপোশের কৃষিকে বাণিজ্যিক কৃষিতে রূপান্তর করতে হবে। বাণিজ্যিক কৃষিতে বৃহৎ আকারের যে জমি ব্যবহৃত হয় যেটাকে আমরা খামার বলে থাকি। সেই খামারে এলাকাভেদে নির্দিষ্ট ফসলের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয় (যেমন ফুল, ফল, সবজি, মাছ, ব্রয়লার ইত্যাদি)। কেবল ফসল উৎপাদন নয়, কৃষির সঙ্গে যুক্ত থাকে ফসলের প্রক্রিয়াকরণ, প্যাকেজিং, বিপণন ও রপ্তানির বিষয়াদির সমন্বিত ব্যবস্থাপনা। বাংলাদেশে এখনও অধিকাংশ কৃষক খোরপোশের কৃষিতে নিয়োজিত থাকলেও কয়েক দশকে বাণিজ্যিক কৃষির প্রসার ঘটেছে। শাকসবজি, পোল্ট্রি, মাছচাষ, ফুলচাষ, ফলচাষ এমনকি অর্গানিক ফসল চাষ এখন বাণিজ্যিক কৃষির আওতায় এসেছে। এটি দেশের অর্থনীতিতে নতুন দিগন্ত খুলেছে। তবে এই রূপান্তরের পথ কুসুমাস্তীর্ণ নয়। খোরপোশের কৃষকদের অনেকেই মূলধন, প্রযুক্তি ও জ্ঞানের অভাবে বাণিজ্যিক কৃষিতে রূপান্তর ঘটাতে পারছেন না। পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, বাজারজাতকরণের সমস্যাসহ অনেক প্রতিবন্ধকতা তো রয়েছেই। দেশে প্রায় এক কোটির মতো মানুষ মনমতো কাজ পান না। তারা পড়াশোনা করেন না, কাজেও নেই। তারা ছদ্মবেকার। কোনো রকম জীবনধারণের জন্য কাজ করেন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে, দেশে বর্তমানে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা প্রায় ২৭ লাখ এবং প্রতিবছর নতুন করে ৪-৫ লাখ তরুণ এই তালিকায় যুক্ত হচ্ছে। অথচ সেই তুলনায় নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে খুবই সীমিত পরিসরে। এই বাস্তবতাকে আমাদের মেনে নিতেই হবে সবার জন্য একযোগে চাকরির সুযোগ সৃষ্টি এখনই সম্ভব নয়। তবে সরকার চাইলেই এই বৃহৎ জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারে তাদের কর্মমুখী প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে। যদিও এই সংকট মোকাবিলায় সরকার নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করছে বাস্তবে তা যথেষ্ট নয়। আমরা এখন জনসংখ্যার বোনাস পর্যায়ে রয়েছি, অর্থাৎ দেশের কর্মক্ষম তরুণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে।
লেখক : ঊর্ধ্বতন যোগাযোগ কর্মকর্তা, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইন্সটিটিউট