প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ২০ আগস্ট, ২০২৫
দেশের বর্তমান পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ভেক্টরবাহিত রোগ, বিশেষ করে মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার ভয়াবহতা দিন দিন বেড়েই চলছে। ডেঙ্গু বাংলাদেশে আসার পর থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত ডেঙ্গুতে সবচেয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতি ছিল ২০২৩ সাল।
দেশের বর্তমান পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ভেক্টরবাহিত রোগ, বিশেষ করে মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার ভয়াবহতা দিন দিন বেড়েই চলছে। ডেঙ্গু বাংলাদেশে আসার পর থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত ডেঙ্গুতে সবচেয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতি ছিল ২০২৩ সাল। যেখানে সরকারি হিসাব মোতাবেক আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ এবং ডেঙ্গুতে মৃত্যু ছিল ১ হাজার ৭০৫। ২০২৩ সালের ৯ আগস্ট পর্যন্ত মোট আক্রান্ত ছিল ৭৫ হাজার ৯৬ জন এবং মোট মৃত্যু ছিল ৩৫২। যেখানে ২০২৪ সালে মোট আক্রান্ত ছিল ৭ হাজার ৫২৩ জন এবং মোট মৃত্যু ছিল ৬২। ২০২৫ সালের ৯ আগস্ট পর্যন্ত মোট আক্রান্ত ২০২৪ সালের তিন গুণেরও বেশি, অর্থাৎ ২৩ হাজার ৭৩৫ জন এবং মৃত্যু প্রায় দ্বিগুণ, যা সংখ্যার ভিত্তিতে ৯৮। এখন বুঝতে কি বাকি থাকে যে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার বাহক এডিস মশার বিস্তার আমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই।
মশা নিয়ন্ত্রণ করতে অবশ্যই তার প্রজনন স্থল নিয়ন্ত্রণের আওতায় নিতে হবে। তার জন্য প্রজনন স্থল চিহ্নিতকরণে জন্য নিয়মিত সার্ভিল্যান্স প্রয়োজন। প্রয়োজন পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন। আমাদের দেশে এই সার্ভিল্যান্স করার কাজটি নিয়মিত সম্পাদন করত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ডিজি হেলথের আওতাধীন কমিউনিকেবল ডিজিজ কন্ট্রোল বা সিডিসি। এ জরিপ করা হতো প্রতি বছর তিনটি ধাপে। প্রি মুনসুন (বর্ষা-পূর্ব), মুনসুন (বর্ষাকাল) এবং পোস্ট মুনসুন (বর্ষা-পরবর্তী)। অর্থাৎ বর্ষাকাল শুরুর আগে একটি জরিপ করার মাধ্যমে মশার ঘনত্ব কেমন রয়েছে তার একটি পরিচ্ছন্ন ধারণা পাওয়া এবং সেই ঘনত্ব অনুযায়ী স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় মশা দমনের ব্যবস্থাপনা গ্রহণ করবেন। একইভাবে মুনসুন বা বর্ষাকাল চলাকালীন আরেকটি জরিপ পরিচালনা করা হতো। যাতে করে বর্ষাকালে বর্ধিত মশার প্রজনন স্থলে মশকের ঘনত্ব অনুসারে নিয়ন্ত্রণে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ। একই ধারাবাহিকতায় বর্ষা-পরবর্তী জরিপ করা হয় পরবর্তী বছরের জন্য কেমন প্রস্তুতি প্রয়োজন সেটার ভিত্তি রচনার জন্য।
মশক দমনের ক্ষেত্রে মশার লার্ভা ও পূর্ণাঙ্গ মশার ঘনত্ব জরিপ অত্যাবশ্যক। এটা যত বেশি বেশি হবে তত কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ সম্ভব হবে। কিন্তু অতীব দুঃখের বিষয় সিডিসি যে অর্থায়নে এটা পরিচালনা করত তা ওপি বা অপারেশনাল প্ল্যান, যা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত। এই ওপি হঠাৎ করে বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এ নিয়মিত মশক ঘনত্ব জরিপের ছন্দপতন হয়েছে। ছন্দপতন হয়েছে সিডিসির কার্যক্রমে। এর ফলে ২০২৪ সালের বর্ষা-পরবর্তী জরিপ হয়েছে ২০২৫ সালের বর্ষা পূর্ববর্তী জরিপ হিসেবে। আবার এখন ২০২৫ সালে বর্ষাকালীন জরিপ এখনও শুরুই হয়নি। আদৌ হবে কি না তারও তেমন কোনো নিশ্চয়তা নেই।
যদি বর্ষাকালীন জরিপ না হয় তাহলে ডেঙ্গুর ভয়াবহতা লাগামহীন হয়ে পড়বে। যেখানে ডেঙ্গু প্রতিরোধে মশক নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে একই সঙ্গে বছরে কমপক্ষে তিনটি মশক ঘনত্ব জরিপ তিনটি আলাদা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে করানো প্রয়োজন, সেখানে একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেই তিনটি জরিপ করা সময়মতো সম্ভব হচ্ছে না। এ অবস্থায় ওপির ওই স্থানে যেকোনোভাবে অর্থনৈতিক সাহায্য প্রদানপূর্বক জরিপটি সঠিকভাবে অব্যাহত রাখা অতীব প্রয়োজন। অন্যথায় আমরা চুপচাপ ও নিষ্ক্রিয় থাকলে মশা; কিন্তু তার কার্যক্রম থামিয়ে রাখবে না। এখন তার জলজ্যান্ত প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। যে মশকবাহিত রোগটি শুধু ঢাকাকেন্দ্রিক ছিল। এখন তা খুবই দ্রুত ও স্বাচ্ছন্দ্যে প্রত্যন্ত গ্রামেও বিস্তৃত হয়েছে। যে রোগটি প্রতিরোধযোগ্য তা কেন আমাদের অতি মূল্যবান জীবন কেড়ে নেবে।
ঢিলেঢালাভাবে যত প্রোগ্রামই হাতে নিই না কেন, কাজের কাজ তেমন কিছু হবে না। দিন দিন মশার ঘনত্ব যেমন বৃদ্ধি পাচ্ছে, তেমনি বৃদ্ধি পাচ্ছে মশার প্রজনন ক্ষেত্র। পরিবর্তিত হচ্ছে মশা ও ভাইরাসের ভ্যারিয়েন্ট। যে ইনসেক্টিসাইড ব্যবহার করা হচ্ছে তার সবগুলোর কার্যকরী উপাদানের পরীক্ষা, প্রয়োগ পদ্ধতি, কর্মীর প্রশিক্ষণ, কর্মীর কাজের যথাযথ তদারকি, কাজের উপযুক্ত মূল্যায়ন, জনসাধারণের সচেতনতার সঙ্গে মশার প্রজনন স্থল ধ্বংসের জন্য সম্পৃক্ততা প্রভৃতি অত্যন্ত সিদ্ধহস্তে করা প্রয়োজন। কোনোভাবেই এ কাজগুলোর প্রতি গাফিলতি করা ঠিক হবে না। একটি প্রাণও আমাদের কাছে অতি মূল্যবান।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের কো-অর্ডিনেশন ব্যবস্থাপনায় অতি দ্রুত বর্ষাকালীন জরিপ কাজটি সম্পন্ন করা আশু প্রয়োজন। তাছাড়া স্থানীয় সরকারের প্রতিষ্ঠানগুলো যেমন অন্ধকারে থাকবে, তেমন অন্ধকারে থাকবে সাধারণ মানুষ। মশার ঘনত্বের ম্যাপিং না থাকলে সিটি কর্পোরেশনের কর্মীদের সঠিক বণ্টন ও কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ ও পরিচালনাও হয়ে উঠবে দুরূহ। কোন কোন এলাকায় লার্ভার অধিক বিআই সমৃদ্ধ এবং কোন কোন প্রজনন ক্ষেত্র অধিক রিস্ক ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করছে তা জানা না থাকলে সঠিকভাবে ব্যবস্থাপনার ঘাটতি থাকবে। এমনভাবে চলতে থাকলে ভেক্টরবাহিত রোগগুলোর ইমার্জিং এবং রি-ইমার্জিং মারাত্মক আকার ধারণ করবে। প্রচলিত ওষুধ বা পাবলিক হেলথ পেস্টিসাইড অ্যানালাইসিসসহ সব কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়বে। মুখ থুবড়ে পড়বে স্বাস্থ্যসেবা কাঠামো। উপেক্ষিত জনস্বাস্থ্য সচেতনতা তলানি থেকেই শেষ হয়ে যাবে।
সেই সঙ্গে জাতি চরম দুর্ভোগের শিকার হয়ে অতি মূল্যবান জীবন দিতেই থাকবে। এমনিতেই দেশের অসংক্রামক রোগে মানুষ আজ চরম পরিস্থিতি পার করছেন। তার ওপর ভেক্টরবাহিত রোগের এমন পরিস্থিতি ভাবাই যায় না। রুগ্?ণ জাতিকে নিয়ে আকাশছোঁয়া স্বপ্ন তো দূরের কথা পরনির্ভরশীলতায় ভোগান্তির জীবন তিলে তিলে অন্ধকারের দিকে ধাবিত করে। এ ভোগান্তি থেকে জাতিকে সুন্দর ও স্বাচ্ছন্দ্যময় জীবন উপহার দিতে হলে ভেক্টর ব্যবস্থাপনায় সমন্বিত বাহক ব্যবস্থাপনার (আইভিএম) বিকল্প নেই। মশা নামক বাহকের পরাকাষ্ঠে আবদ্ধ হওয়া জীবনকে সুন্দর করতে আসুন আইভিএমের সঠিক প্রয়োগ করি। আসুন সবাই মিলে প্রতিটি কর্মকাণ্ড সিকুয়েন্স বজায় রেখে সম্পাদন করার মাধ্যমে ডেঙ্গু ও চিকনুগুনিয়ার বিরুদ্ধে শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তুলি।
লেখক : অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, কীটতত্ত্ব বিভাগ, জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান (নিপসম)